Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
পিএসজির মাঠে অল্পের জন্য হয়নি বলিউডের শুটিং

মণীশ অরোরা, ফিল কলিন্সে বিশ্বায়নমুখী নেমারদের ক্লাব

রাত যত বাড়ে, কোথাও আইফেল টাওয়ার তাঁর মায়াবী চেহারায় নিজেকে তুলে ধরে, কোথাও গির্জা তাঁর গাম্ভীর্য ঢেকে দেয় আলোর রোশনাইয়ে। রাত যত বাড়ে সুন্দরী এই শহর নিজেকে আরও খোলামেলা করে তোলে। দেখাতে থাকে তার একই রঙ্গে বহুরূপ। 

 চমক: প্যারিস ফ্যাশন উইকে মণীশের ডিজাইন করা জার্সি।

চমক: প্যারিস ফ্যাশন উইকে মণীশের ডিজাইন করা জার্সি।

কৌশিক দাশ
প্যারিস শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৯ ০৪:০২
Share: Save:

রাত যত বাড়ে, সুন্দরীর রূপের ছটায় চোখ যেন আরও ঝলসে যায়।

রাত যত বাড়ে, কোথাও আইফেল টাওয়ার তাঁর মায়াবী চেহারায় নিজেকে তুলে ধরে, কোথাও গির্জা তাঁর গাম্ভীর্য ঢেকে দেয় আলোর রোশনাইয়ে। রাত যত বাড়ে সুন্দরী এই শহর নিজেকে আরও খোলামেলা করে তোলে। দেখাতে থাকে তার একই রঙ্গে বহুরূপ।

যেখানে সাহিত্য, শিল্প, ফ্যাশন, আবেগ আর ফুটবল কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যেখানে মেয়েদের ফুটবল দেখতে গ্যালারি ভরে যায়, আবার দেশের সেরা ক্লাবে গিয়ে আলোচনায় ডুব দিলে ফুটবলের চেয়ে বেশি উঠে আসে ফ্যাশন আর বিনোদনের কথা।

নেমার, এমবাপেদের ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যতটা ফুটবল, ততটাই ফ্যাশন আর ব্র্যান্ডিংয়ের চাকচিক্য। হয়তো বা ফুটবলের চেয়েও বেশি। প্যারিস সাঁ জাঁরমা— বিশ্বের প্রথম ক্লাব যেখানে ফুটবলের সঙ্গে ফ্যাশনের মেলবন্ধন ঘটেছে। তাই হয়তো নেমারদের কথা ওঠার আগে, এখানে উঠে আসে মণীশ অরোরার কথা! যে ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনার গত বছরই এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আর প্যারিস ফ্যাশন উইকের ক্যাটওয়াকে তুলে নিয়ে এসেছেন পিএসজি-কে। ‘‘মণীশের কাজ আমার দারুণ লাগে,’’ বলছিলেন ক্লাবের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর জাঁ মার্সিয়াল রাইবস, ‘‘প্রচুর রং, প্রচুর আবেগ, কিছুটা পাগলামো— সব মিলিয়ে ও আমাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।’’ কিন্তু ভারতীয় ডিজাইনার কেন? বিশেষ করে প্যারিসের মতো শহরে? এখানেই উঠে আসে ক্লাবের বিশ্বায়ন নীতি। যে নীতি বলে, ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার আগে পিএসজি ব্র্যান্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও গোটা বিশ্বকে। জানা যাচ্ছে, সাত বছর আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্লাব ভক্তের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ। যার মধ্যে আশি শতাংশই ফরাসি। এখন যে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে সাত কোটি। যার ৯৭ শতাংশই আন্তর্জাতিক পরিবারের। ভারত থেকে সংখ্যাটা বিশ লাখ। ৬২টি দেশে কোনও না কোনও ভাবে পা পড়েছে পিএসজির। ভারতে কাজ শুরু করেও আপাতত পিছিয়ে আসতে হয়েছে ঠিক সঙ্গীর অভাবে। পার্ক দে প্রাঁস। পিএসজির এই মাঠে নেমারের পা পড়ার অনেক আগে মাতিয়ে গিয়েছেন মাইকেল জ্যাকসন থেকে মিক জ্যাগাররা। লিয়োনার্দো দি কাপ্রিয়ো এখানে প্রায়ই আসেন। বিয়ন্সে নোলস শেষ বার এসে বিশেষ জার্সি পড়ার আব্দার করেছিলেন। উইল স্মিথ ক্লাবের অতিপরিচিত এক ব্র্যান্ডের জুতো নিয়ে এক ভিডিয়োই তৈরি করে ফেলেছেন। ‘‘এই তো সে দিন উয়েফা প্রেসিডেন্ট ফোন করে জানতে চাইছিলেন, কেন এত সেলিব্রিটি, এত তারকা আমাদের ক্লাবে আসেন,’’ বলছিলেন রাইবস।

সত্যিই তো, কেন আসেন? উত্তর আসে, শহরটার নাম ভুলে যাচ্ছেন কেন? এ শহরের নাম যে প্যারিস। মোহময়ী এই সুন্দরীর অমোঘ আকর্ষণ এড়াবে কে? এই মাঠেই আবার অল্পের জন্য হয়নি এক বলিউড ফিল্মের শুটিং! গত বছর কোনও এক বলিউড ফিল্মের শুটিংয়ের জন্য চাওয়া হয়েছিল পার্ক দে প্রাঁসকে। কিন্তু ওই সময় ম্যাচ থাকায় মাঠ দেয়া যায়নি। ক্লাব-বিশ্বায়নের দায়িত্বে থাকা রাইবসের মন্তব্য, ‘‘শুটিংয়ের অনুমতি দিতে পারলে আমাদেরই ভাল লাগত। ভারতে ক্লাবের প্রচারটা আরও বেশি হত।’’ কী নাম ছিল ফিল্মটার? অনেক মাথা চুলকেও মনে করতে পারলেন না ক্লাবকর্তা। ‘‘ই-মেলগুলো দেখতে হবে। হয় প্রেমের না হয় মারপিটের কোনও ফিল্ম ছিল। না হলে প্রেমের জন্য মারপিট, কিছু একটা হবে,’’ এক রাশ হাসির সঙ্গে জবাব এল।

বলিউডকেও ক্লাব-গ্যালারিতে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে পিএসজি। হয়তো বা কিছু দিনের মধ্যে সরকারি ভাবেই আমন্ত্রণ যেতে পারে। কাকে কাকে আপনাদের পছন্দ? ‘‘ওই যে আপনাদের এক অভিনেত্রী আছেন না, যার চোখ দুটো অদ্ভুত সুন্দর! আহা, কী যেন নামটা,’’ জাইবস আবার মাথা চুলকোতে শুরু করেন। পাশে বসা ফরাসি সুন্দরী মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘ঐশ্বর্যা রাই।’’

বিশ্বায়নের রাস্তায় বলিউড যুক্ত হতেই পারে পিএসজির সঙ্গে। প্রায় বছর পঁচিশেক আগে যেমন জুড়ে গিয়েছিল ফিল কলিন্সের নামটা। প্রাক্তন হয়ে যাওয়া ডেভিড বেকহ্যাম থেকে শুরু করে অধুনা নেমাররা যখন ক্লাব টানেল দিয়ে মাঠে নামেন, বাজতে থাকে ব্রিটিশ গায়ক ফিল কলিন্সের গান— ‘হু সেড আই উড’। ব্রিটিশ গায়কের গান ব্যবহার হচ্ছে ফরাসি ক্লাবের ফুটবলারদের তাতাতে? কী ভাবে বাছা হয়েছিল কলিন্সকে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এক এজেন্সিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তারা কিছু গান বেছে শোনায়। তৎকালীন ক্লাবকর্তা আর ফুটবলারদের মনে ধরেছিল এই গান। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, বিশ্বায়নের প্রথম ধাপটা ওখান থেকেই শুরু!

কিন্তু শুধু কি ফ্যাশন, বিনোদন আর বাণিজ্যিক ঘেরাটোপে আটকে আছে পিএসজি-র ফুটবল? নাকি আবেগের বিস্ফোরণও সমানে ঘটে ওই চামড়ার বলটা নিয়ে? বুধবার রাতে মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পিএসজি বনাম চেলসি কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ দেখতে দেখতে সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল। মেয়েদের ম্যাচ দেখতে ১২ হাজারের ওপর দর্শক। ফরাসি সময় সন্ধ্যা সাতটায় শুরু ম্যাচ। কিন্তু সঙ্গে থাকা ফরাসি লিগ ওয়ান কর্তাদের থেকে জানা গেল, দুপুর থেকে ভিড় জমতে শুরু করেছে। আর ম্যাচ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল গান। যার কাছাকাছি ইংরেজি তর্জমাটা এ রকম— ইউ ক্যান ডু ইট পিএসজি, ইউ ক্যান ডু ইট।’’ পাঁচ-সাত ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও কয়েক হাজার তরুণ খালি গায়ে ড্রাম বাজিয়ে গেয়ে চলেছেন সমানে। এই গ্রুপটা হল ‘আল্ট্রাস’। পিএসজির কট্টর সমর্থক। আইএসএল খেলে যাওয়া বার্নার্ড মেন্ডি পিএসজি মহিলা দলের সহকারী কোচ। মেন্ডির মেয়েরা অবশ্য ২-১ জিতেও পরের পর্বে যেতে পারলেন না। মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় দর্শকদের বিষণ্ণ মুখগুলো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এটাই তো আসল ছবি। যেখানে ফ্যাশন আর বিনোদনের সঙ্গে মিশে যায় ঘাম ঝরানো, দাঁতে দাঁত চাপা মরিয়া লড়াইয়ের কাহিনিও।

এটাই তো সুন্দরী প্যারিসের অমোঘ আকর্ষণ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE