ত্রয়ী: দুই গোলদাতা। ডিকা ও পিন্টুর সঙ্গে তির্থঙ্কর। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
মোহনবাগান ২ • মহমেডান ১
শেষ মিনিটে বাঁ পায়ের দুরন্ত শটে গোল করেই কর্নারের কাছে দৌড়ে গেলেন পিন্টু মাহাতো। তার পর কিলিয়ান এমবাপের কায়দায় বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে মাতলেন উৎসবে।
জঙ্গলমহলের ‘এমবাপে’-কে নিয়ে এর পরেই শুরু হয়ে গেল মাঠে এবং গ্যালারিতে অপরাজিত থেকে খেতাব জয়ের সবুজ-মেরুন উৎসব। ম্যাচের পর পিন্টু বলেও দিলেন, ‘‘নেমার আমার প্রিয় ফুটবলার হলেও এমবাপের গোল সেলিব্রেশন আমার খুব ভাল লাগে। আজ ঠিক করে এসেছিলাম গোল করলে ‘এমবাপে’ হব।’’ গ্রাম্য ছেলের সরল স্বীকারোক্তি বুঝিয়ে দেয় রয়েড স্ট্রিটের মোহনবাগান মেসের টিভির বিদেশি ফুটবল তাঁকে আধুনিক করছে প্রতিদিন।
সূর্যের সঙ্গে প্লুটোর যা ফারাক, প্যারিস সাঁ জারমাঁর এমবাপের সঙ্গে মোহনবাগানের পিন্টুর ফারাক তার চেয়েও কয়েক লক্ষ মাইল বেশি। বিশ্বকাপের সঙ্গে কলকাতা লিগের কোনও দিক দিয়েই তুলনা হয় না। কিন্তু কোনও এক বিন্দুতে যেন মিলে যান ফ্রান্সের এমবাপে এবং বাংলার পিন্টু। কারণ, দু’জনেই যে আবিষ্কার। এমবাপে রাশিয়া বিশ্বকাপের, পিন্টু এ বারের কলকাতা লিগের। আরও একটা জায়গায় মিল দেখা যাচ্ছে দু’জনের। সাফল্য পাওয়ার পর অদ্ভুত রকম শান্ত থাকেন।
বড় ডার্বি এবং ছোট ডার্বি—পরপর দু’ম্যাচে শেষ কবে কোনও বঙ্গসন্তান পরপর গোল করে দলকে বাঁচিয়েছেন বা জিতিয়েছেন মনে করা যাচ্ছে না। ডান ও বাঁ পায়ের জোরাল শটে দু’টো বড় ম্যাচে দু’গোল, সেটাও তো ময়দানে বিরল ঘটনা। তবে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে জড়োসড়ো হয়ে বসে বারবার ঠোট চাটতে থাকা পিন্টুকে দেখলে মনে হয়, ছেলেটার মধ্যে আগুন আছে। ধারাভাষ্য দেওয়ার সুবাদে এ বার লিগের প্রায় প্রতিটি ম্যাচই দেখেছেন সাত-আট দশকের প্রাক্তন তারকা মানস ভট্টাচার্য। বলছিলেন, ‘‘পিন্টুর মধ্যে আমাদের সময়ের গৌতম সরকারের মতো একটা আগ্রাসী মনোভাব আছে। আর বাঁ পা-টা দেখে প্রসূন বা প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ছে।’’
পিন্টু তাঁর জন্মগত প্রতিভা নিয়ে কত দূর এগোতে পারবেন বা আই লিগেও সফল হবেন কী না, সেটা সময় বলবে। তবে মহমেডানের কাছে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত যে শঙ্করলাল চক্রবর্তীর দল উৎসব করতে করতে বাড়ি ফিরল সেটা কিন্তু ম্যাচ সেরা পিন্টুর জন্যই। অপরাজিত থেকে খেতাব জেতার মধ্যে বাড়তি একটা তৃপ্তি তো থাকেই। সেটাই দেখা গেল মোহনবাগান কোচের মুখে।
বিরতি পর্যন্ত যে ম্যাচে কোনও রং ছিল না, সেটাই শেষ পর্যন্ত রঙিন এবং উত্তেজক হয়ে উঠল দু’দলের দুই সুপার সাবের জন্য। মহমেডানের ফিলিপ আজা আর মোহনবাগানের তীর্থঙ্কর সরকারের পাল্টা-পাল্টি গোলে জমে গেল ম্যাচটা। খেপ খেলার মাঠ থেকেও যে ফুটবল-তারকার উদয় হয়, সেটা এ দিন আরও একবার প্রমাণ করে দিলেন সাদা-কালো দলের আজা। ইস্টবেঙ্গলকে লিগ থেকে ছিটকে দেওয়ার নায়ক নেমেছিলেন বিরতির ষোলো মিনিট পর। মোহনবাগানের আঠারো গজের বক্সে ঢুকে কঠিন কোণ থেকে যে ভাবে সোয়ার্ভিং শটে আজা গোল করে গেলেন তা বিশ্ব মানের। তিন ম্যাচে চার গোল—ঘানার এই ছেলেটা পাড়ায় পাড়ায় ভাড়া করা ফুটবলার হিসাবে খেলে বেড়ান! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। ১-০ পিছিয়ে পড়ার পর যিনি মোহনবাগানকে সমতায় ফেরালেন, সেই তীর্থঙ্কর সরকারও তো হারিয়ে যেতে যেতে ভেসে উঠেছেন এ বার। তাঁকেও বিরতির কুড়ি মিনিট পর নামিয়েছিল মোহনবাগান। বেলঘরিয়ার মিডিওর অসাধারণ ফ্রি কিকের গোল পালতোলা নৌকার সওয়ারিদের অপরাজিত থাকার অক্সিজেন দিল। তৃপ্ত মোহনবাগান কোচ বলছিলেন, ‘‘তীর্থঙ্করের গোলই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। ফ্রি কিক পেল গোল করবে, এ জন্যই তো ওকে নামিয়েছিলাম। এটা নিয়ে তিনটে ম্যাচে এ রকম গোল করল।’’ কপালে লাল টিপ পরে আসা মহমেডান কোচের গলাতেও তীর্থঙ্করের প্রশংসা ও আক্ষেপ। ‘‘আমাদের গোলকিপার প্রিয়ান্ত সিংহ এবং ওদের তীর্থঙ্কর এক সঙ্গে জেলা লিগে খেলে। প্রিয়ান্ত তো জানে কোন দিকে তীর্থ বল ঘোরায়। ধরবে না? ওই গোলটাই সব শেষ করে দিল।’’
রঘুর হতাশার মধ্যেই মোহনবাগানের অপরাজিত কোচ হাসতে হাসতে বরানগরের বাড়ির পথ ধরলেন। পুজোটা ডিকা-পিন্টুদের সঙ্গে শঙ্করলালেরও ভালই কাটবে।
মোহনবাগান: হোসে রিকার্ডো, আমে রানওয়াডে, কিংগসলে ওবুমেনেমে, লাল কিমা, গুরজিন্দর সিংহ, উইলিয়াম ফেলা (অবিনাশ রুইদাশ), পিন্টু মাহাতো, কেলডেইরা (ইউতা কিনওয়াকি), সৌরভ দাশ, আজহারউদ্দিন মল্লিক (তীর্থঙ্কর সরকার), দিপান্দা ডিকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy