Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

উইম্বলডনই শুধু জিতেছেন জোকার, উইম্বলডনকে নয়

পৃথিবী কত বদলে গিয়েছে। সেন্টার কোর্টে সিঙ্গলস ফাইনাল শুরুর আগে যখন লকাররুমের একটা ঝলক দেখাচ্ছিল। দেখাচ্ছিল দুই ফাইনালিস্টকে। তখন অবাক হয়ে ভাবছিলাম, দুনিয়াটা সত্যিই তা হলে আর এক নেই! আজ থেকে বছর বাইশ আগে উইম্বলডন কভার করতে গিয়ে মিডিয়া রুমে একটা আপ্তবাক্য প্রথমেই শুনে ফেলেছিলাম। আর যা-ই হোক কখনও লকাররুমে ঢোকার চেষ্টা কোরো না। ওটা একেবারে প্লেয়ারের নিজস্ব পৃথিবী। নিজস্ব স্পেস। নিজস্ব গভীর ব্যক্তিগত জীবন।

সর্বকালের সেরা টেনিস ক্ষত্রিয়। ছবি: এএফপি।

সর্বকালের সেরা টেনিস ক্ষত্রিয়। ছবি: এএফপি।

গৌতম ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৫ ১৯:২৬
Share: Save:

পৃথিবী কত বদলে গিয়েছে।

সেন্টার কোর্টে সিঙ্গলস ফাইনাল শুরুর আগে যখন লকাররুমের একটা ঝলক দেখাচ্ছিল। দেখাচ্ছিল দুই ফাইনালিস্টকে। তখন অবাক হয়ে ভাবছিলাম, দুনিয়াটা সত্যিই তা হলে আর এক নেই!

আজ থেকে বছর বাইশ আগে উইম্বলডন কভার করতে গিয়ে মিডিয়া রুমে একটা আপ্তবাক্য প্রথমেই শুনে ফেলেছিলাম। আর যা-ই হোক কখনও লকাররুমে ঢোকার চেষ্টা কোরো না। ওটা একেবারে প্লেয়ারের নিজস্ব পৃথিবী। নিজস্ব স্পেস। নিজস্ব গভীর ব্যক্তিগত জীবন।

সাংবাদিক সেখানে ঢুকবে কী, পারলে তাকাবে না। যে সময়ের কথা বলছি তখনও উগ্রপন্থার সে ভাবে মুখ দেখেনি বিশ্ব। কিন্তু লকাররুম সংলগ্ন এলাকায় তীব্রতম নজরদারি থাকত। সাংবাদিকেরা মিডিয়া সেন্টার ছেড়ে ওই তল্লাটে যাওয়ার জন্য দিনে একটা পাস পেতেন। তার সময়সীমা চল্লিশ মিনিট। কিন্তু সেই পাসটা লকাররুমের দু’টো তলা ওপরে ক্যাফেতে যাওয়ার জন্য। ওই ক্যাফেতে প্লেয়াররা খেলেটেলে সময়-সময় স্নিগ্ধ হতে আসে। সেখানে জার্নালিস্টকে ওঁত পেতে থাকতে হয়— যদি কেউ আসে। যদি কোনও রাঘববোয়ালকে পাওয়া যায়।

সমস্যা একটাই—আপনাকে ধার্য করা চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেলে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। তখন সামনে ম্যাকেনরোকে পেয়ে গেলেও কিছু করার নেই।

দিনের পর দিন ওই পাসটা নিয়ে একজনের অধীর অপেক্ষা করেছি এবং পাইনি। পরে জেনেছি তিনি ওপরে উঠে কফি খাওয়া দূরে থাক, লকাররুমেও নামমাত্র সময় কাটান। নিজের ট্রেডমার্ক ফোরহ্যান্ডের মতোই দ্রুত তাঁর শাওয়ার নেওয়া এবং তৈরি হয়ে তীর বেগে গাড়িতে উঠে যাওয়া। ম্যাডাম গ্রাফ।

তখন জানতাম না লকাররুম নামক অনাবিষ্কৃত পৃথিবী যত তাৎপর্যপূর্ণ ভেবেছিলাম, তার চেয়েও অনেক বেশি। অন্তত প্রাক্ গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে। পরবর্তী সময়ে বার হওয়া নাদাল এবং আগাসি দু’জনের আত্মজীবনীতে সবিস্তার বর্ণনা আছে যে, লকাররুমের শরীরী ভাষা কী করে ম্যাচের প্রথম গেমের নিষ্পত্তি করে দেয়।

রাফায়েল নাদাল তো পরিষ্কার স্বীকার করেছেন, বড় ফাইনালের আগে ফেডেরার লকাররুমে কী করছেন, তিনি খুঁটিনাটি নজর করে গিয়েছেন। ওই নিভৃতে দর্শক থাকার উপায় নেই। চেয়ার আম্পায়ার থাকে না। স্পনসর থাকে না। যার যার কোচ থাকে না। কিন্তু গ্র্যান্ড স্ল্যামে ম্যাচের প্রথম গেমটা ওখানেই খেলা হয়ে যায়।

স্টার টিভির দৌলতে যখন লকাররুমের ফাঁক করা দরজাটা কাল দেখাচ্ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী দু’জনকেই দেখে নেওয়ার অতর্কিত সুযোগ হয়ে গেল। তিনি নোভাক জকোভিচ সামনে। দীর্ঘকায়। ছিপছিপে। সপ্রতিভ। কিন্তু আজ উদ্বিগ্ন, আনমনা। শরীরীভাষা মোটেও সুবিধের লাগছে না। পিছনে তিনি বরাবরের রাজকীয় রজার ফেডেরার। বরাবরের বোধহয় ঠিক বলা হল না। রাজকীয় আত্মবিশ্বাস মাঝে উধাও হয়ে সেখানে এই জকোভিচের অনিশ্চিত মুখচোখ ফুটে মতো উঠছিল। কিন্তু ইনি পুরনো ফেডেরার। অ্যান্ডি মারেকে হারিয়ে দিয়েছেন এলেবেলে করে। আজকেও তো তাকাচ্ছেন কেমন প্রশান্তির সঙ্গে যে, কোর্টে কী মারব নয় ট্রফি জিতে উঠে কী বলব সেটাও আগাম ছকা হয়ে গিয়েছে আমার।

কোর্টে পা রাখলেন প্রথমে জকোভিচ। পরে ফেডেরার। হয়তো নিয়মটাই তাই যে প্রথমে শীর্ষ বাছাই ও গত বারের চ্যাম্পিয়ন। তার পর চ্যালেঞ্জার। কিন্তু এই ফেডেরারকে এত নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে যে তাতে কী। লকাররুমের ওই এক টুকরো ছবিই তো ফাইনালের স্কোর বলে দিচ্ছে— গেম, সেট অ্যান্ড ম্যাচ টু ফেডেরার!

প্রথম সেটের নড়াচড়া থেকেও বোঝা যায়নি বিপরীতমুখী কোনও ঘটনার জন্য উইম্বলডন সহ বাকি বিশ্বকে তৈরি থাকতে হবে। যত লম্বা র‌্যালি হতে শুরু হল তত যেন বোঝা গেল, ওই লকাররুমের চাউনি-টাউনি দেখে আর যাই হোক ফিটনেস ঠাওর করা যায় না।

আর ফিটনেস খেলার মাঠে এমন একটা বস্তু যা মনকে ডাবল ক্যারি করতে পারে। মন বরঞ্চ দুর্বল শরীরকে দু’ঘণ্টা ছাপ্পান্ন মিনিট টানা ক্যারি করতে গেলে বেদম হয়ে পড়ে।

জকোভিচের ফিটনেস জার্মান ট্যাঙ্কের মতো। এক রকম অভেদ্য। ফিটনেসের সরণিতে প্রথমে লেন্ডল। তার পর নাদাল। আধুনিক সময়ে জকোভিচ। তিনি— জকোভিচ হলেন নাদালের চেয়েও ভাল নাদাল। পাওয়ার টেনিসের ফ্লোর লেভেলটাই যিনি আর এক ধাপ ওপরে তুলে দিয়েছেন।

ব্যাটসম্যান যেমন ইন্ডোরে বোলিং মেশিনের বিরুদ্ধে প্র্যাকটিস করে, জকোভিচ নিজের দিনে সেই মেশিন। যা যা নেটের ও পারে থাকা লোকটা পেতে সবচেয়ে অপছন্দ করবে, তার সব কিছু তাঁর ভেতর রয়েছে। ডিপ গ্রাউন্ড স্ট্রোক। নেটের কাছে পৌঁছনো অসম্ভব সব বলে পৌঁছে যাওয়া। মজবুত সেকেন্ড সার্ভ। আর টেনিস চ্যাম্পিয়নের যা বৈশিষ্ট্য, চাপের মুখে সার্ভিসের ফুলকি বাড়িয়ে দেওয়া।

ফেডেরার যত বড় চ্যাম্পিয়নই হন, দিনের শেষে একজন মনুষ্য। মেশিনকে কী করে হারাবেন— তা-ও এই চৌত্রিশ ছুঁইছুঁই বয়সে।

একটা সময় তিনি এবং তাঁর ভক্তরা আবিষ্কার করলেন, ফেড-এক্সপ্রেসের সবচেয়ে বিখ্যাত অস্ত্রই ভুল করে ফেলছে। সেই রাক্ষুসে ফোরহ্যান্ড। যাকে টেনিস সার্কিটে জস-টু বলা হয়। অরিজিন্যাল জস অবশ্যই স্টেফি গ্রাফ! নামে জস-টু হলেও ফেডেরারের ফোরহ্যান্ড আরও বর্ণাঢ্য, আরও অভিজাত, আরও ভয়ঙ্কর। এমনকী স্টেফিও একটা সময়ের পর আর তুলনায় আসেন না।

সেই ফোরহ্যান্ডের সহজ রিটার্ন নেটে যাচ্ছে দেখে আম-সমর্থক বুঝবে আজ এক্সপ্রেসের দিন নয়। টেনিস-দর্শক অন্য কথা বলবে। বলবে এমন ছোটাচ্ছে নোভাক যে ফোরহ্যান্ডও কি না চাপে পড়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় সেটে ফেডেরারের লড়ুয়ে জয়ের পর এটুকু বোঝা গেল যন্ত্রের সামান্য খারাপ দিনে আজও তিনি সম্রাট। কিন্তু যন্ত্র যে দিন অভ্রান্ত কাজ করবে সে দিন একা মানুষ কী করে হারাবে একটা অলিখিত প্রযুক্তিকে যা এত কঠিন রূপে আবির্ভূত হয়েছে তাঁর সময়ের পরে?

এই সেন্টার কোর্ট অনেক একপেশে ফাইনাল দেখেছে। চুরাশি সালে ম্যাকেনরো যা করেছিলেন ক্রিস লুইসকে নিয়ে তাকে বলে ফাইনালের অপভ্রংশ। বেকার-এডবার্গ আজ প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শিবিরের টেকনিক্যাল মস্তিষ্ক জানেন ফাইনাল মানেই ফাইনালের মতো হবে তার কোনও মানে নেই।

কিন্তু তিনি— ফেডেরার নকড়াছকড়া হয়ে কবে হেরেছেন? চোট-বিসুখ থাকলে অন্য কথা। নইলে আজও তাঁকে যন্ত্রও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। এখনও সব সময়ের মতোই তিনি টিকিটের প্রাপ্য মূল্য নিজের খেলায় দিয়ে থাকেন। খেলাটাকে যে নিজের আত্মার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। জিমি কোনর্স সম্পর্কে বলা হত, দ্য ম্যান হু গেভ হিমসেলফ টু টেনিস। ফেডেরারকে তা হলে কী বলা হবে— দ্য ম্যান হু বিকেম দ্য সোল অব টেনিস? যে ক্রমশ টেনিস নামক খেলাটারই আত্মা হয়ে উঠেছে?

সেন্টার কোর্টে কাল রানার আপের নাম ঘোষণা হতে যে পরিমান আবেগ বাষ্প হয়ে উড়ে গেল তা টিভি স্ক্রিন থেকেও বুঝে নিতে সমস্যা নেই। তিনি— চ্যাম্পিয়ন জকোভিচও হাততালি পেলেন। কিন্তু সেটা সম্ভ্রমের। দূরের পাড়ার ফার্স্ট বয়ের জন্য যে হাততালি বরাদ্দ থাকে, সেটা। অথচ ফেডেরার যা অভ্যর্থনা পেলেন তা অল ইংল্যান্ড ক্লাবের ইতিহাসে কোনও রানার আপ কখনও পেয়েছে কি? এটুকু তো বিশ্বের দুই গোলার্ধের লোকেরাই তখুনি জেনে গেল জকোভিচ উইম্বলডনই জিতেছেন, উইম্বলডনকে জেতেননি!

ফেডেরার কি বিদায় ঘোষণা করে দেবেন এমন আবেগঘন পরিবেশে? এমন আবেগরুদ্ধ সময়, তা-ও এত ভাল খেলে ফাইনাল হারার পর। এমন জুতসই মুহূর্ত যদি আর বাকি জীবনে ফেরত না আসে!

ফেডেরার এ জন্যই সর্বকালের সেরা টেনিস ক্ষত্রিয়। তথাকথিত নিরাপদ থাকায় বিশ্বাসই করেন না। টেনিস-জঙ্গলের নিয়ম আজও সুনামের ঝুঁকি নিয়েও মেনে নিতে তাঁর অসুবিধে নেই যে হয় মারো, নয় মরো।

নিশ্চিন্ত, নিরাপদ আশ্রয় সে তো গড়পড়তা চ্যাম্পিয়ন ভাববে। যদি আর টানতে গেলে তার অতীত গৌরবে কাদা লাগে। ফেডেরারের মনন ঠিক উল্টো। অবসর নিয়ে ভাবতে বসব না ইস আরও কতগুলো ট্রফি জিততে পারতাম। তাঁর কাছে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

লেখার প্রথম লাইনটা ভুল লিখেছি। পৃথিবী আজও বদলায়নি। কিছু কিছু জিনিস বদলায় না। যেমন টেনিস কোর্ট ধরে ফেড-এক্সপ্রেসের যাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE