সবার উপরে। কোচকে নিয়ে প্লেয়ারদের উচ্ছ্বাস। রবিবার কোচিতে। ছবি: পিটিআই
আইএসএলে আগেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এটিকে। তখন কোচ ছিলেন হাবাস। কিন্তু রবিবার রাতের পর আমার বলতে দ্বিধা নেই, হাবাসকে মলিন করে দিয়েছেন মলিনা।
কেন এটিকের দুই বিদেশি কোচের মধ্যে এ বারের চ্যাম্পিয়ন টিমের কোচকে এগিয়ে রাখছি তা বলতে গেলে আমি প্রথমেই বলব, দু’জনের হাবভাবের কথা। হাবাস নিশ্চিত ভাবে দক্ষ কোচ। তবে ফুটবলসম্রাট পেলে একটা কথা বলেছিলেন। চ্যাম্পিয়ন ফুটবলারদের মতো কোচকেও বিনয়ী হতে হয়। মলিনা এই জায়গায় হাবাসের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
একটা উদাহরণ দিই। এ দিন যখন ফাইনালের টাইব্রেকার শুরু হচ্ছে, টিভি ক্যামেরা এক ঝলক ধরল মলিনাকে। দেখলাম ওই ভয়ঙ্কর চাপের পরিস্থিতির মধ্যেও মলিনা বিপক্ষ কোচ স্টিভ কপেলকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। মুখে লাজুক হাসি। সেখানে আটলেটিকোর গত দু’বারের কোচ হাবাস তাঁর ইগো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। নিয়মিত খবরের কাগজে পড়েছি, কখনও তাঁর সঙ্গে জিকোর ঝামেলা বেঁধেছে। কখনও রবার্ট পিরেসের সঙ্গে হাতাহাতি। কতই না ঘটনা! মলিনাকে সেখানে দেখুন। মুম্বইয়ে এ বার অ্যাওয়ে সেমিফাইনালে বেলেনকোসোর সঙ্গে বিপক্ষ ফুটবলারের হাতাহাতি। টিভি ফুটেজও কিন্তু বলছে, এটিকে কোচ তাতে জড়িয়ে না পড়ে বরং আগুনে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছেন।
নিজে একটু-আধটু ফুটবল কোচিং করানোর সুবাদে জানি, একজন কোচকে সবার আগে ম্যান ম্যানেজমেন্টে মাস্টার হতে হয়। এটিকের কয়েক জন ভারতীয় ফুটবলারের কাছেই শুনেছি, হাবাসের সময় টিমের ড্রেসিংরুম নাকি ছিল প্রায় আগ্নেয়গিরি! স্বদেশি-বিদেশি ফুটবলারদের মধ্যে বিষোদগার চলত। মলিনা জমানায় কিন্তু স্বদেশি বা বিদেশি ব্রিগেড বলে কোনও আলাদা গ্রুপ তৈরি হয়েছে বলে আমাকে কেউ বলেনি। মলিনা নিজেও বলেছেন, ওঁর কোনও ফার্স্ট ইলেভেন নেই। টিমের চব্বিশ জনই প্রথম দলের ফুটবলার। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবহার করেন। এটাই একজন কোচের ম্যান ম্যানেজমেন্ট। ইগো না দেখিয়েও বুঝিয়ে দিতে পারেন, কে টিমের ব্যান্ড মাস্টার!
শুনেছি হাবাস নাকি অনেক ফুটবলারকে নামানোর সাহস পেতেন না। বেচারা ক্লাইম্যাক্স লরেন্স। প্রথম বার আইএসএল চ্যাম্পিয়ন এটিকে দলে থাকলেও একটাও ম্যাচে সুযোগ পায়নি। মলিনা প্লেয়ারদের উপর আস্থা রাখতে পারেন বলেই মাত্র এক গোলে এগিয়ে থেকেও অ্যাওয়ে সেমিফাইনালে আগের ম্যাচের প্রথম এগারোর ন’জনকে বদলে দেওয়ার হিম্মত দেখাতে পারেন।
টিম কী ভাবে গড়ে তুলবেন, সে ব্যাপারেও দুই কোচের মধ্যে মলিনাকে এগিয়ে রাখব। প্রথম মরসুমে জোফ্রের ট্রফি জেতার পিছনে ভূমিকা ছিল। তাকে পরের বার স্কোয়াডেই রাখেননি হাবাস। স্টপার জোসেমি চোট পেয়ে ছিটকে গিয়েছিল। কিন্তু তার কোনও বিকল্প বার করতে পারেননি হাবাস। সেখানে মলিনাকে দেখুন এ বার। পাবলো চোট পেয়ে ফিরে গেল শুরুতে। কোচ সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এল সেরেনোকে। সেই ছেলেই মাথা ফাটা নিয়ে খেলে রবিবারের ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ। প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ সমতাও ফেরাল হাফটাইমের আগে গোল করে।
আমার মনে হয়, মলিনার আর একটা গুণ সমালোচনা সহ্য করতে পারা। এ বার এটিকে ডিফেন্সে বারবার বদল, হামেশা ম্যাচ ড্র নিয়ে কত সমালোচনা হয়েছে। মলিনা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। নিজের কাজটা ঠিক করে গিয়েছেন। কলকাতা এ বার হেরেছে মোটে দু’বার। টিমের মধ্যে এই ফিলোজফি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন, জিততে না পারো, হেরো না।
সঙ্গে জুড়ব মলিনার ট্যাকটিক্স তৈরি রাখাকে। কখনও জাভি লারাকে পরে নামিয়ে তাঁর দূরপাল্লার শটে ম্যাচ বার করা। লারা ট্র্যাক ব্যাক করতে সময় নেয় বলে পিয়ারসনকে ডাবল পিভট বানিয়ে দেওয়া বোরহার সঙ্গে। চমৎকার স্ট্র্যাটেজিও ওঁর। টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা মার্কি মালুদা যাতে ডিফেন্স চেরা থ্রু বাড়াতে না পারে তার জন্য দিল্লি ম্যাচে ওর গায়ে বোরহাকে সেঁটে দেওয়া। এগুলো যত দেখেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি।
হাবাস সেখানে সেই আল্ট্রা ডিফেন্সিভ, কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফুটবল ছেড়ে বেরোতে পারেননি। আর একঘেঁয়ে সেই স্ট্র্যাটেজিটা বিপক্ষ কোচেরা ধরে ফেলায় এ বার পুণেতে আদৌ সফল হননি হাবাস। মলিনা সেখানে ফোরলানের মতো তারকা বিশ্বকাপারের ফ্রিকিক আর তাকে শূন্যে আটকাতে কখনও দেবজিৎকে বসিয়ে স্প্যানিশ কিপার ড্যানিকে নামান। কখনও সুনীল-সনিদের মিডল করিডরে আটকাতে সেখানে নিজের ছ’ফুটের বিদেশি ফুটবলার নামিয়ে গোলের দরজা বন্ধ করে দেন।
রবিবারও দেখলাম ম্যাচে কলকাতার গোল যে কর্নার থেকে হল সেটা নেওয়ার সময় কেরল ডিফেন্স সেকেন্ড পোস্টে ডিফেন্ডার রাখেনি। টিভিতে দেখলাম মলিনা সে দিকেই ইঙ্গিত করলেন বার বার। আর হেডে সে দিকে প্লেসিং করেই তো সেরেনোর গোল শোধ।
সব দেখেশুনে তাই বলতে হবে, হোমওয়ার্ক আর ম্যাচ রিডিংয়ের জোরে নিজের প্রথম বছরেই হাবাসকে পিছনে ঠেলে দিলেন মলিনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy