Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অস্ট্রেলিয়ার জন্য ‘মাস্টারক্লাসে’ পৃথ্বী শ, ১৬ গজে ব্যাট করান সচিন

তরুণ ভিক্টর ট্রাম্পারকে প্রথম দিন দেখে স্যর ডব্লিউ জি গ্রেস নিজের ব্যাটে নাকি অটোগ্রাফ করে দিয়ে লিখেছিলেন ‘বর্তমান চ্যাম্পিয়নকে প্রাক্তন চ্যাম্পিয়নের উপহার’। 

গুরু: অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সচিনের কাছ থেকেই ক্রিকেট পাঠ নিয়ে গেলেন পৃথ্বী। ফাইল চিত্র

গুরু: অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সচিনের কাছ থেকেই ক্রিকেট পাঠ নিয়ে গেলেন পৃথ্বী। ফাইল চিত্র

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় 
মুম্বই শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৫
Share: Save:

তরুণ ভিক্টর ট্রাম্পারকে প্রথম দিন দেখে স্যর ডব্লিউ জি গ্রেস নিজের ব্যাটে নাকি অটোগ্রাফ করে দিয়ে লিখেছিলেন ‘বর্তমান চ্যাম্পিয়নকে প্রাক্তন চ্যাম্পিয়নের উপহার’।

রঞ্জি, দলীপ ট্রফি-সহ টেস্ট অভিষেকেও শতরানকারী ভারতীয় ব্যাটসম্যান পৃথ্বী শ’কে সে রকমই তাঁর প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে সফল হওয়ার টোটকা উপহার দিলেন সচিন তেন্ডুলকর।

শুক্রবার রাতেই পৃথ্বী মুম্বই ছেড়েছেন। অজিঙ্ক রাহানের ভারতীয় ‘এ’ দলের সঙ্গে উড়ে গিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশে। যাওয়ার আগে ভারতীয় ক্রিকেট আকাশে উদিত এই নতুন তারা নিয়ে গেলেন এমন একজনের পরামর্শ, যিনি তাঁর মতোই রঞ্জি ও দলীপ ট্রফিতে আবির্ভাব ম্যাচেই শতরান করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে জীবনের প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে পার্‌থে শতরান করা সচিনই এ বারের অভিযানের জন্য পৃথ্বীর ব্যাগে ভরে দিলেন অমূল্য পরামর্শ। তাও আবার হাতেকলমে।

শনিবার সকালে বান্দ্রার এমআইজি ক্লাবে গিয়ে সেই ঘটনা পুরো জানা গেল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সদ্য সমাপ্ত টেস্ট সিরিজ ও তার পরে বিজয় হজারে ট্রফিতে ডান কনুইয়ে চোট পেয়েছিলেন পৃথ্বী। বান্দ্রার এই ক্লাবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সময়ে অবসরে প্রস্তুতি নিতেন ‘মাস্টার ব্লাস্টার’। এই ক্লাবের অ্যাকাডেমি থেকেই উত্থান ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ২৯৩ নম্বর খেলোয়াড় পৃথ্বীর। যেখানে তাঁর কোচ ছিলেন চাঁদু ভাটকর এবং প্রশান্ত শেঠি। সেই চাঁদু স্যরকেই গত রবিবার সকালে ফোন করেন পৃথ্বী। জানান, অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে এমআইজি ক্লাবে গিয়ে প্রস্তুতি নিতে চান। যা শুনে তাঁর দুই ছোটবেলার কোচ তাঁকে সোমবার সকালে আসতে বলেন। নিজেদের অ্যাকাডেমির ফসল পৃথ্বীর অবারিত দ্বার এই ক্লাবে। ইংল্যান্ড সফরের আগেও এই ক্লাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন এই দুই কোচই। পৃথ্বী প্রস্তুতি নিতে চাইলে তাঁর জন্য নেট টাঙিয়ে নয়, মাঠের মাঝখানের পিচেই চলে মহড়া। কিন্তু গত সোমবার সকালে এমআইজি ক্লাবে গিয়ে পৃথ্বী জানতে পারেন নিজের অ্যাকাডেমির জন্য বান্দ্রার এই ক্লাবের মাঠ মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছেন সচিন তেন্ডুলকর। সেখানেই ‘তেন্ডুলকর মিডলসেক্স গ্লোবাল অ্যাকাডেমি’ (টিএমজিএ)-র জন্য মুম্বইয়ের নতুন খুদে ক্রিকেট শিক্ষার্থীদের খুঁজবেন সচিন ও বিনোদ কাম্বলি। মহা ফাঁপড়ে পড়ে পৃথ্বী এর পরেই যোগাযোগ করেন টিএমজিএ-র সিইও-র সঙ্গে। পৃথ্বী অনুশীলন করতে চান শুনে সেই ব্যক্তি বলে দেন, সচিন অনুশীলনে আসবেন সকাল সাড়ে ন’টায় তার আগে সকাল আটটা থেকে দেড় ঘণ্টা প্রস্তুতি নিতে পারেন পৃথ্বী। যা শুনে খুশি মনে বাড়ি ফেরেন ভারতীয় ক্রিকেটের এই নয়া তারকা। তখনও তিনি জানতেন না মঙ্গলবার সকালে তাঁর জন্য কী চমক অপেক্ষা করে রয়েছে।

সচিনের ছেলে অর্জুনের সঙ্গে পৃথ্বী খেলেছেন এমআইজি অ্যাকাডেমিতে। তা ছাড়াও পৃথ্বী ‘মাস্টার ব্লাস্টারের’ পছন্দের ক্রিকেটারও। অ্যাকাডেমির সিইও-র থেকে সচিন জানতে পারেন, মঙ্গলবার সকালে প্রস্তুতি নেবেন পৃথ্বী। তখনই তিনি ঠিক করে নেন, পৃথ্বীর প্রস্তুতি নিজে গিয়ে দেখবেন। যদিও এই তথ্য কাউকে জানাতে সিইও-কে বারণ করে দেন তেন্ডুলকর।

মঙ্গলবার সকালে পৃথ্বী মাঠে এসেছিলেন সকাল সাড়ে সাতটায়। প্যাড বেঁধে আটটার সময় মাঠে নামার সময়েই দেখেন সচিন মাঠের মাঝখানে চলে এসেছেন। পৃথ্বীকে দেখে সচিন বলেন, আজ বিশেষ কিছু অনুশীলনের জন্য তৈরি থাকতে। তার পরেই পৃথ্বীকে ব্যাট করতে বলে ক্লাবের দুই কোচকে ডেকে নেন সচিন। যাঁদের মধ্যে একজন তাঁর বন্ধু। নিজে ক্রিকেট খেলার সময় এই মাঠে এসে তাঁকে দিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বল ছুড়িয়ে ব্যাটিং প্রস্তুতি নিতেন সচিন।

পৃথ্বীর প্রস্তুতির শুরুতেই পিচের দৈঘ্য কমিয়ে ১৬ গজ করে দেন সচিন। তার পরে দুই কোচকে বলেন বল ছুড়তে। আম্পায়ারের জায়গায় দাঁড়িয়ে সচিন লক্ষ্য করতে থাকেন পৃথ্বীর ব্যাট নামানো। এ ভাবে তিরিশ মিনিট অনুশীলনের পরেই পৃথ্বীকে ডেকে সচিন বলেন, অস্ট্রেলিয়ায় বলের গতির মোকাবিলা করতে হবে। সঙ্গে বাউন্স। যে-হেতু পৃথ্বীর ‘ব্যাক লিফ্ট’ বেশি, তাই দ্রুত ব্যাট নামানো অনুশীলন করতে হবে। এবং, এই অনুশীলন রোজ করতে হবে। মাস্টার পৃথ্বীকে মনে করিয়ে দেন, অস্ট্রেলিয়ায় বোলাররা ক্রমাগত ব্যাটসম্যানকে ব্যাটফুটে বল করে হঠাৎ ফ্রন্টফুটে বল রেখে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। সেই বল বুঝতে না পেরে শট মারতে গিয়েই ব্যাটসম্যান উইকেট দিয়ে আসে। এর সঙ্গে সুইং মোকবিলা করার জন্য শরীরকে বলের কাছে নিয়ে গিয়ে খেলার পরামর্শও পৃথ্বীকে দেন সচিন।

এর পরেই গতিও ও বাউন্সের মোকাবিলা করার জন্য মাঠের এক কোণে অ্যাকাডেমির সিমেন্টের পিচে পৃথ্বীকে নিয়ে যান সচিন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর সেই বন্ধু ও পৃথ্বীর দুই কোচ। পিচে পাতলা ত্রিপল পেতে তার উপর পনেরো গজ দূর থেকে ভেজা টেনিস ও রবার বল ছুড়তে শুরু করেন সচিন নিজেই। পৃথ্বীকে বলেন, গতির হেরফের বুঝতে হবে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে। অফস্টাম্পের বাইরে বল আসবে। সেই বল ছাড়তে হবে। সেই সঙ্গে বুদ্ধি করে শট নির্বাচন করতে হবে। এ ভাবে আরও আধ ঘণ্টা অনুশীলন করানোর পরে আরও পনেরো মিনিট পৃথ্বীর সঙ্গে একান্তে কথা বলেন সচিন। যেখানে অস্ট্রেলীয় বোলারদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত মানসিকতা ধরে রাখার ব্যাপারে কিছু পরামর্শ তিনি দেন বলে শোনা গেল।

ওদিকে, মাস্টারের ক্লাসে পৃথ্বীকে দেখে তত ক্ষণে মাঠে ভিড় করে ফেলেছে খুদে ত্রিকেটার আর তাদের অভিভাবকেরা। পৃথ্বীকে বল করে অনুশীলন করাচ্ছেন সচিন— এই বিরল দৃশ্য দেখে অনেকেই ছবি ও ভিডিয়ো তুলতে গিয়েছিলেন। তাঁদের লোক মারফত ছবি তুলতে নিষেধ করেন সচিন। লোক মারফত বলে পাঠান, পৃথ্বীর কী অনুশীলন হচ্ছে তা মোবাইল মারফত নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক তা তিনি চান না। কারণ, এই ভিডিয়ো প্রচারমাধ্যমের হাত ঘুরে অস্ট্রেলিয়াতেও চলে যেতে পারে। এর কিছুক্ষণ পরেই নেটে ঢোকেন বিনোদ কাম্বলি। সারদাশ্রম স্কুলের হয়ে রেকর্ড করা যুগলবন্দির কাছ থেকে ক্রিকেট-পাঠ নিয়ে ফেরেন মুম্বইয়ের স্কুল ক্রিকেটের আঙিনা থেকে বেরিয়ে আসা নতুন নক্ষত্র।

সচিনের পরামর্শ মেনে পরের তিন দিন এক মনে অনুশীলন করে শুক্রবার রাতে মুম্বই ছেড়েছেন পৃথ্বী। পুরো ঘটনার সাক্ষী পৃথ্বীর শৈশবের কোচ প্রশান্ত শেঠি বলছেন, ‘‘একটি বিরল দৃশ্য দেখলাম। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পৃথ্বীর ব্যাটিং খুঁটিয়ে দেখছেন মাস্টার।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘এই ভিডিয়োটা পৃথ্বী চেয়েছিল, ওকে তা পাঠিয়ে দিয়েছি। এই দেড় ঘণ্টার অনুশীলন অস্ট্রেলিয়ায় কাজে লাগবে পৃথ্বীর।’’

তাঁর ‘ক্রিকেট-পতাকা’ বহন করার শক্তিও উত্তরসূরিকে দিচ্ছেন সচিন তেন্ডুলকর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE