স্বপ্নপূরণ: চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উৎসব রিয়াল কাশ্মীর এফ সি-র। ফাইল চিত্র
ধ্বংসের মধ্য থেকেই সৃষ্টির স্বপ্ন!
বছর চারেক আগের ঘটনা। ভয়ঙ্কর বন্যায় বিধ্বস্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য। লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন। অধিকাংশ সরকারি দফতর প্রায় দশ ফুট জলের নীচে। প্রত্যেক মুহূর্তে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এক দিকে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাতাসে বারুদের গন্ধ। অন্য দিকে ভয়াবহ বন্যা। ভূস্বর্গ যেন মৃত্যু উপত্যকা!
শ্রীনগরের একটি অংশ অবশ্য সেই ভয়াবহ বন্যাতেও সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু তাতে কী? পুরো শহর যে জলের তলায়। তাই কার্যত গৃহবন্দি হয়েই থাকতে হয়েছিল সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই ফুটবল বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন শামিম মেহরাজ। স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর ক্লাব আই লিগে খেলবে। ২০১৬-য় আত্মপ্রকাশ রিয়াল কাশ্মীর এফ সি-র। দু’বছরের মধ্যেই আই লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূল পর্বে যোগ্যতা অর্জন করল রিয়াল কাশ্মীর।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বেঙ্গালুরু থেকে শ্রীনগরে ফিরে ফোনে স্বপ্নপূরণের আশ্চর্য কাহিনি শোনালেন রিয়াল কাশ্মীর এফ সি-র কর্ণধার শামিম। বললেন, ‘‘শ্রীনগরে আমাদের বাড়িটা ছিল অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায়। তাই বন্যার সময় জল জমেনি। কিন্তু শহরের অন্যান্য অংশ জলের নীচে চলে যাওয়ায় আমাদের কিছু করার ছিল না। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতে বেরোতাম। অবাক হয়ে দেখতাম, ছোট ছোট ছেলেরা খেলাধুলো না-করে চুপ করে বসে রয়েছে রাস্তার ধারে। ওদের জন্য এক হাজার ফুটবল কিনলাম। ক্লাব গড়ার ভাবনাও মাথায় এল।’’
কিন্তু রিয়াল কাশ্মীরের আবির্ভাব তো ২০১৬-য়। এত দেরি হল কেন? শামিমের কথায়, ‘‘প্রথম থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল, ক্লাব গড়ব আই লিগ খেলার জন্য। আমরা চেয়েছিলাম, পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে নামতে। তাই দু’বছর লেগে গিয়েছিল রিয়াল কাশ্মীরকে গড়ে তুলতে।’’ ক্লাবের নাম কেন রিয়াল কাশ্মীর, তার ব্যাখ্যাও দিলেন শামিম। বললেন, ‘‘অনেকের মনে হতে পারে, রিয়াল মাদ্রিদের আদলে ক্লাবের নামকরণ হয়েছে। তা কিন্তু একেবারেই নয়। আমাদের লক্ষ্য ভারতীয় ফুটবলের মানচিত্রে কাশ্মীরকে প্রতিষ্ঠা করা। প্রমাণ করা, কাশ্মীরের ছেলেরাও ফুটবল খেলতে পারে। কাশ্মীর মানে শুধুই অশান্তি বা অস্থিরতা নয়, সুন্দর ফুটবলও।’’ বুধবার বেঙ্গালুরুতে আই লিগ দ্বিতীয় ডিভিশনের ফাইনালে হিন্দুস্থান এফ সি-কে ৩-২ হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রিয়াল কাশ্মীর। যে সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে বাংলার চার ফুটবলারের অবদানও। এঁরা হলেন, সুমন দত্ত, অয়ন দাসশর্মা, ঋত্বিক কুমার দাস ও আভাস থাপা। মোহনবাগানের প্রাক্তন মিডফিল্ডার সুমন চোটের জন্য প্রায় দেড় বছর মাঠের বাইরে ছিলেন। রিয়াল কাশ্মীরের হয়ে খেলেই দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন কল্যাণীর সুমন। ফোনে বললেন, ‘‘কাস্টমসের হয়ে কলকাতা লিগে খেলেছি। তার পরে রিয়াল কাশ্মীরে সুযোগ পাই। এই ক্লাব আমাকে পুনর্জন্ম দিয়েছে।’’
ভারতীয় ফুটবলে রিয়াল কাশ্মীরের সাফল্য যতই চমকপ্রদ হোক, উত্থানের পথ কিন্তু একেবারেই মসৃণ ছিল না। কখনও বরফ, কখনও প্রবল বৃষ্টি। এর সঙ্গে বাড়তে থাকা রাজনৈতিক অস্থিরতায় মাঝেমধ্যেই পণ্ড হয়ে যায় অনুশীলন। ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন তারকা ইসফাক আমেদ বলছিলেন, ‘‘কাশ্মীর যতটা সুন্দর, ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর। আমার শৈশবের দিনগুলো মনে পড়লে এখনও আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। অনুশীলন করতে যাব, হঠাৎ গুলির শব্দ ও মানুষের আর্তনাদ কানে ভেসে এল। প্রাণ বাঁচাতে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তাম।’’ তিনি যোগ করলেন, ‘‘অনুশীলন করতে করতেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমাদের বাড়িটা মাঠের খুব কাছে ছিল বলে রক্ষে। কিন্তু আমাদের অ্যাকাডেমির অনেকেই নিয়মিত অনুশীলনে আসতে পারত না।’’
ইসফাক এখন অবসরের মুখে। আইএসএলে জামশেদপুর এফ সি-র সহকারী কোচের দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্তু কাশ্মীরের পরিস্থিতি বদলায়নি। শামিম অবশ্য রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চান না। তবে অনুশীলন করতে গিয়ে যে পদে পদে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, গোপন করেননি। বললেন, ‘‘শ্রীনগরের যা আবহাওয়া তাতে কৃত্রিম ঘাসের মাঠ ছাড়া সারা বছর অনুশীলন করা সম্ভব নয়। অথচ পুরো শ্রীনগরে মাত্র একটাই কৃত্রিম ঘাসের মাঠ। সেখানে অনুশীলন করে দশটা দল! আশা করছি, আমাদের এই সাফল্য দেখে সরকার ফুটবল পরিকাঠামোর উন্নয়নে উদ্যোগী হবে। আরও কয়েকটা কৃত্রিম ঘাসের মাঠ তৈরি করবে।’’
রিয়াল কাশ্মীরের সাফল্য আবার ইসফাক-কেও সমস্যায় ফেলে দিয়েছে! ভারতীয় দলের প্রাক্তন তারকা বললেন, ‘‘কোচিংয়েই মনোনিবেশ করব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু এখন আমার লক্ষ্য, অবসর নেওয়ার আগে রিয়াল কাশ্মীরের হয়ে আই লিগ খেলা!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy