উচ্ছ্বাস: নিজের দ্বিতীয় গোলের পরে উল্লাস ইস্টবেঙ্গলের লালডানমাউইয়া রালতের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
আলেসান্দ্রো মেনেন্দেসের ছবি দিয়ে একটা ব্যানার ঝুলছিল লাল-হলুদ গ্যালারিতে। তাতে ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘পারলে তুমিই ডার্বি জেতাতে পারো আমাদের।’
রবিবাসরীয় রাতে ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে মনে হচ্ছিল, ডার্বিতে মশালবাহিনীর এ দিনের জয়যাত্রার কোলাজে ইস্টবেঙ্গলের স্প্যানিশ কোচের সঙ্গে আরও দু’টো ছবি জুড়ে দেওয়া যেতে পারে—লালডানমাউইয়া রালতে এবং জবি জাস্টিনের। সাড়ে বত্রিশ মাস পরে কোনও প্রতিযোগিতায় মোহনবাগানকে হারাল ইস্টবেঙ্গল। এবং সেটা কোনও স্প্যানিশ বা কোস্টারিকান ফুটবলারের সৌজন্যে নয়। মিজোরাম এবং কেরলের নিখাদ দুই ভারতীয় ফুটবলারের তিনটি মনে রাখার মতো গোল মশালে আগুন ধরিয়ে দিল এ দিন। শীতের রাতে শাপমুক্তির আনন্দ এনে দিল শতবর্ষ ছুঁতে যাওয়া ক্লাবে।
মিজোরামের চাঁদমারি স্পোর্টিং থেকে উঠে আসা জুনিয়র রালতে (লালডানমাউইয়াকে ওই নামেই ডাকা হয়) পূর্ণিমার চাঁদ হলেন নিজে জোড়া গোল করে এবং একটি করিয়ে। আর কেরলে বিদ্যুৎ পর্ষদের কর্মী জবি বিরল অ্যাক্রোবেটিক সাইড ভলির অসাধারণ গোলে আলো জ্বালালেন অন্ধকারে ডুবে থাকা লাল-হলুদ তাঁবুতে।
খেলার শেষে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েও বিদেশি কোচের পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলেন জুনিয়র রালতে। আলেসান্দ্রো কথা বলছেন, আর তাঁর পাশে বসে মিটিমিটি হাসছেন। কে বলবে, কলকাতা এবং আই লিগ ডার্বিতে পরপর গোল করেও ওই ছোট্টখাট্টো পাহাড়ি ছেলেটা হঠাৎ-ই ডার্বি-বয় হয়ে গিয়েছেন ময়দানে। দু’বছর হয়ে গেল কলকাতায় এসেছেন, অথচ মিজো-ভাষার বাইরে কথা বলতে পারেন না। কোচের মতো তাঁরও সঙ্গেও দোভাষী এক ইংরেজি জানা সতীর্থ। মিজো যুবকের মুখাবয়বে কোনও পরিবর্তন নেই। ‘‘এটা সেরা ম্যাচ নয়। সব ম্যাচই সেরা’’ বলার সময় অদ্ভুত নির্লিপ্ত।
কিন্তু মাঠে তো এই রালতের তেজেই পালতোলা নৌকা ডুবে গেল? সাত ম্যাচ পরে সবুজ মুছে যুবভারতীর আকাশে উড়ল শুধুই লাল আবির। মোবাইল আলো দুলিয়ে সমর্থকরা ছুটির দিনের গ্যালারিকে করে তুললেন মোহময়। মিছিল করে বাড়ি ফেরার সময় লাল-হলুদ সমর্থকদের মুখে নতুন স্লোগান, ‘‘রালতে-জবির গোলে পালতোলা নৌকা ডোবে।’ দুই ছাত্রের খেলা দেখে রিয়াল মাদ্রিদ ‘বি’ দলে কোচিং করিয়ে আসা অলেসান্দ্রো এতটাই উচ্ছ্বসিত যে বলেই ফেললেন, ‘‘ওদের জাতীয় দলে ডাকা উচিত।’’
ম্যাচের আগের দিনের অনুশীলনে ইস্টবেঙ্গল কোচ আলেসান্দ্রো এবং মোহনবাগান কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তী দু’জনেই রক্ষণ সংগঠনের উপর জোর দিয়েছিলেন। গোল আটকানোর শিক্ষা দিয়েছিলেন ছাত্রদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, দু’জনেই তাঁদের ছাত্রদের পরীক্ষায় পাঠিয়ে পাস করাতে পারলেন না। টাটকা বিশ্বকাপার জনি আকোস্তা এবং তাঁর সতীর্থরা নিজেদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন, জোড়া গোল হজম করে। আর কিংসলে ওবুমেনেমেরা সল্টলেকের স্টেডিয়ামে গোল খাওয়ার পরম্পরা বজায় রাখলেন তিন গোল খেয়ে। দু’দলের রক্ষণের ব্যর্থতার জন্যই স্বপ্নহীন ম্যাচে পাঁচ-পাঁচটি গোল হল। যা বহুদিন হয়নি ডার্বিতে। উপস্থিত প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার দর্শক দেখলেন, উত্তেজক এবং আগুনে ম্যাচ। যেখানে ধাক্কাধাক্কি, লাল-হলুদ কার্ডের বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও গোলের রংমশাল জ্বলল।
মাত্র এক স্ট্রাইকার নিয়ে খেলে ইস্টবেঙ্গল কোচ দেখালেন, মাঝমাঠ দখলে নিতে পারলে কী ভাবে খাতায় কলমে ফেভারিট দলকে মাথা নত করানো যায়। নতুন আসা হেইমে স্যান্টোস কোলাদোকে তিনি ব্যবহার করলেন পেন্ডুলামের মতো।এক সময় আলেসান্দ্রোর স্পেনের ক্লাব স্পোর্টিং গিঁজোর অ্যাকাডেমিতে খেলতেন কোলাদো। হাতের তালুর মতো চেনেন আদতে উইঙ্গার স্প্যানিশ-ছাত্রকে। প্রথম ডার্বিতে আলেসান্দ্রো তাঁকে ব্যবহার করলেন সাপোর্টিং স্ট্রাইকার হিসাবে। বিরতির আগে পর্যন্ত কোলাদো ঝলকালেন। তখনই ইস্টবেঙ্গল এগোল ২-১ এ। আজহারউদ্দিন মল্লিকের গোলে শুরুতে মোহনবাগান এগিয়ে যাওয়ার পর কোলাদোকে বেশ ঝকঝকে দেখাল। প্রথম দু’টি গোলের পাসের শুরু তো তাঁর পা থেকেই। সেটা ধরেই জবি আর জুনিয়র রালতের যুগলবন্দিতে গোল। সাত জন ফুটবলারকে নিজেদের মাঝমাঠে কার্যত দাঁড় করিয়ে মোহনবাগানের দিপান্দা ডিকা আর হেনরি কিসেক্কার দৌরাত্ম বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছিলেন আলেসান্দ্রো। সেই অভ্কে তিনি সফল। মাঝমাঠ থেকে বলই পাচ্ছিলেন না ডিকা-হেনরিরা। ওঁরা দু’জন বল ধরলেই সামনে চলে আসছিলেন ইস্টবেঙ্গলের অন্তত দু’জন ফুটবলার। বোঝাই যাচ্ছিল, শঙ্করলালের দল নিয়ে হোম ওয়ার্কটা ভালই করেছেন আলেসান্দ্রো।
লাল-হলুদ কোচের চাল ধরতেই পরেননি শঙ্করলাল। তাঁর প্রথম একাদশ নির্বাচনেই ভুল ছিল। গোলে শিল্টন পালের মতো অভিজ্ঞ ফুটবলারকে বসিয়ে রেখেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ডার্বিতে ফের গোল পাওয়ার পরে আজহারউদ্দিন মল্লিক যখন আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছেন, তখনই তাঁকে তুলে নিয়ে শেখ ফৈয়াজকে নামানোটাও বড় ভুল। ভাল একজন বিদেশি ডিফেন্ডার না নিয়ে কর্তাদের কথায় সায় দিয়ে সনি নর্দেকে নেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দেওয়াও মোহনবাগান কোচের বড় ভুল। এই ভুল তাঁকে সারা বছর বয়ে বেড়াতে হবে। ১-০ এগিয়ে যাওয়ার পরও মোহনবাগান গুটিয়ে গেল। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ৫৯ মিনিটে কিংগসলে লাল-কার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়ার পরে দিপান্দা ডিকারা আক্রমণের জন্য ফের ঝাঁপালেন। ৩-১ থেকে ৩-২ তখনই হল। ম্যাচ তখন অবশ্য মোহনবাগানের মুঠো থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
ইস্টবেঙ্গল: রক্ষিত দাগার, লালরাম চুলোভা, বোরখা গোমেস, জনি আকোস্তা, মনোজ মহম্মদ (সামাদ আলি মল্লিক), লালরিনডিকা রালতে, লালডানমাউইয়া রালতে, কাশিম আইদারা, ব্র্যান্ডন ভ্যানলালরেমডিকা (কমলপ্রীত সিংহ), জবি জাস্টিন, হেইমে কোলাডো (সালামরঞ্জন সিংহ)।
মোহনবাগান: শঙ্কর রায়, অরিজিৎ বাগুই, কিংসলে ওবুমনেমে, কিম কিমা, অভিষেক আম্বেকর, আজহারউদ্দিন মল্লিক(শেখ ফৈয়াজ), ইউতা কিনোয়াকি, সৌরভ দাশ, ওমর এলহুসেইনি (গুরজিন্দর কুমার), দিপান্দা ডিকা, হেনরি কিসেক্কা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy