Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

সৌরভই সিএবি-র প্রেসিডেন্ট, বিতর্ক উস্কে ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর

জগমোহন ডালমিয়া বরাবর চেয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতারা যেন কখনও ক্রিকেট প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ না করেন। বিসিসিআই বা সিএবি-তে তাঁর যখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ, তখনও কোনও রাজনৈতিক নেতাকে নিজের শিবিরের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাননি। এমনকী তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অরুণ জেটলিকেও নয়। তাঁর নীতিই ছিল— রাজনীতি ঢুকতে দিও না খেলার প্রশাসনে।

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জগমোহন-পুত্র অভিষেক, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। বৃহস্পতিবার দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জগমোহন-পুত্র অভিষেক, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। বৃহস্পতিবার দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৬
Share: Save:

জগমোহন ডালমিয়া বরাবর চেয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতারা যেন কখনও ক্রিকেট প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ না করেন। বিসিসিআই বা সিএবি-তে তাঁর যখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ, তখনও কোনও রাজনৈতিক নেতাকে নিজের শিবিরের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাননি।

এমনকী তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অরুণ জেটলিকেও নয়। তাঁর নীতিই ছিল— রাজনীতি ঢুকতে দিও না খেলার প্রশাসনে।

ডালমিয়ার মৃত্যুর ছিয়ানব্বই ঘণ্টার মধ্যেই উড়ে গেল তাঁর প্রশাসন নীতি। যখন নবান্ন থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হল, বাংলার ক্রিকেট প্রশাসন এ বার থেকে কারা চালাবেন।

বৃহস্পতিবার সন্ধে ৭টা নাগাদ নবান্নে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করে দেন যে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নতুন সিএবি প্রেসিডেন্ট। ডালমিয়া-পুত্র অভিষেক নতুন যুগ্মসচিব। যুক্তি দেন, ক্রিকেট প্রশাসন তিনি না বুঝলেও মনে
করেন, এমন সঙ্কটের সময় সিএবির পাশে তাঁর দাঁড়ানো উচিত। ‘‘সৌরভ ভারত অধিনায়ক ছিল। এক জন ক্যাপ্টেন যদি প্রশাসনে কাজ করার সুযোগ পায়, সেটা ভাল হবে,’’ বলে দেন মমতা।

এই ঘোষণার পরেই ক্রীড়া থেকে রাজনৈতিক মহল— নানা জায়গায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, সিএবি প্রেসিডেন্টের নাম কী করে ঘোষণা করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী? কী করে সর্বসমক্ষে বলে দিতে পারেন, কে কোন পদে আসবেন? মুখ্যমন্ত্রীর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘আমি কোনও বিতর্কে যেতে চাই না। এটা ওদের সিদ্ধান্ত। এটা সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছে। আমার এই ঘোষণা করা সাজে না। কিন্তু ওরা সবাই অনুরোধ করেছে। সবার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে জগমোহনদার টিমটা চাইছে এ বার সৌরভই হোক। ওর সঙ্গে অভিষেক, বিশ্বরূপ সবাই মিলে একটা সেট আপ তৈরি করুক।’’

কিন্তু তার পরেও বিতর্ক থামছে না। বিজেপি প্রশ্ন তুলছে। সিপিএম তুলছে। কংগ্রেস তুলছে। মমতার ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ফেসবুকে লিখে ফেলতে দেখা যায়, ‘আমি জানতে চাই একটা স্বশাসিত (অটোনোমাস) সংস্থার প্রেসিডেন্টের নাম কী করে মমতা দিদি ঘোষণা করে দিলেন? সেই এক্তিয়ার কি ওঁর আছে? এটা কি তা হলে আরও একটা হীরক রাজার দেশ?’ পরে আনন্দবাজারের তরফে আসানসোলে বাবুলকে যোগাযোগ করা হলে ফের একই কথা বললেন। প্রশ্ন তুললেন, নবান্নে দাঁড়িয়ে কী করে এমন ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী? সৌরভ-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য প্রেসিডেন্ট পদে সৌরভের ‘আগমন’কে স্বাগত জানালেন। কিন্তু সঙ্গে এটাও বললেন, ‘‘সিএবির নতুন প্রেসিডেন্ট ঠিক হওয়ার খবর নবান্নে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী কেন বলতে যাবেন? তা হলে তো এর পরে বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী!’’ কংগ্রেসও ছাড়ছে না। বর্ষীয়ান বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলছেন, ‘‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে দিন প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে লড়তে নামিয়েছিলেন, সে দিন আমরা তাঁর সমালোচনা করেছিলাম। আমার মতে সৌরভকে সিএবির প্রতিনিধিরা নির্বাচন করলেই ঠিক হতো।’’

সময়ের পরিহাসে এক সময় যে অবস্থায় পড়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে মমতা। বুদ্ধদেবের আমলে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই বিখ্যাত নির্বাচনী লড়াইয়ে ডালমিয়া শেষ পর্যন্ত জেতার পর বহু ক্রীড়া প্রশাসক তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘আপনি আমাদের হয়ে যুদ্ধটা জিতলেন।’’ সিএবি প্রশাসনে বুদ্ধদেবের হস্তক্ষেপ নিয়ে তখন তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা।

আজ মমতার প্রশাসন। আজ কড়া প্রশ্নের গতিমুখ মমতার দিকে। রাজনৈতিক মহল তো বটেই, বাংলার ক্রিকেট মহলের একটা অংশেও প্রশ্ন উঠছে— সিএবির সঙ্কট সিএবি নিজেই মেটাতে পারল না কেন? কেন সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ লাগবে? কেন সিএবি প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করতে হবে মুখ্যমন্ত্রীকে?

সৌরভ সব শুনেটুনে এ দিন ক্লাব হাউসের বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘আমি তো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাইনি। উনিই প্রথমে বিশ্বরূপ, বাবলুদাদের (সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়) ফোন করে বলেছিলেন— সিএবিটা ভাল করে চালান।’’ সঙ্গে মমতা-ঘোষিত সিএবির নতুন ঘোষিত প্রেসিডেন্টের সংযোজন, ‘‘সিএবির সমস্যা সিএবির মধ্যেই মিটেছে। সিএবি কর্তারাই চেয়েছেন যে, আমি প্রেসিডেন্ট হই।’’

এ দিন অবশ্য মমতার সঙ্গে দেখা করতে সৌরভ ও অভিষেকের পাশাপাশি সিএবির কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে এবং যুগ্মসচিব সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ও নবান্নে গিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে বৈঠকের শুরুতেই নাকি মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে, বাংলা ক্রিকেটের স্বার্থে তাঁর মনে হয় সৌরভকে প্রেসিডেন্ট করা উচিত। আর ক্রিকেটের প্রতি যখন জগমোহন ডালমিয়ার এত অবদান, সেটা মাথায় রেখে তাঁর পুত্রকেও প্রশাসনে গুরুদায়িত্বে আনা উচিত। এর পর মুখ্যমন্ত্রী অন্যদের কাছে জানতে চান, তাঁদের অভিমত কী? এটাও নাকি জানতে চাওয়া হয়, তাঁদের কারও সিএবি প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনও ইচ্ছে আছে কি না। বলা বাহুল্য, সে প্রশ্নে কেউ হ্যাঁ বলেননি। বরং কেউ কেউ বলেন যে, ডালমিয়ার দেখানো পথে তাঁরা প্রশাসনিক জীবন শুরু করেছিলেন। তাই কাজটাই মুখ্য, পদটা নয়। এর পরে বিশ্বরূপকে বলা হয়, ‘আপনি অন্য যুগ্মসচিব হয়ে যান।’ গত কাল রাতে এমনই প্যানেল ছিল মমতার সামনে। যেখানে বিশ্বরূপ হবেন অন্য যুগ্মসচিব। আর সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে যাবেন কোষাধ্যক্ষ। এই মডেল সযত্নে এড়িয়ে যান বিশ্বরূপ-সুবীর। বলে দেন, তাঁরা যে পদে আছেন তাতেই থাকতে চান।

ঘটনা হল, এ দিন নবান্নে শুধু সরকারি ঘোষণাটাই হয়েছে। পুরো কাঠামোটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল বুধবার রাতে। মমতা তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে ফোন করে সৌরভকে প্রেসি়ডেন্ট করার ব্যাপারটা বাজিয়ে নিয়েছিলেন। কেন সৌরভ— কেউ কেউ জানতে চাইলে মমতা বলে দেন যে, তিনি তো কোনও আমলাকে সিএবি প্রেসিডেন্ট করার কথা বলছেন না। তা হলে অসুবিধে কোথায়? কেন সমালোচনা হবে? বৃহস্পতিবার রাতের দিকে শোনা গেল, মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে সৌরভের নাম খুলে-আম ঘোষণা করেছেন, তা তৃণমূলেরই কোনও কোনও অংশের ভাল লাগেনি। কিন্তু ‘অফিশিয়ালি’ কেউ মুখ খুলতে নারাজ।

ঠিক যেমন সরকারি ভাবে এখনও বলা সম্ভব নয় যে, সৌরভই আজকের পর সিএবি প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। সংস্থার গঠনতন্ত্র ধরলে ডালমিয়ার মৃত্যুর ষাট দিনের মধ্যে বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে প্রেসিডেন্ট পদে অনুমোদন করাতে হবে সৌরভের নাম। টেকনিক্যালি সেখানে বিপক্ষে কেউ দাঁড়ালে এখনও নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু রাত পর্যন্ত যা খবর, সে সম্ভাবনা প্রায় নেই। ময়দানের অনেকেরই মনে হচ্ছে, আগামী জুলাই পর্যন্ত এই সেট আপই থাকছে। সৌরভই প্রেসিডেন্ট থাকবেন। কিন্তু তার পর কী হবে, বলা কঠিন। কারণ সিএবির অনেকেই আছেন, যাঁরা প্রেসিডেন্ট হতে ইচ্ছুক।

একই নিয়ম মেনে অভিষেক ডালমিয়াকেও সিএবির জেনারেল বডির সমর্থন পেতে হবে। তার পর তিনি সরকারি ভাবে যুগ্মসচিব হতে পারবেন। মনে করা হচ্ছে, সেটা হতে তাঁর সমস্যা হবে না। বরং অভিষেক বাংলার ক্রিকেট প্রশাসনে আসায় অনেকে খুশি। এমনকী সর্বভারতীয় ক্রিকেট কর্তারাও এ দিন সচিব পদে অভিষেকের অভিষেক দেখে বলাবলি করেছেন যে, সিএবিতে ডালমিয়া-পুত্রের দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে অসুবিধে হবে না। বরং তিনিই হতে পারেন বঙ্গ ক্রিকেটের নতুন ‘এক্স ফ্যাক্টর।’

আর সৌরভ?

ছিয়ানব্বইয়ের জুলাইয়ে লর্ডসের পিচে জন্ম হয়েছিল ক্রিকেটার সৌরভের। প্রায় কুড়ি বছর পরের এক সেপ্টেম্বরে ক্রিকেট-পৃথিবী তাঁর আরও একটা জন্ম দেখল। এ বার বঙ্গ ক্রিকেটের সর্বেসর্বার সিংহাসনে। শুধু নতুন পিচে গার্ড নেওয়ার দিনে ‘রাজনীতি’ নামক বিতর্কের বলটা তাঁর দিকে ছুটে না এলেই বোধহয় ভাল হতো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE