মোহনবাগানের পতাকায় ঢাকা সোমনাথের দেহ। —নিজস্ব চিত্র।
বাম রাজনীতিক বা দুঁদে পার্লামেন্টেরিয়ান সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে কে না চেনেন! তাঁর রাজনৈতিক বা সংসদীয় জীবনের নানা ওঠাপড়ার মুহূতের্র কথা বহুল প্রচারিত। কিন্তু ক্রীড়াপ্রেমী সোমনাথবাবু বাংলার ক্রীড়া প্রশাসনেও থেকে গিয়েছেন আমৃত্যু। রীতিমতো সক্রিয় ভাবে।
বিশ্ব ফুটবলে মারাদোনা আর আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। এ বারও বিশ্বকাপ দেখেছেন। কন্যা অনুশীলা বসু জানালেন, “আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পর বাবাকে বললাম, এ বার তুমি কী করবে! ফাইনালে সাপোর্ট করেছিল ক্রোয়েশিয়াকে।”
মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন সোমনাথ। একটা সময় পর্যন্ত ছিলেন ক্লাবের এগজিকিউটিভ কমিটিতেও। সোমবার শেষ যাত্রায় তাঁর মরদেহে কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা ওঠেনি, বরং তা ঢাকা ছিল সবুজ-মেরুন পতাকায়। শুধু মোহনবাগানে জড়িয়ে থাকা নয়, সোমনাথবাবু ওয়েস্ট বেঙ্গল টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউবিটিটিএ)-এর সভাপতি ছিলেন গত এক দশকের বেশি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্র আজও ভোলেননি প্রথম বার তাঁর ক্লাব সচিব হওয়ার সময়টা। তাই এক কথায় বলে ফেললেন, ‘‘সোমনাথদা না থাকলে আমার সচিব হওয়া হত না। উনিই আমাকে ক্লাবের সচিব বানিয়েছিলেন।’’ সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত অঞ্জন মিত্রর সঙ্গে অনেক ভাল স্মৃতি। অনেক লড়াই একসঙ্গে লড়েছেন দু’জনে। ক্লাবকে খারাপ সময় থেকে ভাল সময়ে নিয়ে এসেছেন। একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ক্লাবের জন্য লড়েছেন। তবে ক্লাবের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি দেখে কষ্ট পেতেন। অঞ্জন মিত্র বলছিলেন, ‘‘১৯৯৫ পর্যন্ত ক্লাবের এগজিকিউটিভ কমিটির সদস্য ছিলেন। আমরা একসঙ্গেই জিতে এসেছিলাম ক্লাব প্রশাসনে। সেই সময় ক্লাবের বেশ কিছু কেস চলছিল, সব নিজে সামলেছিলেন। ক্লাবের মধ্যে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছিলেন।’’
আরও পড়ুন
আমরাই বাবার দেহে সিপিএমের পতাকা রাখতে দিইনি, বললেন সোমনাথ-কন্যা
শুধু তাই নয়, নিয়মিত মাঠে আসতেন খেলা দেখতে। সপরিবারে মাঠে বসে খেলা দেখতেন। এগজিকিউটিভ কমিটি থেকে সরে যাওয়ার পর কিছু দিন আর ক্লাবে আসেননি। আবার আসেন লোকসভা স্পিকার হওয়ার পর, যখন তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তার পর অবশ্য খুব বেশি আর যাতায়াত ছিল না ক্লাবে। অঞ্জন মিত্র বলছিলেন, ‘‘সোমনাথদার সঙ্গে অনেক অনেক স্মৃতি। এই মুহূর্তে একটা কথা মনে পড়ছে। আমরা একসঙ্গে দিল্লি যাচ্ছিলাম। সেই বিমানে ছিলেন জ্যোতি বসুও। তখন দল অন্য কারও হয়ে আদালতে লড়ার অনুমতি দিত না। মোহনবাগানের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কেস আটকে ছিল। মাঝ আকাশে সোমনাথদা জ্যোতিবাবুর কাছে সেই কেস লড়ার অনুমতি চান। জ্যোতি বসু হেসে বলেন, মোহনবাগানের বিষয় তোমাকে না করি কী করে। অনুমতি নিয়ে আমাদের হয়ে কেস লড়েছিল সোমনাথদা।’’
মোহনবাগানে ভালমন্দে দীর্ঘ দিন যেমন জড়িয়ে ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, তেমনই জড়িয়ে গিয়েছিলেন বাংলা টেবিল টেনিসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে। ফলে জড়িয়েছেন কিছুটা বিতর্কেও। বেঙ্গল টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিটিএ) একটা সময় এ রাজ্যে টেবিল টেনিসের নিয়ামক সংস্থা ছিল। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ১৯৯৫ সালে বিটিটিও সভাপতি হন। কিন্তু প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলাতে পারেননি তিনি। ২০০৩ সালে বিটিটিএ ভেঙে যায়। ২০০৫ সালে তৈরি হয় বিটিটিএ-র পাল্টা সংস্থা ডব্লিউবিটিটিএ। তখনও সোমনাথবাবু বিটিটিএ সভাপতি পদেই আছেন। কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারেননি। দুই সংস্থাকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেও সফল হননি। শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে বিটিটিএ ছাড়েন। পরের বছর যোগ দেন ডব্লিউবিটিটিএ-তে। সেই থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন সভাপতি পদে। ২০০৫ সাল থেকে ডব্লিউবিটিটিএ-ই দক্ষিণবঙ্গে টেবিল টেনিসের নিয়ামক সংস্থা। অন্য দিকে উত্তরবঙ্গ সামলায় এনবিটিটিএ (নর্থ বেঙ্গল টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন)।
আরও পড়ুন
দ্বিধাথরথর সিপিএম, পলিটব্যুরোর শোকবার্তা এল ৫ ঘণ্টা পর
ডব্লিউবিটিটিএ কাউন্সিল সদস্য দেবাশিস চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘‘সোমনাথদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আবার কয়েক দিন পর মিটিং করতে আসব। উনি যে ভাবে এত দিন অ্যাসোসিয়েশন চালিয়েছেন, সেটাই আমাদের গাইড বুক। তাঁর পরিবর্ত কেউ হতে পারবেন না।’’
একটা সময় দায়িত্ব থেকে ছুটি চেয়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ডব্লুবিটিটিএ-র সদস্যরা তাঁকে ছাড়তে চাননি। দেবাশিস চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘‘সোমনাথবাবু ছিলেন বলে আমরা টুর্নামেন্ট আয়োজনে রেকর্ড করেছিলাম। একই বছরে সব ক’টা ন্যাশনাল আয়োজন বিটিটিএ। ২০১০, ২০১৫, ২০১৭তে তিনটি বয়স ভিত্তিক জাতীয় টুর্নামেন্ট, ৭টি ইস্ট জোন, দুটো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিলাম। সোমনাথবাবু বলতেন— তোমরা আয়োজন করতে পারলে আমার সবুজ সঙ্কেত আছে। টাকা-পয়সা নিয়ে আমাদের ভাবতে হত না। তাঁর দেখানো পথে আমরা আবার পারব বাংলার টেবল টেনিসে জোয়ার আনতে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy