Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সামনে বিশ্বকাপার আকোস্তা, মনেই ছিল না জঙ্গলমহলের পিন্টুর

ড্র ম্যাচে লাল-হলুদ জার্সিতে নামা টাটকা বিশ্বকাপার জনি ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁকে ছাপিয়ে ম্যাচ সেরার পুরষ্কার নিয়ে গেলেন কুড়ি বছরের যে কৃষকের ছেলে, সেই আদিবাসী যুবক পিন্টু মাহাতোর অবশ্য তারকা হওয়ারই কথাই ছিল না!

দ্বৈরথ: লাল-হলুদের কাশিমের থেকে বল কাড়ছেন পিন্টু। —নিজস্ব চিত্র

দ্বৈরথ: লাল-হলুদের কাশিমের থেকে বল কাড়ছেন পিন্টু। —নিজস্ব চিত্র

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৪৯
Share: Save:

নেমার দ্য সিলভা স্যান্টোস (জুনিয়র) কে দেড় মাস আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে আটকে দিয়েছিলেন জনি আকোস্তা। কোস্টা রিকার সেই স্টপারকে টপকেই গোল করেছেন জঙ্গলমহলের পিন্টু মাহাতো, সেটা আবার ডার্বি অভিষেকে। অবিশ্বাস্য এই দৃশ্য দেখল রবিবারের সূর্য ডোবা বিকেলের যুবভারতী।

ড্র ম্যাচে লাল-হলুদ জার্সিতে নামা টাটকা বিশ্বকাপার জনি ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁকে ছাপিয়ে ম্যাচ সেরার পুরষ্কার নিয়ে গেলেন কুড়ি বছরের যে কৃষকের ছেলে, সেই আদিবাসী যুবকের অবশ্য তারকা হওয়ারই কথাই ছিল না! চার বছর আগের কোনও এক দুপুরে হাওড়া স্টেশনে রাত কাটিয়েই জঙ্গল মহলের ধডরাশোল গ্রামেই হয়তো ফিরে যেতে হত তাঁকে। সেটা হয়নি ছোট বেলার কোচ অমিয় ঘোষের জন্য। প্রথম দিন মোহনবাগানের নার্সারি ফুটবল টিমে ঢোকার জন্য ট্রায়াল দিতে এসেছিলেন পিন্টু। বাড়ি ফেরার পথে অমিয় তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘তুমি রাতে থাকবে কোথায়?’’ উত্তরে অদম্য পিন্টু বলে দিয়েছিল, ‘‘হাওড়া স্টেশনে রাতে শুয়ে থাকব।’’ শহরে থাকার জায়গা নেই শুনে তাঁকে বেহালায় নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলেন ছোটদের বড় কোচ অমিয়। সেখানেই তাঁর ফ্রি কিক আর কর্নারের হাতেখড়ি। এর পর তিন বছর মোহনবাগান অ্যাকাডেমিতে জো পল আনচেরির কাছে ছিলেন। তাতে আরও ঝকঝকে হয়েছেন। গত বছর দিপান্দা ডিকাদের দলের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য হন। খেলার তেমন সুযোগ পাননি। এ বার সুযোগ পেয়েই দরিদ্র পরিবারের ছেলে আলো ছড়াচ্ছেন। আর ডার্বিতে নেমেই গোল করে তো তিনি জন্মাষ্টমীর রাতেই ধ্রুবতারা।

‘‘উল্টোদিকে বিশ্বকাপার খেলছে এটা মাথায় রাখতে বারণ করেছিলেন আমাদের কোচ। বলেছিলেন, নিজের খেলাটা খেলতে। অরিজিতের (বাগুই) থেকে বল পাওয়ার পর তাই মাথা ঠান্ডা রেখেছিলাম। সামনে কে দাঁড়িয়ে ভাবিনি। এ রকম গোল তো আগেও করেছি।’’ বলার সময় ছোট্টখাট্টো লাজুক চেহারা থেকে বেরিয়ে আসে অদ্ভুত একটা আত্মপ্রত্যয়। যা তাঁকে আলাদা করে দেয় অন্যদের থেকে। আবার বলেন, ‘‘বাবা-মা কে গোলটা উৎসর্গ করছি। তবে ম্যাচটা যদি জিততে পারতাম তা হলে আরও আনন্দ হত,’’ বলার সময় মনে হয় গ্রামের ছেলে হয়েও শহুরে হাওয়ায় অভ্যস্ত হচ্ছেন পিন্টু।

মধ্যমণি: মোহন-শিবিরের গোল উৎসব। কিসেক্কাকে নিয়ে ডিকারা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

এমনিতে মেহতাব হোসেন তাঁর স্বপ্নের ফুটবলার। নিজে উইংয়ে খেলেন বলে বেঙ্গালুরুর তারকা উদান্তা সিংহের খেলা নকল করেন পিন্টু। আর রয়েড স্ট্রিটের ক্লাবের মেসে টিভি খুললেই দেখেন নেমারের খেলা। ‘‘বিশ্বকাপে ব্রাজিল হারার পর খুব কষ্ট হয়েছিল,’’ বলতে বলতে টিম বাসের দিকে পা বাড়ান পিন্টু। সামনে যে তাঁর দীর্ঘ পথ।

ডার্বি মাঝেমধ্যেই নতুন তারকার জন্ম দেয়। রবিন সিংহ, লালম পুইয়া, আজাহারউদ্দিন মল্লিক তার উজ্জ্বল উদাহরণ। এঁরা সাম্প্রতিক অতীতে এই ম্যাচে গোল করেই নায়ক হয়েছিলেন। পিন্টু কতদূর যেতে পারেন? মোহনবাগান কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তী হাসতে হাসতে বলে ফেললেন, ‘‘ভাল খেললেই তো আইএসএলে খেলতে চলে যাবে।’’ পরে বলছিলেন, ‘‘ছেলেটার মধ্যে খেলা আছে। ফ্রি কিক, কর্নারগুলো ভাল মারে।’’

২-০ এগিয়ে যাওয়ার পরও ম্যাচ জিততে না পারায় পিন্টুর মতো আফশোস রয়েছে পালতোলা নৌকার সওয়ারিদের। সে সব মাথায় না রেখে সবুজ মেরুন কোচ অবশ্য আগামীদিনের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছেন এ দিন থেকেই। বলছিলেন, ‘‘দু’দলেরই তিনটি করে ম্যাচ আছে। লিগটা জমে গেল। এখন সব ম্যাচই তো নক আউট। শেষ ম্যাচের আগে দুই দলের পয়েন্ট এক থাকলে একই দিনে ম্যাচ চাইব।’’ পাশাপাশি সংযোজন করলেন, ‘‘জেতা ম্যাচটা হেরে গেলাম দু’টো মুহূর্তের ভুলে। বিরতির পর অতিরিক্ত সময়ে ২-১ হয়ে যাওয়াটাই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে গেল। বিরতির পর মেহতাব হোসেনকে নামিয়ে মাঝমাঠকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলাম। ও তো চোট পেয়ে তিন মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে গেল।’’ কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন মেহতাব। এ দিন ম্যাচের পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। তাঁর হাতের হাড় ভাঙেনি। পেশী ছিঁড়ে গিয়েছে শুধু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE