বীরুর অবসর নেওয়ার ধরনটা দেখে বেশ খারাপই লাগল। বীরেন্দ্র সহবাগের মতো একজন ক্রিকেটার, যে কি না টেস্ট ক্রিকেটে দেশের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার, তার অবসর ঘোষণা কেন এত ম্যাড়ম্যাড়ে হবে? সে কেন নিজের বাড়িতে বসে বা দুবাইয়ে কোনও অনুষ্ঠানে গিয়ে ঘোষণা করবে, আমি আর খেলছি না? ওর মতো ক্রিকেটারের বিদায় তো আরও জমকালো হওয়া উচিত। অনেক সম্মানের সঙ্গে ওকে বিদায় জানানো উচিত। দেশের জার্সি ছেড়ে দু’বছর বসে থাকার পর নয়, সহবাগের মতো ক্রিকেটারের অবসর হওয়া উচিত ছিল দেশের জার্সি পরে। খেলতে-খেলতে।
কেউ কেউ বলতে পারেন যে, আমি কেন কথাগুলো বললাম। সহবাগ গত দু’বছরে এমন আহামরি কিছু করেনি যে জাতীয় দলে ওকে ফিরিয়ে নিতে হবে। এটা ভাবলে সবচেয়ে ভুল করবেন। বীরেন্দ্র সহবাগের মতো ক্রিকেটার রোজ-রোজ কোচিং ক্যাম্প থেকে ওঠে না। ঠিকঠাক বললে, কোনও কোচিং ক্যাম্প সহবাগ তৈরি করতে পারবে না। সহবাগরা আলাদা হয়, আর ওদের কখনও ঘরোয়া ক্রিকেট দিয়ে বিচার করতে নেই। একটা ছোট উদাহরণ দিই। ওর সঙ্গে একবার আড্ডা মারার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, সাধারণত ওপেনারদের প্রথম বল ফেস করার সময় তিনটে রি-অ্যাকশন হয়। প্রথম রিঅ্যাকশন— বলটা ছেড়ে দেব। দ্বিতীয়, সিঙ্গলস বা টু’জ নেব। আর শেষটা, বড় শটে যাব। তোমার কোনটা হয়? সহবাগ আমাকে বলেছিল ওর রিঅ্যাকশনের অর্ডারটা ঠিক উল্টো! মানে ওর প্রথম রিঅ্যাকশনই হল, বলটাকে বাউন্ডারিতে পাঠাব! সেটা না হলে, খুচরো রান নেব। আর একদম শেষে, ডিফেন্স করা!
বোঝা গেল কেন বলছিলাম ও আলাদা? কেন ওর জন্য গত দু’বছরের রঞ্জি ট্রফি পারফরম্যান্স মাপকাঠি হতে পারে না?
আসলে যে সব ক্রিকেটার পাঁচ জনের থেকে আলাদা হয়, তাদের জীবনে অধিনায়কের ভূমিকাটা গুরুত্বপূর্ণ। বীরুকে আজ দেখছিলাম ইন্টারভিউয়ে বলছে যে, দাদি (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) না থাকলে ওর এই জায়গায় আজ পৌঁছনোই সম্ভব হত না। সেটা দেখার পর মনে হচ্ছে, এমএস (ধোনি) ওর উপর আর একটু বিশ্বাস রাখলে বোধহয় পারত। আরও একটু দেখতে পারত। দু’বছর টিম থেকে একেবারে দূরে না রেখে মাঝে একবার দেখে তো নেওয়া যেত। দেখুন, বলছি না আজকের টেস্ট টিমে যারা আছে তারা খারাপ। তারাও ভাল। কিন্তু বীরেন্দ্র সহবাগ একজনই হয়। তা ছাড়া এ বছর জানুয়ারিতেই মনে আছে হরিয়ানার লাহলির সবুজ উইকেটে ওর একটা ইনিংসের কথা। লাহলি উইকেট এমন যে, ওখানে চার দিনই বল নড়ে। টিমগুলোর দেড়শো তুলতে কালঘাম বেরিয়ে যায়। বীরু সেখানে সেঞ্চুরি করে চলে গেল! আমি ছিলাম ম্যাচটায়। কমেন্ট্রি করছিলাম। দেখে মনেও হয়েছিল যে, ঘরোয়া ক্রিকেটের কঠিন পরিবেশে যে রান করে দেখাচ্ছে, তাকে আর কী করতে হবে টিমে ফেরার জন্য? পরিষ্কার বলি, গত কুড়ি বছরের টেস্টে ভারতের সেরা ম্যাচ উইনার দু’জন। একজন অনিল কুম্বলে। অন্য জন বীরেন্দ্র সহবাগ। আর দ্বিতীয় লোকটা সবার থেকে সব দিক থেকে আলাদা। নিজে ওর সঙ্গে ব্যাট করেছি বলে জানি, ওর সঙ্গে নামলে ব্যাটিংটা আর ব্যাটিং থাকে না। আনন্দ করা হয়ে যায়। ওভারের মধ্যে ও গান গাইবে। বোলার কে, সে সবে পাত্তাই দেবে না। মনে আছে, টেস্টে আমার প্রথম নামা। শুরুর দিকে একটা শট ব্যাটের পিছনে লেগে বাউন্ডারিতে চলে গেল। উল্টো দিকে তখন বীরু। ওকে দুঃখ করে বললাম যে, ধুর কানেক্টই হল না। শুনে আমাকে পাল্টা বলল যে, তো? বাউন্ডারি পেয়েছিস তো? চারটে রান তো এসেছে। কী ভাবে এসেছে কে দেখতে বলেছে? আবার মেলবোর্ন টেস্টে সহবাগের ১৯৬ রানের ইনিংসটা ধরুন। সাইমন কাটিচের ফুলটসে আউট হল। ফিরে আসতে বললাম, কী দরকার ছিল। আর একটু ধরে খেললে দু’শো পেতে। বীরু যেন একটু রেগেই গেল শুনে। বলল, আগেরটায় একই বলে ওকে ছয় মারলাম। তখন তো কেউ কিছু বলল না? ফুলটস পেলে তো ছয়ই মারব। আউট হয়েছি, হয়েছি।
এটাই বীরেন্দ্র সহবাগ। যে ক্রিকেট খেলাটার যতটুকু যা জটিলতা আছে, সেটাকেও সহজ করে দেখবে। যে ওপেনিংয়ের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দেবে। আর আমাকে ওর ফ্যান ভাবুন বা আমার কথা যতই অযৌক্তিক শোনাক, একটা জিনিস বিশ্বাস করি। বীরেন্দ্র সহবাগের মতো ক্রিকেটারের কিছুতেই ১০৪ টেস্ট খেলা উচিত নয়।
বীরেন্দ্র সহবাগের মতো ক্রিকেটারের তার চেয়ে অনেক বেশি খেলা উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy