Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

মইনের ঘূর্ণিতে ভারতের ব্যাটিং বিপর্যয়, কোহালি আউট তো ভারতও আউট!

ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া তো অনেক দূরের গ্রহ। শেষ পর্যন্ত অজিত ওয়াড়েকরের ১৯৭১-এর ভারত, কপিল দেবের ১৯৮৬-র ভারত বা রাহুল দ্রাবিড়ের ভারতও হওয়া হল না কোহালির দলের।

হর্ষ-বিষাদ: সেই মইনই ধস নামিয়ে দিলেন ভারতের ব্যাটিংয়ে। চতুর্থ টেস্টে দুরন্ত লড়াই করেও দলকে জেতাতে পারলেন না কোহালি। ছবি: রয়টার্স।

হর্ষ-বিষাদ: সেই মইনই ধস নামিয়ে দিলেন ভারতের ব্যাটিংয়ে। চতুর্থ টেস্টে দুরন্ত লড়াই করেও দলকে জেতাতে পারলেন না কোহালি। ছবি: রয়টার্স।

সুমিত ঘোষ
সাউদাম্পটন শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:০২
Share: Save:

ওভালে আর কোনও দুরন্ত টেস্ট ফাইনাল হবে না। কোনও ডন ব্র্যাডম্যানের দলের ইতিহাসকে ছোঁয়ার জন্য দৌড়বেন না ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি।

পাঁচ টেস্টের সিরিজের নিষ্পত্তি হয়ে গেল সাউদাম্পটনেই। টাইটানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল যে শহর থেকে। ঐতিহাসিক জাহাজ যাত্রা শুরু করে আর ফিরে আসেনি। কোহালি এবং ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের ইতিহাস তৈরির স্বপ্নও এখানেই তলিয়ে গেল।

ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া তো অনেক দূরের গ্রহ। শেষ পর্যন্ত অজিত ওয়াড়েকরের ১৯৭১-এর ভারত, কপিল দেবের ১৯৮৬-র ভারত বা রাহুল দ্রাবিড়ের ভারতও হওয়া হল না কোহালির দলের। মোট তিন বার ইংল্যান্ড থেকে সিরিজ জিতে ফিরেছে ভারত। সেই তিন বার অধিনায়ক ছিলেন এঁরা।

চা বিরতির পরে ধস

• চা বিরতির সময় স্কোর ছিল ৫৩ ওভারে ১২৬-৪।

• চা বিরতির পরে ৫৩.৩ ওভার। আউট হার্দিক পাণ্ড্য। স্টোকসের লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাটের কানা ছোঁয়ান তিনি। স্লিপে ক্যাচ ধরেন জো রুট।

• ৫৮.৪ ওভার। আউট ঋষভ পন্থ। মইন আলির অফস্টাম্পের বাইরের বলে চালিয়ে খেলতে গিয়ে তুলে দেন। শটে জোর ছিল না। ডিপ কভারে ক্যাচ ধরেন অ্যালেস্টেয়ার কুক।

• ৬০.৫ ওভার। আউট অজিঙ্ক রাহানে। ক্রিজ থেকে কিছুটা ভিতরে স্টান্স নিয়েছিলেন রাহানে। মইনের ডেলিভারি দ্রুত অনেকটা স্পিন করে তাঁর প্যাডে লাগে। পরিষ্কার এলবিডব্লিউ।

• ৬১.৫ ওভার। আউট ইশান্ত শর্মা। বেন স্টোকসের বলে শাফল করে অ্যাক্রস খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ।

• ৬৪.২ ওভার। আউট মহম্মদ শামি। বোলার মইনের মাথার উপর থেকে তুলতে গিয়ে লং অনে ক্যাচ অ্যান্ডারসনকে।

• ৬৯.৪ ওভার। আউট আর অশ্বিন। স্যাম কারেনের ডেলিভারি পিচে পড়ে নিচু হয়ে আসে। অ্যাক্রস খেলতে যান অশ্বিন। বল প্যাডে লেগে এলবিডব্লিউ।

এমনিতেই শেষ ইনিংসে দু’শোর উপরে রান তাড়া করার ক্ষেত্রে আতঙ্কের সব পরিসংখ্যান রয়েছে ভারতের নামের পাশে। একটা হিসেব শনিবার থেকেই সকলের হাতে হাতে ঘুরছিল ভারতীয় পরিসংখ্যানবিদদের মারফত। এশিয়ার বাইরে এর আগে মোট ৬১ বার দু’শোর উপরে টার্গেট হাতে পেয়ে ভারত জিতেছে মাত্র তিন বার। হেরেছে ছত্রিশ বার। সেই সংখ্যাটা সাঁইত্রিশ হয়ে গেল রবিবার।

সফল রান তাড়া করা তিনটি ম্যাচের শেষটি ২০০৩-০৪ মরসুমে অ্যাডিলেডে। তার মানে শেষ সাফল্য এসেছে প্রায় পনেরো বছর আগে। অন্য দু’টি আরও অনেক আগে। ১৯৬৭-৬৮ মরসুমে নিউজিল্যান্ডে এবং ১৯৭৫-৭৬ মরসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পোর্ট অব স্পেনে। যেখানে চারশোর উপরে রান তাড়া করে সেই ঐতিহাসিক জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল ভারত। সাউদাম্পটনে সে রকম কোনও ইতিহাস আর লেখা হল না।

ভারতীয়দের সব চেয়ে খোঁচা দেবে যেটা তা হচ্ছে, অনেকটা নিজের দেশের মতো পরিবেশ, পিচে হারিয়ে দিয়ে গেলেন এক স্পিনার। যিনি এই সিরিজে এই প্রথম টেস্ট দলে সুযোগ পেলেন। তা-ও অনেক তর্ক-বিতর্কের পরে। তাঁর নাম মইন আলি। চার বছর আগে এ মাঠেই দ্বিতীয় ইনিংসে ছয় উইকেট নিয়ে মইন ধ্বংস করে দিয়েছিলেন ধোনির ভারতকে। এ বার কোহালির ভারতকেও ভাঙলেন তিনি। ম্যাচ থেকে ৯ উইকেট এবং প্রথম ইনিংসে প্রবল চাপের মুখে ৪০ রানের লড়াকু ইনিংস— ম্যাচের সেরা হিসেবে অন্য কারও নাম ভাবার উপায় ছিল না।

সেই সঙ্গে বিতর্কের ঝড় উঠতে বাধ্য অশ্বিনের নির্বাচন নিয়ে। কমেন্ট্রিতেও বার বার বিশেষজ্ঞরা তা নিয়ে আলোচনা করলেন। অশ্বিনকে ম্যাচের আগের দিনও নেট প্র্যাক্টিসে দেখে পুরোপুরি ফিট মনে হয়নি। টেস্টের তিন দিন আগে সাউদাম্পটনে প্রথম প্র্যাক্টিসে এসে কথা উঠেছিল, অশ্বিনের বদলে রবীন্দ্র জাডেজাকে খেলানো হবে। সেই মতো জাডেজাকে তৈরিও করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন অশ্বিনকে খেলানো হল, তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তৈরি হয়ে যেতে পারে এ বার।

মইন আলি যে পিচে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিলেন, সেখানে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে অশ্বিনের মাত্র একটা উইকেট পাওয়া জোরাল ধাক্কা দিয়ে গেল ভারতের সম্ভাবনায়। তাঁকে দেখে কখনও মনেই হয়নি সম্পূর্ণ ছন্দে রয়েছেন। এটা ঠিক যে, সাউদাম্পটনে টেস্ট হারার জন্য একা অশ্বিনই দায়ী নন। আরও অনেক কারণ রয়েছে। যেমন ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৮৬-৬ হয়ে যাওয়ার পরেও ২৪৬ তোলে। স্যাম কারেনদের লড়াইয়ের পরে ভারতের টেলএন্ডাররা উইকেট বিসর্জন দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু অশ্বিনের জন্য খুবই খারাপ বিজ্ঞাপন হয়ে থাকল সাউদাম্পটন টেস্ট কারণ পিচে ভাল রকম ক্ষত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মইন আলি সেই ‘রাফ’ ব্যবহার করে ভারতকে হারিয়ে দিয়ে গেলেন। অশ্বিনের মতো স্পিনার সেখানে কোনও প্রভাবই সৃষ্টি করতে পারলেন না। যা উপমহাদেশের বাইরে তাঁর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে ফের।

রবিবার মইনই মোক্ষম আঘাতটা আনলেন কোহালির উইকেটটা তুলে। পিচের উপরে তৈরি ক্ষতে পড়ল তাঁর বলটা। তার পর বিষাক্ত কেউটের মতো ফনা তুলে হিস হিস শব্দ করে গ্লাভসে ছোবল মারল। এত ক্ষণ এই বিষাক্ত বলগুলোকেই অসাধারণ টেকনিক আর ধৈর্য নিয়ে সামলেছেন তিনি। কিন্তু এটা মাটিতে রাখতে পারলেন না। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ওঁত পেতে থাকা অ্যালেস্টেয়ার কুক ক্যাচটা ধরেই লাফিয়ে উঠলেন। উৎসবে মেতে উঠলেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা। তাঁরা জানেন কুকের মুষ্টিবদ্ধ হাতে ধরা রয়েছে ভারতের প্রাণ। বিদেশের মাঠে ভারতীয় দলের অন্যতম সেরা জয় ছিনিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন তখনই বিলীন হয়ে গেল।

কোহালি তার আগে এক বার ব্যাট-প্যাডের আবেদনের মুখে জোর বেঁচেছেন। এ বারও সুযোগ নিলেন। ভাবলেন যদি প্রযুক্তির হাত ধরে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু স্নিকোমিটার দেখিয়ে দিল, বল গ্লাভস ছুঁয়েই কুকের হাতে জমা পড়েছে। জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হতাশ কোহালি বেরিয়ে যাচ্ছেন, ওখানেই হিমশৈলে ধাক্কা লেগে টাইটানিক ফুটো হয়ে গেল।

সচিন তেন্ডুলকর যুগে একটা দীর্ঘ সময় ধরে সব দলের অধিনায়কেরা বলতেন, এই একটা উইকেট তোলো তা হলেই ম্যাচ আমাদের। এর পর সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ, সহবাগরা এসে সচিন-নির্ভরতা কাটিয়ে তোলেন। কোহালিকে নিয়েও এখন তেমনই বলা হচ্ছে। যতই চেতেশ্বর পূজারা রান করুন, যতই অজিঙ্ক রাহানে লড়াই করুন, কোহালি আউট হওয়া মাত্র ভেঙে পড়তে দেখা যাচ্ছে তাঁর দলকে। সাউদাম্পটনে পূজারার ইনিংস বাদ দিলে গোটা সিরিজে একই ছবি দেখা গিয়েছে।

রবিবার চা-পানের বিরতির দশ মিনিট আগেও মনে হচ্ছিল, ভারতীয় ব্যাটিংয়ের সেরা প্রতিরোধের কাহিনিই চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে। তত ক্ষণে কোহালি এবং রাহানে মিলে শুরুর দিকের ঝটকা সামলে ১০১ রান যোগ করে ফেলেছেন। শুরুতে ২২ রানের মধ্যে তিন জনকে হারানোর পরে মনে হচ্ছিল, লাঞ্চের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে না তো? সেখান থেকে অদম্য লড়াই আর প্রতিজ্ঞার ছবি হয়ে উঠেছিল কোহালি-রাহানে জুটি।

কিন্তু কোহালি আউট হতেই চায়ের ঘণ্টা খানেক পরেই ভারত অলআউট। কোহালি-রাহানে ক্রিজে থাকার সময়ে একটি ওয়েবসাইটে ম্যাচের ফয়সালা নিয়ে সম্ভাবনার গণনায় দেখাচ্ছিল পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। যে কেউ জিততে পারে। ভারত অধিনায়ক আউট হওয়া মাত্র সেটা হয়ে গেল ইংল্যান্ড ৭৩ শতাংশ, ভারত ২৭ শতাংশ। শেষে গিয়ে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের সার্কাস দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, তখন ভারতের সম্ভাবনা বেশিই দেখানো হয়েছিল। হার্দিক পাণ্ড্য, ঋষভ পন্থদের যা যোগ্যতা, কোহালি আউট মানে ভারতের সম্ভাবনা দশ শতাংশও নয়।

১৯৯৯ সালে চেন্নাই টেস্টে সচিন তেন্ডুলকরের উইকেট তুলে ভারতের জয়ের স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছিলেন সাকলিন মুস্তাক। রবিবার শেন ওয়ার্নের কাউন্টির মাঠে বিরাটকে আউট করে ভারতের আশার আলো নিভিয়ে দিলেন সাকলিনের শিষ্য মইন আলি।

স্কোরকার্ড

ইংল্যান্ড ২৪৬ ও ২৭১

ভারত ২৭৩ ও ১৮৪

ইংল্যান্ড (আগের দিন ২৬০-৮-র পর থেকে দ্বিতীয় ইনিংস)

স্যাম কারেন রান আউট ইশান্ত ৪৬

স্টুয়ার্ট ব্রড ক ঋষভ বো শামি ০

জেমস অ্যান্ডারসন ন. আ. ১

অতিরিক্ত ৯

মোট ২৭১

পতন: ১-২৪ (কুক, ১২.১), ২-৩৩ (মইন, ১৫.৪) ৩-৯২ (জেনিংস ৩১.৫), ৪-৯২ (বেয়ারস্টো, ৩১.৬), ৫-১২২ (রুট, ৪৫.৬), ৬-১৭৮ (স্টোকস, ৬৮.১), ৭-২৩৩ (বাটলার, ৮৪.৬), ৮-২৬০ (রশিদ ৯১.৫), ৯-২৬০ (ব্রড, ৯১.৬), ১০-২৭১ (কারেন, ৯৬.১)।

বোলিং: আর অশ্বিন ৩৭.১-৭-৮৪-১, যশপ্রীত বুমরা ১৯-৩-৫১-১, ইশান্ত শর্মা ১৫-৪-৩৬-২, মহম্মদ শামি ১৬-০-৫৭-৪, হার্দিক পাণ্ড্য ৯-০-৩৪-০।

ভারত (দ্বিতীয় ইনিংস)

ধওয়ন ক স্টোকস বো অ্যান্ডারসন ১৭

কে এল রাহুল বো ব্রড ০

পূজারা এলবিডব্লিউ বো অ্যান্ডারসন ৫

বিরাট কোহালি ক কুক বো মইন ৫৮

অজিঙ্ক রাহানে এলবিডব্লিউ বো মইন ৫১

হার্দিক পাণ্ড্য ক রুট বো স্টোকস ০

ঋষভ পন্থ ক কুক বো মইন ১৮

আর অশ্বিন এলবিডব্লিউ বো কারেন ২৫

ইশান্ত শর্মা এলবিডব্লিউ বো স্টোকস ০

মহম্মদ শামি ক অ্যান্ডারসন বো মইন ৮

যশপ্রীত বুমরা ন. আ. ০

অতিরিক্ত ২

মোট ১৮৪

পতন: ১-৪ (রাহুল, ৩.১), ২-১৭ (পূজারা, ৬.৬) ৩-২২ (ধওয়ন, ৮.৩), ৪-১২৩ (কোহালি, ৫০.৫), ৫-১২৭ (হার্দিক, ৫৩.৩), ৬-১৫০ (ঋষভ, ৫৮.৪), ৭-১৫৩ (রাহানে, ৬০.৫), ৮-১৫৪ (ইশান্ত, ৬১.৫), ৯-১৬৩ (শামি, ৬৪.২), ১০-১৮৪ (অশ্বিন, ৬৯.৪)।

৬০ রানে জয়ী ইংল্যান্ড

ম্যাচের সেরা মইন আলি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE