Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

জবির গোলে দাদার মৃত্যুর যন্ত্রণা ভুললেন গুরু বিজয়ন

ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে যুবভারতীর গ্যালারিতে বসে কাঁদছিলেন বছর পঞ্চাশের এক সমর্থক। মাঠে তখন ডার্বি জয়ের উৎসব চলছে। জবি জাস্টিন নাচছেন। বোরখা গোমেস পেরেস জার্সি খুলে ছুড়লেন গ্যালারির দিকে। কিন্তু তিনি কেঁদেই চলেছেন।

আই লিগ ডার্বি জেতার পরে উচ্ছ্বাস জবি জাস্টিনদের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

আই লিগ ডার্বি জেতার পরে উচ্ছ্বাস জবি জাস্টিনদের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

শুভজিৎ মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৩
Share: Save:

ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে যুবভারতীর গ্যালারিতে বসে কাঁদছিলেন বছর পঞ্চাশের এক সমর্থক। মাঠে তখন ডার্বি জয়ের উৎসব চলছে। জবি জাস্টিন নাচছেন। বোরখা গোমেস পেরেস জার্সি খুলে ছুড়লেন গ্যালারির দিকে। কিন্তু তিনি কেঁদেই চলেছেন।

সাড়ে বত্রিশ মাস পরে শাপমুক্তির আনন্দাশ্রু!

রবিবাসরীয় ডার্বি হাজার ২৩৮ কিলোমিটার দূরের আরও এক জনের যন্ত্রণা দূর করেছে। তিনি— আই এম বিজয়ন! শনিবারেই পথ-দুর্ঘটনায় দাদাকে হারিয়েছেন ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার। তা সত্ত্বেও চব্বিশ ঘণ্টা আগে ফোনে জবিকে ডার্বি জয়ের মন্ত্র দিয়েছিলেন। এ দিন প্রিয় অনুজ অবিশ্বাস্য গোল করায় শোকের আবহেও উচ্ছ্বসিত বিজয়ন। ফোনে বললেন, ‘‘ডার্বিতে জবির অবিশ্বাস্য গোল দেখে দাদার মৃত্যুর যন্ত্রণা ভুললাম।’’

কেরলের রাজধানী তিরুঅনন্তপুরমে বাড়ি জবির। বাবা মৎসজীবী। তিনি চাননি ছেলে কলকাতায় খেলতে যাক। কিন্তু বিজয়নের পরামর্শে বাবার আপত্তি সত্ত্বেও গত মরসুমে আগে ইস্টবেঙ্গলে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জবি। অভিষেকের মরসুমে অবশ্য নিয়মিত খেলার সুযোগ পাননি তিনি। আর এই মরসুমে তাঁকে বাদ দিয়ে প্রথম একাদশ গড়ার কথা ভাবতেও পারেন না কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস। রবিবার ডার্বি শেষ হওয়ার পরেই ত্রিশূর থেকে ফোনে বিজয়ন বললেন, ‘‘কেরলের এক প্রতিযোগিতায় প্রথম দেখি জবিকে। আমিই ওকে ইস্টবেঙ্গলে খেলার পরামর্শ দিয়েছিলাম।’’ বিজয়ন যোগ করলেন, ‘‘জবিকে বলেছিলাম, ফুটবলার হিসেবে যদি প্রতিষ্ঠিত হতে চাও তো কলকাতায় যাও। সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ফুটবলার খুঁজতে কেরলে এসেছিল অ্যালভিটো ডি’কুনহা। জবির খেলা পছন্দ হওয়ায় চুক্তি করে।’’

আরও পড়ুন: রক্ষণের ভুল দু’পক্ষেই, তাই দেদার গোল

ইস্টবেঙ্গলে খেলার জন্য জবিকে রাজি করানোর কাজটা অবশ্য মোটেই সহজ হয়নি। অ্যালভিটো বললেন, ‘‘ত্রিশূরে কেরল বিদ্যুৎ পর্ষদের হয়ে একটা প্রতিযোগিতায় খেলছিল জবি। ফাইনালে ওর খেলা দেখে মুগ্ধ হই। ম্যাচের পরেই ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু জবি রাতে হোটেলে যেতে বলল। আশ্চর্যজনক ভাবে তার পর থেকেই মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়। হতাশ হয়ে সেই রাতেই তিরুঅনন্তপুরমে ফেরার বাস ধরেছিলাম। কারণ, পরের দিনই কলকাতার ফেরার উড়ান ছিল আমাদের। তা ছাড়া তিরুঅনন্তপুরমেই যে-হেতু থাকত জবি, তাই উড়ানের টিকিট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলাম শেষ মুহূর্তে।’’ তার পরে? লাল-হলুদের প্রাক্তন তারকা বললেন, ‘‘পরের দিন জবিকে খুঁজে বার করলাম। কিন্তু ও কিছুতেই ইস্টবেঙ্গলে খেলতে রাজি হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিজয়নের শরণাপন্ন হলাম। ফোনে বিজুভাই অনেক বোঝানোর পরেই চুক্তিতে সই করতে রাজি হল জবি।’’

আরও পড়ুন: ‘পাঁচ গোল হল না, আক্ষেপ রয়ে গেল’

বিজয়ন শুধু জবির আদর্শ নন, অভিভাবকও। শনিবার রাতেই ফোন করেছিলেন ত্রিশূরে। কী পরামর্শ দিয়েছিলেন জবিকে? ভারতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক বললেন, ‘‘জবিকে বলেছিলাম, ডার্বি তারকার জন্ম দেয়। এই সুযোগ হাতছাড়া কোরো না। কখনও ভয় পাবে না। মনে করবে, মাঠে সবাই সমান। কেউ তোমার চেয়ে এগিয়ে নেই।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘চোট পেয়ে ইস্টবেঙ্গলের প্রধান স্ট্রাইকার এনরিকে এসকুয়েদা ছিটকে গিয়েছে। তুমি শুধু কোচ নও, লক্ষ লক্ষ লাল-হলুদ সমর্থকদেরও ভরসা। ওদের হতাশ কোরো না।’’

জবি পুরো ম্যাচেই অসাধারণ খেলেছেন। শুরু থেকেই মোহনবাগান অধিনায়ক এজে কিংসলে কড়া ট্যাকল করছিলেন জবিকে। লাল-হলুদ স্ট্রাইকার কিন্তু লড়াই করে গিয়েছেন। ইস্টবেঙ্গলের তৃতীয় গোলের নেপথ্যেও জবি। কারণ, তাঁকে ফাউল করেই লাল কার্ড (দ্বিতীয় হলুদ কার্ড) দেখেন কিংসলে।

রবিবার ম্যাচ শেষের পরে যুবভারতী থেকেই বিজয়নকে ফোন করেন জবি। লাল-হলুদের জয়ের অন্যতম নায়ক বললেন, ‘‘বিজয়নের বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তাই খুব খারাপ লাগছিল। ওঁর জন্যই সফল হতে পেরেছি। তাই ফোন করেছিলাম। তবে ফোন করায় দারুণ খুশি হয়েছেন বিজয়ন।’’

খুশির হাওয়ায় বদলে গিয়েছে লাল-হলুদ অন্দরমহলের আবহও। যুবভারতীর ড্রেসিংরুমে চলে উদ্দাম নৃত্য। তবে কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস ডার্বি জিতে উচ্ছ্বাসে গা-ভাসাতে রাজি নন। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বললেন, ‘‘আমি এখানে শুধু ম্যাচ জিততে আসিনি। ইস্টবেঙ্গলকে একটা দল হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমাদের এখনও অনেক উন্নতি করতে হবে। কারণ, পুরো ম্যাচটা আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। দ্রুত ভুলত্রুটি শুধরে নিতে হবে।’’ ডার্বি নিয়ে উন্মাদনায় তিনি মুগ্ধ। বললেন, ‘‘এই ধরনের ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে গর্বিত। দারুণ অভিজ্ঞতা।’’ ডিফেন্ডার বোরখা উচ্ছ্বসিত বললেন, ‘‘অভিষেকের ডার্বিতে জিতে দারুণ লাগছে। সমর্থকেরা এই মুহূর্তটা উপভোগ করুক।’’

ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা রেফারির শেষ বাঁশি বাজানোর পর থেকেই উৎসবে মেতে ওঠেন। কেউ লাল-হলুদ পতাকা নিয়ে দৌড়চ্ছেন। কেউ কেউ আবার ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের সঙ্গে তালি উৎসব (ভাইকিং চ্যান্ট)-এ শামিল হন। সাড়ে বত্রিশ মাস পরে যুবভারতীর রং যে ফের লাল-হলুদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE