Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাসে রজতকন্যা, ফাইনালে সিন্ধু

ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে পড়ল সবুজ কোর্টে। নেটের উল্টো দিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীও তখন সোনা জয়ের উল্লাসে চিৎকার করতে করতে শুয়ে পড়েছেন। কাঁদছেন। তবু রিওসেন্ট্রোর ফ্লাডলাইটের আলোয় কী উজ্জ্বলই না লাগছিল হলুদ টিউনিকের শ্যামলা চেহারাটাকে।

গর্বের রুপো। পদক হাতে পাওয়ার পর সিন্ধু। শুক্রবার রিওয়। ছবি: রয়টার্স।

গর্বের রুপো। পদক হাতে পাওয়ার পর সিন্ধু। শুক্রবার রিওয়। ছবি: রয়টার্স।

রতন চক্রবর্তী
রিও দে জেনেইরো শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৫৮
Share: Save:

কোটি কোটি হৃৎস্পন্দন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ওই একটা মুহূর্তে।

ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে পড়ল সবুজ কোর্টে। নেটের উল্টো দিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীও তখন সোনা জয়ের উল্লাসে চিৎকার করতে করতে শুয়ে পড়েছেন। কাঁদছেন। তবু রিওসেন্ট্রোর ফ্লাডলাইটের আলোয় কী উজ্জ্বলই না লাগছিল হলুদ টিউনিকের শ্যামলা চেহারাটাকে।

কোর্টে ঢুকে এলেন কোচ পুল্লেলা গোপীচন্দ। মাটি থেকে তুলে জড়িয়ে ধরলেন ছাত্রীকে। যেন বাবা সান্ত্বনা দিচ্ছেন মেয়েকে। চোখের কোণটা একটু যেন চিকচিক করছে হায়দরাবাদের নতুন মহাতারকার। পুসারালা বেঙ্কট সিন্ধু কি কাঁদছেন?

কেন কাঁদবেন তিনি? সোনা জিততে পারেননি। কিন্তু হৃদয় জিতেছেন। চেষ্টায়, পরিশ্রমে, নাছোড় লড়াইয়ে। গোটা একটা দেশের স্বপ্নের ভার কাঁধে নিয়ে রিওয় এঁকেছেন অভূতপূর্ব এক রুপোলি রেখা। তিনিই তো ভারতের প্রথম মেয়ে, যিনি রুপো আনলেন অলিম্পিক্সের আসর থেকে। সারা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানাচ্ছে তাঁকে। বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড়, স্পেনের ক্যারোলিনা মারিনের বিরুদ্ধে সিন্ধুর চোখ ধাঁধানো যুদ্ধের সাক্ষী থাকতে পেরে সবাই আপ্লুত!

আজ কারা এসেছিলেন সিন্ধুর গলায় সোনার পদক দেখতে? কোচ-সহ পুরো ভারতীয় হকি দল। অ্যাথলেটিক্সের টিন্টু লুকা থেকে ললিতা বাবর। খেলোয়াড়দের কথা বাদ দিলাম, এই বিপুল সংখ্যক ভারতীয় আমজনতা ব্রাজিলের কোথায় থাকেন? সিন্ধু এক-একটা পয়েন্ট জেতার পর যাঁরা মেক্সিকান ওয়েভ তুললেন গ্যালারিতে। শুধু আনন্দ নয়, এই দৃশ্য দেখে সম্ভ্রমেও ভরে ওঠে মন!

ভলিবলের ‘অর্জুন’ রামান্নার মেয়ে বরাবরই চাপা স্বভাবের। রোগাটে চেহারা। কিন্তু জেদ বোঝা যায় কোর্টে নামলে। যেমন বোঝা গেল আজও। দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ক্যারোলিনার সঙ্গে তাঁর যে লড়াইকে কেউ কেউ বলছিলেন ‘একতরফা’, সেটাই জমিয়ে দিলেন সিন্ধু! প্রথম গেমটা পিছিয়ে থাকতে থাকতে একেবারে শেষ পর্বে এসে ১৯-১৯ থেকে ২১-১৯ জিতে নিলেন।

পরের গেমটা অবশ্য বাঁ হাতি ক্যারোলিনা প্রায় দাঁড়াতেই দেননি সিন্ধুকে। স্পেনের তারকা সেটা জিতলেন ২১-১২। কিন্তু ফাইনাল গেমে গোপীচন্দের ছাত্রী আবার অন্য চেহারায়। মাথা ঠান্ডা রেখে শরীরের মধ্যে কী ভাবে বারুদ জ্বালাতে হয়, সেটা তো ছাত্রীকে তাঁর অ্যাকাডেমিতে প্রতিদিন শিখিয়ে এসেছেন ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের এ যুগের ভগীরথ। অলিম্পিক্সের একটা রুপো, একটা ব্রোঞ্জ এ দেশের কোন কোচের জোড়া ছাত্রীর আছে? নেই। কারও নেই। সিন্ধু ও সাইনা নেহওয়াল— পরপর দু’টো অলিম্পিক্সে দু’টো পদকের আশেপাশে কেউ নেই।

সে কথা থাক। বরং বলি, তৃতীয় গেমে ক্যারোলিনার সঙ্গে বিশ্ব ব্যাডমিন্টনে ব্রোঞ্জ জিতে আসা সিন্ধুর লড়াইয়ের রূপকথা। ওই গেমটা সিন্ধু যে শেষ পর্যন্ত ১৫-২১ হারলেন, সেটা নিছক পরিসংখ্যান। অঙ্ক বলবে না, চূড়ান্ত গেমেও পিছিয়ে পড়তে পড়তে কী ভাবে বারবার ম্যাচে ফিরে এলেন সিন্ধু। আসলে মেয়েদের সিঙ্গলসের ৮৩ মিনিটের ফাইনালটা এত উপভোগ্য হল যে, অ্যাড্রেস সিস্টেমেও বারবার বলা হচ্ছিল, ‘‘অসাধারণ লড়াই।’’ শুরু থেকেই কখনও শাট্লকক বদলের দাবিতে, কখনও ‘কোর্ট নোংরা হয়েছে, পা পিছলে যাচ্ছে’ বলে রেফারির উপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন ক্যারোলিনা। যা দেখে সিন্ধুও পাল্টা চাপ তৈরি করতে থাকেন। তৃতীয় সেটে ১০-১০ হওয়ার পর সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, আম্পায়ার অন্তত তিন বার দু’জনকে সতর্ক করেন। সিন্ধু পরে বলছিলেন, ‘‘ওটা আমাদের খেলায় হয়। ট্যাকটিক্সের অঙ্গ বলতে পারেন।’’

ঠিক তখনই চোখে ভাসতে থাকে আরও একটা ছবি। ম্যাচ শেষের পর মাটিতে পড়ে কাঁদছেন ক্যারোলিনা। সিন্ধু তত ক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ক্যারোলিনার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। তুলে নিলেন সোনাজয়ীর র‌্যাকেটটা। পরম মমতায় ক্যারোলিনা জড়িয়ে ধরলেন সিন্ধুকে। হায়দরাবাদ-কন্যা হৃদয় জয় করেছেন বলছিলাম। আসলে ওই এক মুহূর্তে শুধু নিজের দেশের নয়, সারা বিশ্বের হৃদয়েও যেন পাকাপাকি জায়গা করে নিলেন সিন্ধু। অসাধারণ খেলোয়াড়োচিত আচরণে।

লড়াই শেষ... ফাইনালের পর সিন্ধু ও মারিন। ছবি: এএফপি।

প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়েও কী অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল তিনি! ‘‘ও যোগ্য হিসেবেই জিতেছে।’’— বললেন সিন্ধু। ‘‘ফাইনালে তো কেউ হারে, কেউ জেতে। আমি আজ হেরেছি। টুর্নামেন্টে প্রথম বার। সেমিফাইনাল যখন উঠেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম ব্রোঞ্জের জন্য লড়তে নামছি। আজ যখন নামলাম, তখন সোনাটা জিততে চেয়েছিলাম। হয়নি, ঠিক আছে। কোনও দুঃখ নেই। আরও এক ঝাঁক ভাল ছেলেমেয়ে স্যারের অ্যাকাডেমিতে উঠে আসছে। গত বার এক জন ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন। আমি রুপো পেলাম। ব্যাডমিন্টন তো এগোচ্ছে।’’

পদক কাকে উৎসর্গ করছেন? এক মুহূর্ত সময় নিলেন না ভাবার। বললেন, ‘‘কোচ। উনি ছাড়া এই মঞ্চে আমি আসতেই পারতাম না।’’ কথাটা খারাপ বলেননি সিন্ধু। ছাত্রী যখন ভিকট্রি স্ট্যান্ডে, তখন পদক পাওয়া থেকে জাতীয় পতাকা ওঠা— সবই নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তুলে রাখছিলেন গোপীচন্দ। প্রচণ্ড তৃপ্তি নিয়ে। সেখানেও অবশ্য নির্দেশ দিচ্ছিলেন ছাত্রীকে। পদক এবং ম্যাসকট নিয়ে কেমন একটা নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন সিন্ধু। গোপী তাঁকে ইশারা করলেন পদকে চুমু খেতে। তার পর অভিবাদন জানাতে বললেন সমর্থকদের।

আর তা করার সময়েই সিন্ধুর গায়ে কে যেন জড়িয়ে দিল একটা তেরঙ্গা পতাকা। ওই পতাকা নিয়েই সিন্ধু হাঁটতে শুরু করলেন মিক্স়ড জোনের দিকে। যেখানে কয়েকশো বুম আর ক্যামেরা তাক করে রয়েছে তাঁর দিকে। রুপো জয়ের ‘সিন্ধু সভ্যতা’র গল্প শুনবে বলে।

সত্যিই অলিম্পিক্স দুনিয়ার সেরা শো। যেখানে ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ চলে না। জুড়ে থাকে কত দিনের ধৈর্য, পরিশ্রম, প্রতীক্ষার গল্প। ভাললাগার সব কিছুকে বিসর্জন দেওয়ার গল্প। ওই একটা পদকের জন্য। ফাইনালের পরে গোপীচন্দ বলছিলেন, ‘‘তিন মাস ধরে আমার ছাত্রীর কাছে ওর ফোনটা নেই। সেটা এ বার ওকে ফেরত দেব। মিষ্টি দই, আইসক্রিম খেতে দেব। যা যা ও এত দিন করতে পারেনি, এ বার সেগুলো সব করতে দেব। ম্যাচ শেষের পরেই ওকে বলেছি, ভেবো না তুমি হেরেছ। তুমিই তো আসলে জিতলে!’’

ধন্য সিন্ধু। ধন্য গোপীচন্দ। ধন্য অলিম্পিক্স সভ্যতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rio Olympics PV Sindhu Badminton
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE