Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ধোনিহীন সাম্রাজ্যের প্রথম রূপকথা

উধাও উৎসব-উল্লাস, ফিরল ঔদ্ধত্য

চোখ দু’টোই বলে দিচ্ছিল, আজ কিছু একটা হবে! সিরিজ জয়ের পুণ্যলগ্নে চ্যাম্পিয়ন অধিনায়কের দৃষ্টিতে কী থাকতে পারে? পরিতৃপ্তি একটা স্বাভাবিক বিশেষণ। শিশুর সারল্যও যদি সেখানে লুকিয়ে থাকে, আশ্চর্যের নয়। টেস্ট-পৃথিবীর এক নম্বর টিমের অহংকে পদানত করার প্রাক্-মুহূর্তে এ সবই অতি ন্যায্য প্রতিক্রিয়া।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
নাগপুর শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

চোখ দু’টোই বলে দিচ্ছিল, আজ কিছু একটা হবে!

সিরিজ জয়ের পুণ্যলগ্নে চ্যাম্পিয়ন অধিনায়কের দৃষ্টিতে কী থাকতে পারে? পরিতৃপ্তি একটা স্বাভাবিক বিশেষণ। শিশুর সারল্যও যদি সেখানে লুকিয়ে থাকে, আশ্চর্যের নয়। টেস্ট-পৃথিবীর এক নম্বর টিমের অহংকে পদানত করার প্রাক্-মুহূর্তে এ সবই অতি ন্যায্য প্রতিক্রিয়া। আর ভারত অধিনায়ক এ সব প্রায়শ করেও থাকেন। শ্রীলঙ্কায় টেস্ট সিরিজ জিতে উঠে জার্সি ছুড়ে দিয়েছিলেন। এখানেও সবাই ধরে রেখেছিল, বিরাট কোহলি নামের আবেগ-রংমশালেই পূর্ণতা পাবে আফ্রিকান সিংহ বধের পদাবলী। নাগপুর দর্শকের দিকে আজ একটা চুমু উড়ে যাবে না? কারও কাঁধে আজ লাফিয়ে তিনি উঠবেন না? এগারো বছর পরে দেশে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ জিতল ভারত, আজ হবে না তো আর কবে হবে? কিন্তু মর্নি মর্কেল যে বলটায় বোল্ড হলেন তার আগেরটা বলে দিল, ও সবের দিন আজ নয়। কলার উঠে আছে। ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যানের’ ঔদ্ধত্যে একবার শ্রাগ করলেন। গ্যালারির দিকে যে চোখ গেল সেখানেও উৎসব-উল্লাসের লেশমাত্র নেই।

পড়ুন: একমাত্র কুম্বলের সঙ্গেই এই অশ্বিনের তুলনা করব

ওটা জ্বলছে। প্রতিহিংসার লোভে।

কাকে খুঁজছিলেন বিরাট? মাইকেল ক্লার্ককে? মাইকেল ভনকে? নাকি ভারতীয় মিডিয়াকে, যারা নাগপুর ম্যাচে টেস্ট রিপোর্ট বাদ দিয়ে পিচ নিয়ে তিন দিন কাটিয়েছে? যে কেউ হতে পারে। শ্রীলঙ্কায় যে ভারত অধিনায়ক সিরিজ জিতে সমবেত মিডিয়াকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন, যে অধিনায়ক সাংবাদিক সম্মেলনে শিশুসুলভ চেয়ার টানাটানিতে হাসির হুল্লোড় তুলেছিলেন, সেই একই লোক শুক্রবার চরম গরগরে মেজাজে। চেয়ার নিয়ে টানাটানি বা বিদেশি সাংবাদিকের দিকে চোখ বড় করে মাথা নাড়ানো দূরের গ্রহ, একবার হাসলেন না পর্যন্ত! অভিনন্দনের উত্তরে শুষ্ক ‘থ্যাঙ্কস’ ছাড়া কিছু এল না। আরসিবি টিমমেট এবি ডে’ভিলিয়ার্সের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্যতা সর্বজনবিদিত। এবি দেশজ জার্সিতে তাঁর টিমের বিরুদ্ধে কিছু করলেও একছুটে পিঠ চাপড়ে দিয়ে আসেন। আর আজ শুক্রবার, ড্রেসিংরুমের টানেলে দুই অসাধারণ প্রতিভার যখন দেখা হল, বিরাট মুচকি হাসি আর হালকা করমর্দনের বেশি গেলেন না। টেস্ট পিচ নিয়ে গত কুড়ি দিন চতুর্দিকের নিরন্তর সমালোচনা তা হলে তাঁকে এতটা ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে?

পড়ুন: জয়ের আগাম সৌরভেও কলঙ্কের ছায়া

বোধহয় দিয়েছে। নইলে কেন বারবার উদ্ধত ফুৎকারে উড়িয়ে দেবেন প্রশ্নের ভেকধারী বিভিন্ন খোঁচাকে? নাম না করে কেন টেনে আনবেন ক্লার্ক-ভনদের, যাঁরা চব্বিশ ঘণ্টা আগে নাগপুর পিচকে কঠোর কুঠারাঘাতে রক্তাক্ত করে ছেড়েছিলেন? কেন শোনাবেন, মিডিয়া কী লিখল না লিখল, কে কী ভাবল না ভাবল, তাতে তাঁর কিছু এসে যায় না। তাঁর টিমও এ সবে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হয় না। মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের নমুনা এ রকম:

গত কাল রাহুল দ্রাবিড় রঞ্জি ম্যাচের দু’দিনে শেষ হয়ে যাওয়াকে ঝেড়েছেন। ভারতীয় টিমেরও কি এটাই এ বার থেকে পলিসি হয়ে গেল? যে দেশ মানেই টার্নার হবে?

পড়ুন: খারাপ কোথায়, আমি তো স্পোর্টিং উইকেট বানিয়েছি

“এটা পলিসি নয়, এটা ভারতের পরিবেশ। আর আমি তো বুঝে পাচ্ছি না পিচ নিয়ে কেন এত হইচই হচ্ছে। দেখছি বিদেশে বসেও ইন্ডিয়ার পিচ নিয়ে লোকে বলছে!”

ভবিষ্যতেও তা হলে এটাই হবে?

“আবারও বলছি, আমাদের দেশের পরিবেশটাই এ রকম। গলে আমাদের ব্যাটিং পারল না। বলা হল, পেস খেলা শিখেছি। কিন্তু স্পিন খেলাটা ভারতীয় ব্যাটিং ভুলে গিয়েছে। এখানে টার্নার হল, আবার সমালোচনা। বুঝেই তো পাচ্ছি না সমস্যাটা কোথায়!”

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

পিচ নিয়ে সমালোচনায় সবাই ভুলতে বসেছে যে আপনি একটা সিরিজ জিতেছেন।

“কিছু যায় আসে না। যদি কারও ইচ্ছে হয়, বলবে। না ইচ্ছে হলে বলবে না। কিন্তু সিরিজ জয়ের কৃতিত্বটা কেউ আমাদের থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”

নাগপুর টেস্টে শুক্রবার বিশেষ কিছু পড়ে ছিল না। দু’টো ব্যাপার নিয়ে আগ্রহ ছিল। এক, দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসের পরিসমাপ্তি কখন ঘটবে? টি সেশনের আগে না পরে? এবি ডে’ভিলিয়ার্স দ্রুত চলে যাওয়ায় ইনিংস শেষ আরও ঘনিয়ে এসেছিল। হাসিম আমলা-ফাফ দু’প্লেসির প্রতিরক্ষার পাথুরে দেওয়ালে সেটা ঘণ্টাদেড়েক পিছিয়ে গেল, এই পর্যন্ত। আসলে তিনশো প্লাস টার্গেট নাগপুর পিচে আদতে ছিল সাড়ে চারশো। আমলা-দু’প্লেসির ২৮১ বলে ৭২ রানের পার্টনারশিপে টার্গেটের তীরে পৌঁছনো সম্ভব ছিল না। দু’জনেই ৩৯ করে গেলেন। আমলা ১৬৭ বলে। দু’প্লেসি ১৫২। বাঁচার যুদ্ধে নেমেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, জিততে নামেনি। বাঁচা সম্ভব ছিল না। যে কোনও সময় শেষ হত, হয়েওছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ নিঃশ্বাসের কাউন্টডাউনের চেয়েও এ দিন দ্বিতীয় আগ্রহটা বেশি আকর্ষণীয় ছিল। নাগপুর পিচ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাওয়ার পরে এই প্রথম তিনি মিডিয়ার সামনে আসবেন। ভারতীয় টেস্ট অধিনায়ক কী বলতে পারেন?

পড়ুন: ঘরের মাঠ বলে এত খারাপ পিচ বানাতে হবে

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সঞ্জয় মঞ্জরেকরকে দেওয়া উত্তরে মুখড়াটা ছিল। পিচ নিয়ে প্রশ্ন সঞ্জয়ও করেছিলেন। বিরাট তাঁকে বলে গেলেন যে, তিনি মনে করেন নাগপুর উইকেট চ্যালেঞ্জিং ছিল। যেখানে ব্যাটসম্যানকে নিজের প্রয়োগ-ক্ষমতা দেখাতে হত। যার পর সাংবাদিক সম্মেলন এবং মুহূর্মুহূ কার্পেট বম্বিং। কষ্ট হবে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের জন্য। প্রথম ইনিংসের পাঁচ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসে সাত-সাতটা তুললেন। ভারতীয় স্পিনের চন্দ্র-রবি-গ্রহ-তারা সব এখন তামিলনাড়ু অফস্পিনার। নতুন বলেও যিনি স্পিনে উইকেট নেওয়ার দুর্লভ ক্ষমতার অধীশ্বর। এগারো বছর আগের হরভজন সিংহ হয়ে উঠে এ দিন তিনি ভারতকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জেতালেন। কাকতালীয় ভাবে সে দিনও ইডেনে গ্রেম স্মিথের দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হরভজনের দ্বিতীয় ইনিংসের উইকেটসংখ্যা ছিল সাত। শুক্রবার একমেবদ্বিতীয়ম তাঁরই প্রচারের রাজসিংহাসনে বসার কথা। কিন্তু হল না।

কী ভাবে সম্ভব? কোহলি তো ততক্ষণে বলে গিয়েছেন, “বিদেশে বসে যে যা ইচ্ছে বলতেই পারে। সেটা তাদের মাইন্ডসেট। তাদের সেই স্বাধীনতাও আছে। কিন্তু আমরা সে ভাবে ভাবি না। আমাদেরও তো কম চ্যালেঞ্জিং কন্ডিশনে পড়তে হয়নি। কিন্তু কখনও সে সব নিয়ে আমরা অভিযোগ করিনি। ভবিষ্যতেও করব না।” কোহলি তো আরও যোগ করে গিয়েছেন, “আমরা তার বদলে বিদেশে নিজেদের খেলাটাকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করব। বিদেশে সব সময় ব্যাপারটা টেকনিক আর মানসিক দাঁড়ায়। কিন্তু এখানেই দেখি সেটা না হলে লোকে বলতে থাকে, ঘরের মাঠের অন্যায় সুবিধে নেওয়া চলছে!”

এক সাংবাদিক কোহলিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্পিনাররা প্রচুর উইকেট তুলছেন ঠিক। কিন্তু ব্যাটিং তো এ রকম পিচে আক্রান্ত হচ্ছে। কুৎসিত দেখাচ্ছে। শুনে রীতিমতো চটে গেলেন কোহলি। বলে দিলেন, “শুনুন, আমি মনে করি না আমাদের ব্যাটিং কুৎসিত হয়েছে। প্রথমেই বলি, শব্দ হিসেবে এটা অত্যন্ত রূঢ়। আর একটা কথা। নিজের অ্যাভারেজ নিয়ে ভাবে না টিম। টিমের জয়ের জন্য যদি নিজের ব্যাটিং অ্যাভারেজ কমে, আমার কোনও অসুবিধে নেই। আমরা জিততে নামি। নিজেদের অ্যাভারেজ বাড়াতে নয়!” বিকেলে দেখা গেল, সব মিটিয়ে ভারতীয় টিম আবার মাঠে। ফুটবল চলছে। অধিনায়ক পাশে দাঁড়িয়ে কাকে ফোন করে চলেছেন। একটু পর নিজেও ঢুকলেন। এবং প্রথম বলটাই মাঠের ও দিকে উড়ে গেল। সজোর পদাঘাতে।

দিনের প্রেক্ষিতে বড় প্রতীকী দৃশ্য, তাই না?

ভারত
প্রথম ইনিংস: ২১৫।

দক্ষিণ আফ্রিকা
প্রথম ইনিংস: ৭৯।

ভারত
দ্বিতীয় ইনিংস: ১৭৩।

দক্ষিণ আফ্রিকা
দ্বিতীয় ইনিংস
(আগের দিন ৩২-২)

এলগার এলবিডব্লিউ অশ্বিন ১৮

আমলা ক কোহলি বো মিশ্র ৩৯

ডে’ভিলিয়ার্স এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৯

দু’প্লেসি বো মিশ্র ৩৯

দুমিনি এলবিডব্লিউ অশ্বিন ১৯

ভিলাস ক ঋদ্ধিমান বো অশ্বিন ১২

হার্মার ন.আ. ৮

রাবাদা ক কোহলি বো অশ্বিন ৬

মর্কেল বো অশ্বিন ৪

অতিরিক্ত ১৮

মোট ১৮৫।

পতন: ১৭, ২৯, ৪০, ৫৮, ১৩০, ১৩৫, ১৬৪, ১৬৭, ১৭৭।

বোলিং: ইশান্ত ১৫-৬-২০-০, অশ্বিন ২৯.৫-৭-৬৬-৭,

জাডেজা ২৫-১২-৩৪-০, মিশ্র ২০-২-৫১-৩।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Virat Kohli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE