প্রতাপ ঘোষ, অতনু ভট্টাচার্য, অমিত ভদ্র, মানস ভট্টাচার্য, কৃষ্ণেন্দু রায়, সুনির্মল চক্রবর্তীরা দাপিয়েছেন আশির দশকে। তারও আগে শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মঙ্গল পুরকায়স্থ। আর নব্বইয়ের দশকে রঞ্জন দে, প্রশান্ত চক্রবর্তী, অমিত দাস, শান্তি মজুমদাররা। এঁদের সকলেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে উঠে এসে নজর কেড়েছিলেন ভারতীয় ফুটবলে।
সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত ময়দানে চালু রসিকতা ছিল, ট্রেন বন্ধ মানেই কলকাতা লিগে খেলোয়াড় আসা বন্ধ। বাটানগর, বজবজ, বারুইপুর, সোনারপুর, হরিণাভি থেকে দলে দলে ফুটবলার ভিড় জমাতেন কলকাতা ময়দানে ফুটবল খেলার জন্য। সেখান থেকেই উঠে আসা কৃষ্ণেন্দু, অমিতদের।
কিন্তু বর্তমানে সেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে ভারতীয় দলে ফুটবলার কোথায়? শিবরাত্রির সলতের মতো টিমটিম করে জ্বলছেন শুভাশিস বসু। তিনি ছাড়া কলকাতা ময়দানে তিন বড় ক্লাবের ফুটবলার হলেন, মেহতাব হোসেন, সুরাবুদ্দিন মল্লিক, অবিনাশ রুইদাস, লাল্টু মণ্ডলরা। কিন্তু ময়দানের বিভিন্ন ক্লাবের কর্তারা এটা প্রকাশ্যেই বলছেন, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে দলে দলে ফুটবলার আসার সেই ছবি অনেকটাই ফিকে।
এর কারণ কী? প্রাক্তন ফুটবলার কৃষ্ণেন্দু রায় বলছেন, ‘‘আমাদের সময় স্কুলভিত্তিক খেলা হত দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। যেখান থেকে আমরা উঠে এসেছিলাম। এখন তো সেই খেলাগুলোই বন্ধ। ফুটবলার উঠে আসবে কী ভাবে?’’ জাতীয় দলের প্রাক্তন এই রাইটব্যাক আরও বলেন, ‘‘জেলায় একটি মাত্র ফুটবল শিবির চলে নতুন প্রতিভা তুলে আনার জন্য। কিন্তু সেখানে যারা ভাল খেলছে, তাদের জন্য কোনও স্পটার নেই বলেই জানি। জেলার যে লিগ হয়, তা নমো নমো করে চলে। সেখানেও বাইরে থেকে ফুটবলার ভাড়া করে নিয়ে এসে অনেক ক্লাব খেলায়। এর পরে নতুন ছেলে উঠে আসবে কী ভাবে?’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘আগে বাটানগর এলাকায় মাঠের অভাব ছিল না। কিন্তু এখন সেই মাঠগুলো ভরে গিয়েছে কংক্রিটের জঙ্গলে। ফলে একটা মাঠ নিয়ে লড়াই চলে দশটা দলের মধ্যে। খেলোয়াড় হারিয়ে যাওয়ার এটাও একটা বড় কারণ।’’
কৃষ্ণেন্দু, মানস, শান্তিদের বাটানগরের মতোই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ফুটবলের একটা আঁতুরঘর ছিল হরিণাভি, বারুইপুর, সোনারপুর অঞ্চল। যেখান থেকে উঠে এসেছেন প্রশান্ত, রঞ্জন, অমিতরা। সেই প্রশান্ত বলছেন, ‘‘দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এখন ফুটবলের উন্নতি গৌণ। মুখ্য ব্যাপার হল ক্লাব নিয়ে দলাদলি।’’ কৃষ্ণেন্দু রায়ের মতো তিনিও বলেন, ‘‘জেলা লিগ নমো নমো করে একটা হয় বটে, তবে সেখানে বাইরের ছেলেদের ভাড়া করে এনে খেলানো হয়। এটা আগে বন্ধ করতে হবে।’’ বড় দলে খেলা এই ফুটবলারের আক্ষেপ, ‘‘কোচিংয়ে ‘এ’ লাইসেন্স করে বসে আছি। কোনও দিন জেলার তরফে ফুটবলের উৎকর্ষ বাড়ানোর জন্য আলোচনায় ডাকা হয়নি। প্রাক্তন ফুটবলাররা ব্রাত্যই।’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সচিব শ্যামল পাল যদিও তাঁর এলাকায় ফুটবলে আঁধার নেমেছে, এ কথা মানতে নারাজ। তিনি বলছেন, ‘‘আমাদের ফুটবল ঐতিহ্য দুর্দান্ত।’’ কিন্তু বর্তমান? এ বার শুভাশিস বসুর নাম করেই চুপ করে যান তিনি।
পরে বলেন, ‘‘চারটি ডিভিশনে আমাদের জেলা লিগ হয়। সুপার (১০টি দল), এ (১২টি দল), বি (২২টি দল) ও সি (১৫টি দল)। সেখান থেকে অনেকেই কলকাতার ছোট দলগুলিতে খেলছে। এ ছাড়াও আমাদের অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৮ দলের লিগও হয়। সেখান থেকে অনেক ফুটবলার উঠে আসছে।’’ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, জেলা লিগে বাইরের ফুটবলার খেলানো নিয়ে প্রাক্তন ফুটবলারদের অভিযোগের ব্যাপারে। যা তিনি নাকচ করে বলছেন, ‘‘ও সব হয় না।’’
বঙ্গ ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা আইএফএ-তে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রতিনিধি শঙ্কর বসু বলছেন, ‘‘বারুইপুর সাগর সঙ্ঘের মাঠে জেলার একমাত্র আইএফএ অনুমোদিত ফুটবল ক্যাম্পটি চলছে। কিন্তু কোচিং ক্যাম্পে বল ও খেলার অন্য সরঞ্জাম এবং কোচেদের বেতন দেওয়ার কথা আইএফএ-র। কিন্তু তা দু’বছর ধরে বন্ধ। নিজেদের উদ্যোগে চালাচ্ছি। তাই জেলায় কোচিং ক্যাম্প ছড়িয়ে দেওয়ার সামর্থ্য নেই আমাদের। আবাসনগুলো গিলে নিচ্ছে মাঠ। বেশির ভাগ ফুটবলারই আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির। তাই চোট পেলে অনেকেই সঠিক চিকিৎসার অভাবে হারিয়ে যায়। এ জন্যই এই দুরবস্থা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy