Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ক্রিকেটে বিপ্লব ঘটিয়ে রিলে ক্যাচ মায়াঙ্কদের, ঠিক যেন ‘জুটিতে লুটি’

কখনও সখনও এমনও দেখা যায় যে, দুই বা তিন জন ফিল্ডারকে নিয়ে একসঙ্গে এই অনুশীলন করাচ্ছেন ফিল্ডিং কোচ। যার নামকরণ হয়েছে ‘রিলে ক্যাচিং।’

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৮ ১৪:০১
Share: Save:

অনেক আইপিএল দলের অনুশীলনেই দৃশ্যটা দেখা যায়। ফিল্ডিং কোচ আলাদা করে বেছে নিচ্ছেন তিন-চার জনকে। তাঁদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাউন্ডারি লাইনে দড়ির ধারে। কোচ ব্যাট দিয়ে উঁচু করে মারছেন বল আর বাউন্ডারি টপকে অবধারিত ছক্কা হওয়া বলগুলিকে জিমন্যাস্টের মতো শরীর বেঁকিয়ে অভাবনীয় ভঙ্গিতে ক্যাচে পরিণত করে ফেলছেন ফিল্ডাররা।

কখনওসখনও এমনও দেখা যায় যে, দুই বা তিন জন ফিল্ডারকে নিয়ে একসঙ্গে এই অনুশীলন করাচ্ছেন ফিল্ডিং কোচ। যার নামকরণ হয়েছে ‘রিলে ক্যাচিং।’ এক জন ক্যাচটা ধরে ভারসাম্য হারিয়ে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে পড়ে যাওয়ার আগে উঁচু করে ছুড়ে দিচ্ছেন মাঠের মধ্যে। আর আশেপাশে এসে যাওয়া অন্য কোনও ফিল্ডার সেই বলটা লুফে নিলেন।

ইনদওরে রবিবার রাতে কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের দুই ফিল্ডার মায়াঙ্ক অগ্রবাল এবং বাংলার মনোজ তিওয়ারির যুগলবন্দিতে যে অবিশ্বাস্য ক্যাচ দেখা গেল, তা এই অনুশীলনেরই ফসল। এক রাতের কোনও চমক এটা নয়। বিভিন্ন দেশে টি-টোয়েন্টি লিগের রমরমায় এই ‘রিলে ক্যাচিং’ অনুশীলন এখন দৈনন্দিন সূচির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

কী ঘটেছিল ইনদওরের মাঠে? বেন স্টোকসের সজোরে মারা শট বেলুনের মতো ছক্কা হয়ে বাউন্ডারির বাইরে পড়ছিল। মায়াঙ্ক অগ্রবাল নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিলেন বাউন্ডারির ধারের দড়ির একেবারে গা ঘেঁষে। বলটা তাঁর নাগালের মধ্যে আসতেই ঠিক সময়ে লাফিয়ে ক্যাচ লুফে নিলেন। তার পরেই তিনি বুঝতে পারলেন, ভারসাম্য হারিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পড়ে যাচ্ছেন। ক্রিকেটের আইন অনুযায়ী, বাউন্ডারির দড়িতে শরীরের কোনও অংশ স্পর্শ করলেই ক্যাচ অবৈধ হয়ে যাবে। মায়াঙ্ক তাই বলটাকে উঁচু করে ছুড়ে দিলেন মাঠের মধ্যে। বাউন্ডারির ধারে চলে আসা মনোজ ক্যাচটা লুফে নিতেই স্টোকস আউট!

ইনদওরের হাউসফুল গ্যালারি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সেই ক্যাচ দেখে। দর্শকেরা যেটা দেখতে পেলেন না, তা হচ্ছে, মায়াঙ্ক-মনোজরা এই ক্যাচ অনেক বার ধরছেন দলের অনুশীলনে। ইনদওরের মাঠ ছোট, ইডেনের মতো বড় বাউন্ডারি নেই সেখানে। সেই কারণে এই ধরনের ক্যাচ আসার সম্ভাবনা বেশি, বুঝতে পেরে আগে থেকেই সজাগ ছিল প্রীতি জিন্টার দল। বাংলার অধিনায়ক মনোজ নিজে দুর্দান্ত ফিল্ডার। প্রথম যখন ভারতের হয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন, সেরা ফিল্ডারদের এক জন ছিলেন। মনোজ মনে করেন, এই ধরনের ক্যাচের ক্ষেত্রে অ্যাথলিটের মতো নমনীয়তা বা শারীরিক সক্ষমতা তো দরকারই। কিন্তু সব চেয়ে বেশি জরুরি, উপস্থিত বুদ্ধি। কেন?

স্টোকসের শট ধেয়ে আসছিল তীব্র গতিতে। ফিল্ডারের হাতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশেরও কম সময়। তার মধ্যেই দেখে নিতে হবে, বাউন্ডারি লাইনে যেন পা না লাগে। দুর্দান্ত মনঃসংযোগ দরকার। এর পর মোক্ষম সময়ে লাফিয়ে ক্যাচ লোফার চেষ্টা করতে হবে। ক্যাচ ধরলেই কাজ শেষ হচ্ছে না। ভারসাম্য হারিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পড়ার আগে বলটাকে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে এমন উচ্চতায় এবং এমন দূরত্বে ছুড়ে দিতে হবে যাতে ফিরে এসে সেটাকে লুফে নেওয়া যায়। ইনদওরে রবিবার মায়াঙ্ক কাছাকাছি পেয়ে গিয়েছিলেন মনোজকে। তাই তাঁর দিকে বলটা ছুড়ে দিতে পেরেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে একাই এই দুঃসাধ্য সাধন করতে হয়। তাই কত দূরে ছুড়ব আর কত উঁচুতে ছুড়ব, সেটাও মাথায় রাখতে হবে ওই মোক্ষম সময়ে।

তিন দিন আগে পুণেতে টিম সাউদির ক্যাচটি যেমন। চেন্নাইয়ের সুরেশ রায়নার মারা শট বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ক্যাচ ধরেও আরসিবি-র সাউদি দেখেন, পড়ে যাচ্ছেন বাউন্ডারির বাইরে। শূন্যে ভেসে থাকা অবস্থায় তিনি বলটা মাঠের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে লাফিয়ে ফের মাঠের মধ্যে এসে লুফে নেন। রায়না বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, পরিষ্কার ছক্কা কেমন চোখের নিমেষে রং পাল্টে তাঁকে ফিরিয়ে দিল ডাগআউটে!

ক্রিকেটের নতুন আইনে বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে এই ক্যাচ ধরাকে আরও কঠিন করে দিয়েছে। এখন নিয়ম হয়ে গিয়েছে, ক্যাচ ধরার আগে ফিল্ডারের পা শেষ বার যেন মাঠের মধ্যে স্পর্শ করে থাকে। অর্থাৎ, আগের মতো ক্যাচ ধরে শূন্যে বলটা ছুড়ে দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পা ঠেকিয়ে আবার মাঠে ঢুকে আসা যাচ্ছে না। ফিল্ডারকে এখন দেখতে হচ্ছে যাতে পা বাউন্ডারির বাইরে না পড়ে। যদিও নতুন এই আইনের সমালোচনা করেছেন অনেকেই।

কে এই ক্যাচের জনক? তর্ক থাকলেও নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার নাথন অ্যাস্টল প্রথম এই উদ্ভাবনী শক্তি দেখিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। জন্টি রোডস যদি নব্বইয়ের দশকে পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিংয়ে বিবর্তন এনে থাকেন, তা হলে অ্যাস্টলের একটি ক্যাচ পাল্টে দিয়ে গিয়েছে ফিল্ডিংয়ের ভাষাই। সম্ভবত সালটা ২০০৬। স্পিনার জিতন পটেলের বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যান ডোয়েন স্মিথের মারা জোরাল শট মিডউইকেট বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে এ ভাবেই লুফে নিয়েছিলেন অ্যাস্টল। ১২ বছরের মধ্যে অ্যাস্টলের আবিষ্কার আর অঘটন নয়, ক্রিকেটের নিত্যকার অঙ্গ এবং সেরা বিনোদন হয়ে উঠেছে।

আইপিএলেই অনেক বার দেখা গিয়েছে এমন ক্যাচ। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে কায়রন পোলার্ড নিয়েছেন। পোলার্ড বিশ্বের বিভিন্ন মাঠে সব চেয়ে বেশি বার এই ক্যাচ নিয়েছেন। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে ক্রিস লিন নিয়েছেন। ক্রিকেট দুনিয়ায় বাউন্ডারি লাইন ক্যাচের বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিখ্যাতদের মধ্যে আরও রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এ বি ডিভিলিয়ার্স, নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট, ইংল্যান্ডের অইন মর্গ্যান, অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।

একটা সময় ছিল যখন বল আটকানোর জন্য ঝাঁপালেই বলা হত— বাহ্, দারুণ চেষ্টা। যুগ পাল্টেছে। এখন উড়ন্ত চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যেতে হবে দুরন্ত ক্যাচ— তবেই না তুমি ভাল ফিল্ডার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE