কপিল দেব বিশ্বের এক নম্বর উইকেটশিকারি হওয়ার তেইশ বছর পরে বোলিং দুনিয়ার শিখরে আবার এক ভারতীয়। এ বার মহিলাদের একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহক হয়ে ইতিহাসে ঢুকে পড়লেন বাংলার এক মেয়ে। তাঁর নাম ঝুলন গোস্বামী। ক্রিকেট মহলে যিনি পরিচিত ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’ নামে।
নদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তাঁর উত্থানটা এমনিতেই ছিল সেরা রূপকথা। সংগ্রামের দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে তিনি দেশের অধিনায়কত্ব করেছেন। বিশ্বকাপে ভারতের ক্যাপ্টেন্সি করেছেন। যে কৃতিত্ব বাংলা থেকে আর আছে শুধু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটার, সেরা অলরাউন্ডারের পুরস্কার জিতেছেন। মঙ্গলবারের কীর্তি তাঁর মুকুটকে আরও রঙিন পালকে ভর্তি করে দিয়ে গেল।
কী করলেন ঝুলন?
না, প্রায় দশ বছর ধরে যে রেকর্ড কেউ ভাঙার সাহস দেখাননি, সেটাই তিনি গুড়িয়ে দিলেন মঙ্গলবার। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাথরিন ফিৎজ্প্যাট্রিকের ছিল ১৮০ উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেই সংখ্যাকে টপকে একদিনের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়ে গেলেন ঝুলন। ম্যাচে নিলেন তিন উইকেট।
৩৪ বছর বয়সি ঝুলন ভারতের হয়ে খেলছেন প্রায় পনেরো বছর ধরে। যা তাঁর চূড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতা এবং ধারাবাহিকতার সাক্ষ্য বহন করছে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত চ্যাপেল ভাইদের মতো ঝুলনের ক্রিকেট খেলাও শুরু হয়েছিল চাকদহে তাঁর বাড়ির উঠোনে। কিন্তু ইয়ান বা গ্রেগ চ্যাপেলের মতো সৌভাগ্য মোটেও ছিল না তাঁর যে, খেলতে চাইলেই ঢুকে পড়বেন। ছেলেদের ক্রিকেটে তাঁর জায়গা হবে কী করে?
আরও পড়ুন: গম্ভীর হয়তো ফের শুরুতে
দরজা খুলে দিল ভাগ্য। দাদাদের দুই দলে এক দিন একটি দলে একটি ছেলে কম পড়ল। তাঁকে নামতে দেওয়া হল। ‘‘সে দিন আমার খেলা দেখে ওরা বুঝতে পারল যে, আমিও খেলতে পারব। তার পর থেকে নিয়মিত সদস্য হয়ে যাই,’’ এক বার ক্রিকেটে হাতেখড়ির কাহিনি নিয়ে বলতে বসে শুনিয়েছিলেন ঝুলন।
চাকদহের উঠোন থেকে বিশ্বের শিখরে। তাঁর বিরল কীর্তিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনন্দন জানিয়েছেন টুইটারে। সাধারণ ক্রিকেটভক্তরা অনেকে লিখেছেন, ঝুলন, তুমি আমাদের গর্ব। চাকদহ থেকে বিশ্বের শিখরে— অনন্য ক্রিকেটযাত্রায় দু’জনের কথা খুব মনে পড়ে ঝুলনের। প্রাক্তন মহিলা ক্রিকেটার ও কোচ পুর্ণিনা রাও। যিনি তাঁকে শিখিয়েছেন, ‘‘ফলের দিকে না তাকিয়ে পরিশ্রম চালিয়ে যাও। ফল ঠিকই আসবে।’’ এবং, প্রাক্তন ক্রিকেটার নীতু ডেভিড। ‘‘ম্যাচের এক ঘণ্টা আগে এসে বল করত নীতু। ওর মতো প্র্যাকটিসকে অত গুরুত্ব দিতে দেখিনি আর কাউকে,’’ বলেন ঝুলন। ‘মেয়েদের বিষাণ সিংহ বেদী’ বলে পরিচিত নীতু ডেভিডই আগে ছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহক। তাঁর কাছ থেকে সেই রেকর্ড দখল করে নেন ‘কপিল দেব’ ঝুলন।
বিশ্ব ক্রিকেটে তাঁর প্রিয় দুই পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং ওয়াসিম আক্রম। ২০০৯ সালে সিডনিতে ম্যাকগ্রার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেখানে পরামর্শও দিয়েছিলেন অস্ট্রেলীয় পেসার, ‘‘লাইন-লেংথের দিকে সবচেয়ে জোর দেবে। স্মার্ট বোলিং করার চেষ্টা করো।’’
চাপে পড়লে তিনি কী করেন? জিজ্ঞেস করায় ঝুলন জানিয়েছিলেন, বই তাঁর সেরা সঙ্গী। আত্মজীবনী পড়তে ভালবাসেন। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে ল্যান্স আর্মস্ট্রং— সব পড়েন। আর্মস্ট্রং এখনও তাঁর ‘হিরো’। তেমনই প্রিয় অ্যাথলিটের নাম মারিয়ন জোন্স। ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়ে কলঙ্কিত তো দু’জনেই? প্রশ্ন শুনে হেসেছিলেন ঝুলন, ‘‘আমার জন্য তো কোনও ড্রাগ নেই যে, সেটা রক্তে চালান করে দিলেই হৃদয় থেকে মুছে যাবে আমার প্রিয়দের নাম।’’
এক বার যিনি ঝুলনের নায়ক, তিনি চিরতরের জন্য নায়ক। তিনি মারিয়ন জোন্স বা ল্যান্স আর্মস্ট্রংয়ের মতো কলঙ্কিত হলেও ছুড়ে ফেলার ব্যাপার নেই। ৯ মে, ২০১৭— ঝুলন গোস্বামীও চিরতরে স্থান করে নিলেন ভারতীয় ক্রিকেট জনতার হৃদয়ে। কী বলা হবে তাঁকে? চাকদহ এক্সপ্রেস? নাকি মেয়েদের কপিল দেব?
মনে হয় না ঝুলনের কোনও আগ্রহ থাকবে তাতে। ‘ক্যাপ্টেন কুল’ ধোনির মতোই তিনি নির্লিপ্ত থাকেন ক্রিকেট মাঠের হার-জিত নিয়ে। খুব বেশি হলে লাজুক হেসে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে ডুবে যাবেন পরের লক্ষ্য নিয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy