স্মৃতি: সিএবি-র এক অনুষ্ঠানে বিশ্বনাথ দত্ত। ফাইল চিত্র
ময়দানের ‘ভীষ্ম’ বিশ্বনাথ দত্ত চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল সাড়ে তিন দশকের এক বর্ণময় ক্রীড়া প্রশাসকের জীবন।
প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে ১৯৯১-তে কর্তা হিসাবে অবসর নিয়েছিলেন। সর্বভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে হেরে যাওয়ার পর। তা সত্ত্বেও অসুস্থ অবস্থাতেও ময়দানের ‘বিশুদা’-র যোগাযোগ ছিল ক্লাবগুলির সঙ্গে। যে ক্লাব-সখ্যের জোরেই ফুটবল ও ক্রিকেট—এই দুটি জনপ্রিয় খেলায় বাংলা ও সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর কার্যত শাসন করেছেন তিনি।
বিরানব্বই বছরের বিশ্বনাথবাবু তাঁর প্রশাসক জীবনে বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ যেমন নিয়েছেন, তেমনই বেশ কিছু গঠনমূলক কাজও করেছেন। আই এফ এ শিল্ডে বিদেশি ফুটবলার আনা থেকে জেলায় খেলা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্ট করেছেন রাজ্য ফুটবল সংস্থায় সচিব থাকার সময়। তেমনই ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় নির্বাচকদের ‘ভাঁড়’ বলায় মোহিন্দর অমরনাথকে শাস্তি দিয়েছেন। তার আগে অবশ্য মোহিন্দারকে প্রথমে ডেকে ক্ষমা চেয়ে চিঠি দিতে বলেছিলেন তিনি। অন্য দিকে নির্বাচকরা বাদ দেওয়ার পরও তাঁদের উপর প্রভাব খাটিয়ে কপিলদেবকে ফিরিয়ে এনেছেন ভারতীয় দলে। বিশ্ব রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কপিলদেবকে সুযোগ করে দিয়েছেন রেকর্ড করার। আবার সেই কপিলদেবের সঙ্গে দিলীপ বেঙ্গসরকার, অরুণলাল, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তকে তিনি সাসপেন্ডও করেছিলেন বোর্ডের নির্দেশ অমান্য করে যুক্তরাষ্ট্রে খেলতে যাওয়ার জন্য। তবে পরে তা আদালতের এক নির্দেশে খারিজ হয়ে যায়। ১৯৮৭-র রিলায়ান্স কাপ সংগঠনেও বিশ্বনাথবাবুর অবদান ছিল।
কঠোর এবং ব্যক্তিত্ববান প্রশাসক হিসাবে সুনাম ছিল তাঁর। ময়দানী রাজনীতির তিনি ছিলেন সেই সময়ের ‘চাণক্য’! জগমোহন ডালমিয়া, অশোক ঘোষ, নন্তু কোলের মতো সফল সংগঠক তুলে এনেছেন তিনি। রাজস্থান ক্লাবের ফুটবল সচিব ডালমিয়াকে যেমন এনে বসিয়েছেন সি এ বি-র কোষাধক্ষ্য পদে, তেমনই মোহনবাগানের ক্রিকেট সচিব অশোক ঘোষকে করে দিয়েছেন আইএফএ সচিব। তাঁর আত্মকথায় এ রকম ঘটনার অসংখ্য প্রমাণ নিজেই লিখেছেন তিনি।
বাংলাদেশের ঢাকায় বিশ্বনাথবাবুর পৈতৃক বাড়ি হলেও তাঁর শৈশব কেটেছে শিয়ালদহ স্কট লেন অঞ্চলে। ছোটবেলায় টাকা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে পৌছে দিতেন বাবার নির্দেশে। সে জন্য তাঁকে নানা সমস্যা পড়তে হয়েছিল। পারিবারিক ক্লাব জর্জ টেলিগ্রাফ দিয়ে তাঁর ময়দানি কর্তা হিসাবে হাতেখড়ি। সেখান থেকেই প্রয়াত কর্তা বেচু দত্ত রায়ের জায়গায় ১৯৬৪-তে আইএফএ সচিব হন সোমবার ভোরে প্রয়াত বিশ্বনাথবাবু। প্রায় এগারো বছর বাংলার ফুটবল পরিচালনা করেছেন তিনি। কখনও একক ভাবে, কখনও যুগ্ম সচিব হিসাবে। তাঁর সময়েই প্রথম আই এফ এ শিল্ড ছড়িয়ে পড়েছিল জেলায়। বিশ্বনাথবাবুর সময়েই ইরানের পাজ, উত্তর কোরিয়ার পিয়ং ইয়ং ক্লাব খেলতে এসেছিল শহরে। জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার ক্লাবও এসেছিল শিল্ডে খেলতে। ১৯৭৫-এ আই এফ এ ছেড়ে ক্রিকেট প্রশাসনে চলে আসেন তিনি। ১৯৭৭-এ সি এ বি-র সচিব হন বিশ্বনাথবাবু। ১৯৮১-তে হন প্রেসিডেন্ট। এর চার বছর পর চেয়ারম্যান হন। সেখান থেকেই পরে রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান ছিলেন দশ বছর। দু’বছর ছিলেন ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। ছয় বছর ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘‘বেশি দিন কোনও কর্তারই এক পদে থাকা উচিত নয়। তা হলে তাঁর সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা জন্মায়।’’ তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর ভবানীপুরের বাড়িতে যাঁরা ভিড় করেছিলেন, তাঁদের স্মৃতি চারণায় উঠে এসেছে অসংখ্য গল্প। কেউ বলেছেন, সাংগঠনিক প্রধান হয়েও চেকে সই করতে চাইতেন না তিনি। এক জন বললেন, ‘‘কোনওদিন সি এ বি-র পয়সায় এক কাপ চা-ও খাননি। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যেতেন।’’ কারও মুখ থেকে বেরিয়েছে, ‘‘প্রশাসন চালাতে প্রিয় কাউকে ডেকে এনেও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শাস্তি দিয়েছেন।’’ বিশ্বনাথবাবু যখন প্রশাসক হিসাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন কলকাতার তিন প্রধান ক্লাব চালাতেন প্রয়াত ধীরেন দে, জ্যোতিষ চন্দ্র গুহ, নিশীথ ঘোষ, আনোয়ার আলির মতো ক্ষমতাবান কর্তারা। তাদের নানা ভাবে সামলাতেন তিনি। বিশ্বনাথবাবুর আমলেই ইডেন পুরোপুরি ক্রিকেটের হয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy