Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

জীবনের মতো বাইশ গজেও লড়াকু কৌশিক

রঞ্জি ম্যাচ চলছে বলে অশোকনগর পর্যন্ত আর ফিরতে হচ্ছে না কৌশিক ঘোষকে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের উপরে একটি হোটেলে ছয় ফুট বাই আট ফুটের ছোট্ট ঘরে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে।

দুরন্ত: আবেশদের গতি সামলে সেঞ্চুরি কৌশিকের। নিজস্ব চিত্র

দুরন্ত: আবেশদের গতি সামলে সেঞ্চুরি কৌশিকের। নিজস্ব চিত্র

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৫:১২
Share: Save:

মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করার পরে ইডেন থেকে হেঁটে চাঁদনি চকে এলেন দিনের নায়ক! অন্যান্য দিন হলে হয়তো মেট্রো স্টেশনে হারিয়ে যেতেন এর পর। তার পর ঝুলতে ঝুলতে বনগাঁ লাইনের ট্রেন ধরে অশোকনগরে যাওয়া।

রঞ্জি ম্যাচ চলছে বলে অশোকনগর পর্যন্ত আর ফিরতে হচ্ছে না কৌশিক ঘোষকে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের উপরে একটি হোটেলে ছয় ফুট বাই আট ফুটের ছোট্ট ঘরে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। ম্যাচ শেষ হয়ে গেলেই আবার ভিড়ে ঠাসা বনগাঁ লোকাল ধরে বাড়ি ফিরবেন। এ ভাবেই কলকাতায় খেলা থাকলে প্রত্যেক দিন বাড়ি ফিরতে হয় তাঁকে।

দৈনন্দিন জীবনের লড়াই দেখা গেল সোমবার ইডেনের বাইশ গজেও। তাঁর লড়াকু ইনিংসের সৌজন্যে প্রথম দিনের শেষে ৮২ ওভারে চার উইকেট হারিয়ে বাংলা ২৪৬ রানের সম্মানজনক স্কোরে।

আরও পড়ুন
ইডেনে গতির পিচে ভরসা পেসাররাই

সকাল আটটার সময়েও কৌশিক জানতেন না সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবর্তে তিন নম্বরে নামতে হবে তাঁকে। টসে হেরে ব্যাটিং পাওয়ার পরে অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি তাঁকে তৈরি থাকার নির্দেশ দেন। দিনের ১৯ নম্বর ওভারে অভিষেক রামন (১৪) আউট হওয়ার পরেই নামতে দেখা যায় এক বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানকে। কিন্তু তিনি সুদীপ নন, কৌশিক। তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর টিকে থাকার লড়াই। ঠিক যে ভাবে মেন্টর অরুণ লাল তাঁদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আশার পরেই ব্যাটসম্যানদের টিকে থাকার প্রচেষ্টা আরও বেড়ে গিয়েছে।

শুধু মাঠেই নয়, জীবনেও এ ভাবেই লড়াকু ব্যাটিং করে টিকে রয়েছেন কৌশিক। বর্তমানে তাঁর বয়স ২৬ বছর। চার বছর আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু হয় ক্রিকেটপ্রেমী বাবার। তখন থেকে সংসারের সব দায়িত্ব কৌশিকের। বাবার মৃত্যুর আগে বড় দিদির বিয়ে হয়ে গেলেও ছোট দিদির বিয়ে নিজেই দেন কৌশিক।

জীবনের এই উত্থান-পতনে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন মা অনিতা দেবী। ভাল খেললে সবার প্রথমে মাকেই ফোন করেন। রান না পেলেও ছেলেকে কিছু বলেন না অনিতা দেবী। তাঁর শুধু একটাই বার্তা, ‘‘হেরে গেলে চলবে না। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।’’ তাই সোমবারের এই সেঞ্চুরি মা ও প্রয়াত বাবাকেই উৎসর্গ করতে চান কৌশিক। ম্যাচ শেষে বললেন, ‘‘বাবার ইচ্ছা ছিল, বাংলার হয়ে নিয়মিত খেলি। তিনি চলে যাওয়ার পরে জীবন খুব কঠিন হয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভেঙে পড়তে দেননি মা। এই সেঞ্চুরিটা তাঁদের দু’জনকেই উৎসর্গ করছি।’’

আরও পড়ুন
একগুচ্ছ রেকর্ড গড়ে মুশফিকুরের ডাবল সেঞ্চুরি

২০১৩-১৪ মরসুমে মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফি অভিষেক হয়েছিল কৌশিকের। তার পর থেকে মাত্র চারটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। গত মরসুমে ছত্তীসগঢ়ের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছিলেন। রান পেয়েছিলেন বিদর্ভের বিরুদ্ধেও। কিন্তু চর্মরোগ হওয়ার কারণে ডাক্তার রোদে বেরোতে বারণ করেন। এ মরসুমে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে প্রত্যাবর্তন ম্যাচে ১৮৯ বলে ১০০ রানের ইনিংসকেই জীবনের সেরা ইনিংস মনে করছেন কৌশিক। বলেন, ‘‘বিপক্ষের অভিজ্ঞ পেসারদের বিরুদ্ধে রান করতে পেরে ভাল লাগছে। এর আগে এত লড়াকু ইনিংস কখনও খেলিনি। তবে আউট হয়ে দলের বিপদ ডেকে এনেছি। আর পাঁচটা ওভার টিকতে পারলে কাল আরও রান করার সুযোগ থাকত।’’

ইডেনের পিচ যে রকম পেসারদের সাহায্য করে থাকে, সোমবারের পিচে সেই ধার দেখা যায়নি। শুরুর দু’ঘণ্টা পেসারেরা সাহায্য পেলেও তার সদ্ব্যবহার করতে পারেননি মধ্যপ্রদেশের দুই প্রধান পেসার আবেশ খান এবং ঈশ্বর পাণ্ডে। কুলদীপ সেনের বোলিং সব চেয়ে হতাশজনক। তিনি আউটসুইং বোলার। কিন্তু বল পিচ করাচ্ছিলেন অফস্টাম্পের এক হাত বাইরে। অনায়াসে তা সামলে নেন অভিমন্যু, কৌশিকেরা। ৪৯ বলে রামন ১৪ রান করে আউট হলেও তাঁর ইনিংস নতুন বলের বিষ উপড়ে ফেলতে সাহায্য করে। দিনের ১৯তম ওভারে আউট হন তিনি। অভিমন্যুর ১৭৩ বলে ৮৬ রানের ইনিংস মন্থর দেখালেও ঈশ্বর, আবেশদের ক্লান্ত করে তোলার জন্য তা যথেষ্ট ছিল। যার প্রভাব পড়ে তাঁদের ফিল্ডিংয়ে। সারা দিনে মোট চারটি ক্যাচ ফেলেন মধ্যপ্রদেশের ক্রিকেটারেরা। মনোজেরই ক্যাচ পড়ে দু’বার। প্রথমটি ১৯ রানে। দ্বিতীয়টি ২১ রানে। দিনের শেষে ৭০ বলে ৩১ রানে অপরাজিত মনোজ।

দিনের ৭৯তম ওভারে অফস্পিনার শুভম শর্মার বলে কাট করতে গিয়ে আউট হন কৌশিক। তার পরের ওভারেই মিহির হিরওয়ানির একটি ফ্লিপার বুঝতে না পেরে ফ্লিক করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন সুদীপ। শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফেরেন বাংলার সহ-অধিনায়ক। দিনের শেষে মনোজকে সঙ্গ দিচ্ছেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান অনুষ্টুপ মজুমদার (৭)। দ্বিতীয় দিনের শুরুতে তাঁদের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন বাংলার ক্রিকেটারেরা। কৌশিক বললেন, ‘‘মনোজদা ও রুকুদা (অনুষ্টুপ) কাল প্রথম এক ঘণ্টা টিকে যেতে পারলে ৪৫০ রানের গণ্ডিও পার হয়ে যেতে পারে। ওদের পরেই রয়েছে বিবেক (সিংহ) ও (বি) অমিত। দু’জনেই দ্রুত রান করে।’’ কৌশিকের লড়াই বাংলাকে সত্যিই কতটা এগিয়ে দিতে পারল, তা বোঝা যাবে মঙ্গলবার সকালের ব্যাটিং দেখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE