Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পুরস্কার অর্থ দেওয়া হবে মঙ্গলবার

বাবাকে সুস্থ করে তুলতে চান স্বপ্না, পুষ্টির সন্ধানে সুপ্রিয়

রাজ্য সরকারের দেওয়া টাকায় অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করাতে চান জাতীয় গেমসের সোনাজয়ী অ্যাথলিট জলপাইগুড়ির স্বপ্না বর্মন। নৌকোতে কাঠ বোঝাই করে এপার ওপার করা দরিদ্র সংসারের একমাত্র রোজগেরে পঞ্চানন বর্মন যে এখন আর যে কাজ করা দূরের কথা, হাঁটতেও পারেন না। পুষ্টিকর খাবারের পিছনেই পুরস্কারের টাকা খরচ করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন গেমসে তিনটি রুপোজয়ী সাঁতারু কোলাঘাটের সুপ্রিয় মণ্ডল।

সুপ্রিয় ও স্বপ্না। স্বপ্নপূরণের আশায়।

সুপ্রিয় ও স্বপ্না। স্বপ্নপূরণের আশায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৮
Share: Save:

রাজ্য সরকারের দেওয়া টাকায় অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করাতে চান জাতীয় গেমসের সোনাজয়ী অ্যাথলিট জলপাইগুড়ির স্বপ্না বর্মন। নৌকোতে কাঠ বোঝাই করে এপার ওপার করা দরিদ্র সংসারের একমাত্র রোজগেরে পঞ্চানন বর্মন যে এখন আর যে কাজ করা দূরের কথা, হাঁটতেও পারেন না।

পুষ্টিকর খাবারের পিছনেই পুরস্কারের টাকা খরচ করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন গেমসে তিনটি রুপোজয়ী সাঁতারু কোলাঘাটের সুপ্রিয় মণ্ডল। বেঙ্গালুরুতে এখন ট্রেনিং নিচ্ছেন সঞ্জীব চক্রবর্তীর এই ছাত্র। কিন্তু যে প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার খেলে আর্ন্তজাতিক মঞ্চে সফল হওয়ার শক্তি সঞ্চয় করা যায়, সেটা পান না বছর আঠারোর বাংলার প্রতিশ্রুতিমান এই সাঁতারু।

দিল্লি, হরিয়ানা, পঞ্জাব, মণিপুরের সঙ্গে পাল্লা দিতে এ বছর থেকে রাজ্য সরকার জাতীয় গেমসের পুরস্কারজয়ীদের জন্য প্রায় সমমানের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। সোনা, রুপো এবং বোঞ্জ জয়ীদের জন্য যথাক্রমে পাঁচ, তিন ও দু’লাখ টাকা। মঙ্গলবার দুপুরে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির চত্বরে এক অনুষ্ঠানে পদকজয়ীদের হাতে তা তুলে দেবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই পুরস্কার নিতে আসছেন সুপ্রিয়-স্বপ্নার মতো প্রায় শ’খানেক খেলোয়াড়। যাঁদের বেশির ভাগই আবার গ্রামগঞ্জের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা অ্যথলিট।

কেরলে জাতীয় গেমসে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই স্বপ্নার বাবা পঙ্গু। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় পরিবারের মেয়ে রাজ্যের সবথেকে প্রতিভাবান অ্যাথলিট স্বপ্না, কিছু দিন আগে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন অন্য একটি কারণেদু’পায়ের ছ’আঙুল নিয়েও একের পর এক পদক জিতে। ট্র্যাকে দৌড়নোর মতো বড় জুতো নেই বলে সমস্যা হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও পি টি উষার রাজ্য থেকে একটি সোনা ও একটি রুপো জিতেছেন সাইয়ের এই মেয়ে। আপাতত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী স্বপ্না জলপাইগুড়ির সাহাপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে বলছিলেন, “আট লাখ টাকা সত্যিই পাব তো? বিশ্বাসই হচ্ছে না। টাকাটা খুব দরকার। বাবাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। মাটির বাড়িটারও খুব খারাপ অবস্থা। সোমবার পরীক্ষা আছে। সেটা দিয়েই ট্রেনে উঠে পড়ব কলকাতার জন্য।” আপাতত চোটের জন্য অনুশীলন বন্ধ রেখেছেন কোচের পরামর্শে। কেরলেই সোনা জেতার পর লুটিয়ে পড়েছিলেন মাটিতে। পিঠের যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। ভিকট্রি স্ট্যান্ডে উঠতে সময় নিয়েছিলেন। বলছিলেন, “হেপ্টাথলন ইভেন্টের শেষ পর্বে নানা ভাবে আমাকে আটকানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আমার জেদ চেপে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম পদক পেতেই হবে। জিততে হবে সোনা। এটা পেলেই তো বাবাকে সুস্থ করে তুলতে পারব। ভাল খাবার খেতে পারব।”

‘ভারতের অলিম্পিক’ জাতীয় গেমসের আগে প্রতি বছর টাকার টোপ দিয়ে বাংলার অ্যাথলিটদের নিয়ে যেত অন্য রাজ্য। এ বার তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। স্বপ্নার মতো সেই টোপ ছিল সাঁতারু সুপ্রিয়র জন্যও। কিন্তু তিনি যাননি। বাংলার প্রাক্তন দুই অ্যাথলিট দম্পতি সঞ্জীব চক্রবর্তী ও বুলা চৌধুরীর ছাত্র সুপ্রিয় এ বারের গেমসে সোনা পাননি ঠিকই। কিন্তু জিতেছেন সর্বাধিক পদক। তিনটি রুপো এবং একটি ব্রোঞ্জ। যে ক’জন অ্যাথলিট এ বার গেমসে পদক জেতার জন্য আর্থিক পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক টাকা পাচ্ছেন সুপ্রিয়। এগারো লাখ। বেঙ্গালুরু থেকে ফোনে কোলাঘাটের ছেলেটি বললেন, “আমি এখানে অনুশীলনের জন্য একটা স্টাইপেন্ড পাই। কিন্তু ঠিকমতো খাবার জোটে না। বাবা আর কত টাকা দেবেন। বছরে কোচের নির্দেশমতো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার পেতে প্রায় চার-পাঁচ লাখ টাকা লাগে। এখন তিন বছর আমি নিশ্চিন্ত।” আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট থেকে পদক আনবেন বলে রেলের চাকরিতে যোগ দেননি, প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেও বেঙ্গালুরুতে আধুনিক ট্রেনিং নিচ্ছেন। “চাকরি নিইনি কারণ ওটা নিলে পদক জয়ের ইচ্ছেটাই চলে যাবে। বাইরে ট্রেনিং নেওয়াও হবে না।” বলছিলেন সুপ্রিয়।

মোট কুড়িটি ইভেন্টে এ বার দল পাঠিয়েছিল বাংলা। তার মধ্যে ১১টিতেই পদক এসেছে। ৬টি সোনা জেতায় সর্বভারতীয় র্যাঙ্কিংয়ে পনেরো নম্বরেই আটকে থাকতে হয়েছে এই রাজ্যকে। বাংলা সব মিলিয়ে পেয়েছে ৬টি সোনা, ১২টি রুপো, ৩০টি ব্রোঞ্জ। ফুটবল, টেবল টেনিস, তিরন্দাজির ব্যর্থতা ঢেকে দিয়েছে লনবল, বক্সিং, জিমন্যাস্টিক্স। পৌলমী ঘটক, মৌমা দাস, জয়দীপ কর্মকারদের ব্যর্থতা ঢেকে দিয়েছেন স্বপ্না, বিপিনকুমার, সুপ্রিয়, মধুরিমারা। বেঙ্গল অলিম্পিক সংস্থার সচিব চন্দন রায়চৌধুরী দাবি করলেন, “প্রায় এক কোটি আঠাশ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে বাংলার পদক জয়ীদের। সর্বাধিক পাঁচ লাখ, সর্বনিম্ন পঁচিশ হাজার।” শহর ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অ্যাথলিটরা আসবেন বলে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে দুপুরে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হবে দক্ষিণেশ্বর মন্দির সংলগ্ন পার্কিং লটে।

স্বপ্না-সুপ্রিয়-তনুকারা দুপুর দু’টোয় মঞ্চে উঠবেন এক-একটি রঙিন স্বপ্ন নিয়ে। চেক নেওয়ার সময় কারও চোখে থাকবে আনন্দাশ্রু শুধু বাবার জন্য, কারও পরিবারের জন্য, কারও বা আরও পদকের জন্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE