বুধবার সকালে আমার হাতে এসে পৌঁছয় কোটলার ম্যাচের পাস। পরিবারের সদস্যদের জন্য। ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফের আত্মীয়-বন্ধুদের জন্য এ রকম পাস ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের কাছ থেকে আমরা পেয়ে থাকি। সাধারণ একটা খামে ভরা পাসগুলো বার করে দেখছিলাম সব ঠিক আছে কি না। পাসের উপর কালো ও মোটা অক্ষরে লেখা ‘এলিমিনেটর’ শব্দটা দেখেই সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেলাম যেন। মনটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। বাকি সব দেখে আবার সেগুলো খামের ভিতর রেখে দিলাম।
ওই ‘এলিমিনেটর’ শব্দটা যেন তার আরও মিনিট খানেক পর পর্যন্ত মনের মধ্যে রয়ে গেল। শব্দটা কি আমার মনের মধ্যে খচখচ করে বিঁধছিল? আমাকে কি উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল শব্দটা? মরণ-বাঁচন ম্যাচ বলে কি আমি চাপে পড়ে যাই? বোধহয় না। হায়দরাবাদকে তো আমরা এই আইপিএলে দু’বারই হারিয়েছি। তৃতীয়বারও যে পারব, সে আত্মবিশ্বাস ছিল। ক্রিকেটীয় এবং অক্রিকেটীয়, দু’রকম যুক্তিই ছিল আমাদের পক্ষে। তার উপর টানা আটবার টস হারার পর এ বার জিতলাম। স্কোরবোর্ডে হায়দরাবাদের পাশে যখন লেখা ৭১-৩, তখন আমার মনে ওই ‘এলিমিনেটর’ শব্দটার যেমন অস্তিত্ব ছিল না, তেমন জয় নিয়েও ভাবছিলাম না। পুরোপুরি বর্তমানেই ছিলাম।
জীবনের মতো খেলার মাঠেও প্রতিটি মুহূর্ত সজাগ থাকতে হয়। মুহূর্তের ভুল বা অসাবধানতায় জীবন বা খেলায় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমরা। যুবরাজকে রান আউট করার সুযোগ নষ্ট করাটা যে ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট, তা বলা যাবে না। কিন্তু ওই একটা ভুলই আমাদের সামনে আরও ২০-২৫ রানের বাড়তি টার্গেট খাড়া করে দেয়। থ্রো-টা ঠিকমতো করতে না পারার জন্য রবিনকে দোষ দেব না। বহুদিন ধরে ক্রিকেট খেলছি বলেই জানি, চাপের মুখে সব অদ্ভূত কাণ্ডকারখানা হয়ে যায়। আমি কেমন আরসিবি ম্যাচে বিরাট কোহালির ক্যাচটা মিস করেছিলাম, মনে নেই? চাপ আর পরফরম্যান্সের পারস্পরিক সম্পর্ক এই ঘটনাগুলো থেকেই বোঝা যায়। তবে ১৬৩ রানটা তোলাই যেত।
হায়দরাবাদের বোলিং আক্রমণ মূলত পেস-নির্ভর। যাতে ওদের মারতে পারে, তাই কলিন মানরোকে নিয়েছিলাম প্রথম এগারোয়। রবিন আউট হয়ে ফিরে যাওয়ার পর তাই ওকে নামানো হয়। মানরোকে বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছিল। কিন্তু অনাবশ্যক রান আউটটাই আমাদের জোর ধাক্কা দেয়। ও নিজেই বিপজ্জনক প্রান্তের দিকে দৌড়নোর কল দেওয়ায় ভাবলাম, নিশ্চয়ই সব কিছু ‘আন্ডার কন্ট্রোল’ ছিল। কিন্তু যুবরাজ সরাসরি থ্রো করে যে ভাবে স্টাম্প ভেঙে দিল, তাতেই সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। তখন থেকেই বোধহয় ম্যাচের মোড় ঘুরতে শুরু করে। মণীশ পাণ্ডে শুরুটা ভাল করলেও অন্য দিকে একের পর এক উইকেট পড়ায় ও নিজেও দমে যায়। আমিও মণীশের প্রতি সুবিচার করিনি। ওই সময় একটা কঠিন পুল শট খেলে উইকেট দিয়ে এসে। আসলে পরপর উইকেট পড়তে দেখাটা খুব বিরক্তিকর একটা অভিজ্ঞতা। লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের বড় শট নিতে না পারাটাও কম বিরক্তিকর নয়।
কেকেআরের একটার পর একটা উইকেট পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাসের উপর লেখা ওই শব্দটা যেন আমার মনের মধ্যে আরও দগদগে হয়ে উঠছিল— ‘এলিমিনেটর’। শেষটা ক্রমশ এগিয়ে আসছিল। আর আমি ক্যাপ্টেন হয়ে কিছুই করতে পারছিলাম না। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম, ২৯ মে। আরসিবি-র বিরুদ্ধে আইপিএল ফাইনাল— এগুলো ক্রমশ অলীক স্বপ্ন হয়ে উঠছিল। তখন কেকেআরের বিদায়, হোটেলে চেক আউট করার পর আবার ক্রিকেটহীন জীবনযাপন— এই ভাবনাগুলোই যেন ক্রমশ মনের মধ্যে চেপে বসছিল।
বিশ্বাস করুন, একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে বাড়িতে বসে টিভিতে তার সতীর্থদের খেলতে দেখাটা ভীষণ কষ্টকর। দুর্ভাগ্যবশত, আমরাই আমাদের এই পরিণতি বেছে নিয়েছি।
আপাতত বিদায়। আরও কিছু নিয়ে পরে আবার আসা যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy