Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ষোলো বছরে নজির বিস্ময়-শুটারের, সোনা জিতেও ট্র্যাক্টর চালাতে চায় সৌরভ

নজির: কনিষ্ঠতম ভারতীয় শুটার হিসেবে সোনা সৌরভের। ছবি: এএফপি।

নজির: কনিষ্ঠতম ভারতীয় শুটার হিসেবে সোনা সৌরভের। ছবি: এএফপি।

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ০৪:০৫
Share: Save:

ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাওয়ার সময় বাবার সর্ষে বা গমের খেত পাখিরা এসে নষ্ট করছে দেখলেই গুলতি বের করে তাদের উড়িয়ে দিত বছর বারোর ছেলেটি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হত না বেশিরভাগ কাঠের টুকরো।

সেটা দেখেই দাদা নীতিনকুমার তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দেন তিপান্ন কিলোমিটার দূরের বাগপতের বীর শাসমল রাইফেল ক্লাবে। শুটিং শেখার জন্য।

সৈয়দ মামুদ মেমোরিয়াল স্কুলের ক্লাস এইটের সে দিনের সেই ছাত্র সৌরভ চৌধরি মঙ্গলবার জার্কাতায় এশিয়ান গেমসের মঞ্চে সোনার ছেলে হয়ে উদিত হল। শুটিং ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনা করে। পুরুষদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে তাবড় অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়নদের হেলায় হারিয়ে সোনা জিতল মেরঠের কলিনগাওয়া গ্রামের ছেলে।

মাত্র ষোলো বছর বয়সে এশিয়াডের সোনা! তাও একাদশ শ্রেণির এক স্কুল ছাত্রের। ভারতীয় খেলাধুলার ইতিহাসে অবিশ্বাস্য এই ঘটনার পর দেশ যখন উত্তাল, তখন অদ্ভুত রকম শান্ত কৃষক পরিবারের ছেলে সৌরভ। জার্কাতায় যখন ভারতীয় সময় বিকেল চারটেয় অনেক চেষ্টা করে ফোনে ধরা গেল তখন আর পাঁচটা গ্রাম্য ছেলের মতোই খিদের জ্বালায় অস্থির সে। বলছিল, ‘‘সেই সকালে সোনা জিতেছি। প্রায় সাত ঘণ্টা পর সেটা হাতে পেলাম। দারুণ খিদে পেয়েছে। এখনই বাড়িতে (পড়ুন গেমস ভিলেজ) ফিরে কিছু খেতে হবে। আর দাঁড়াতে পারছি না। বিস্কুট আর জল খেয়ে কতক্ষণ থাকা যায়।’’

ভারতীয় শুটিংয়ে চমকপ্রদ উত্থান বর্তমানে একাদশ শ্রেণিতে পড়া সৌরভের। হাতে পিস্তল তুলে নেওয়ার তিন বছরের মধ্যেই এশিয়ার সেরা। সঙ্গে ২৪০.৭ পয়েন্ট করে নতুন গেমস রেকর্ড। শুধু আলিম্পিক্সে পদক জেতা অভিনব বিন্দ্রাই নন, যশপাল রানা, জিতু রাই, রনধীর সিংহের মতো দেশের তারকা শুটাররাও যে কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি এই বয়সে।

‘‘আমার কোনও চাপ ছিল না। বাড়ি থেকে রেঞ্জে আসার আগে সোনা বা কোনও পদকের কথা একবারের জন্যও ভাবিনি। অনুশীলনে যেমন মারি তেমনই মেরেছিলাম। তাতেই সোনা এসে গেল,’’ বলার সময় গলায় কোনও উচ্ছ্বাস নেই তার। ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা সৌরভের কথাগুলো যেন কেমন নির্লিপ্ত শোনায়। মনে হয়, এশিয়াডের সোনার পদকটা যে কতটা মহার্ঘ, দেশের জার্সিতে কতটা সম্মানের, সেটা এখনও বুঝতে পারেনি সে। প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেরা যেমন হয় কথাগুলো সে রকমই। না হলে অকপটে কেউ বলে ‘‘আমি চাষ করতে খুব ভালবাসি। বাবার সঙ্গে ট্র্যাক্টর চালাই। মাটিতে গম গাছের চারা লাগাই। গ্রামে ফিরে গিয়ে আবার সেটা করব। বাবাকে সাহায্য করব।’’

সৌরভের সোনা জেতার কিছুক্ষণ পরেই ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা অলিম্পিক্সে ব্যক্তিগত বিভাগে একমাত্র সোনা জয়ী অভিনব বিন্দ্রা টুইট করেছেন, ‘‘আসাধারণ সাফল্য। দুর্দান্ত প্রতিভা। অলিম্পিক্সের জন্য দেশের ভবিষ্যৎ।’’ সেটা তাঁকে জানানোর পর সৌরভ পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, ‘‘ওই স্যর কি শুটার ছিলেন?’’ জানালেন, নামী শুটিং তারকাদের মধ্যে দিল্লিতে একবার শুধু গগন নারাংকে দেখছেন।

তোমার আদর্শ কে জানতে চাইলে সৌরভের জবাব, ‘‘কেউ নয়। আমার বাড়িতে কোনও শুটারের ছবি নেই। তবে জিতু রাইকে আমার ভাল লাগে।’’ অক্টোবরেই তাঁকে নামতে হবে আর্জেন্টিনার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। এ দিন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে পদক প্রদান অনুষ্ঠান হতে কয়েক ঘণ্টা দেরি আছে শুনে সৌরভ ফের অনুশীলন শুরু করে দিয়েছিল ফাঁকা রেঞ্জ পেয়ে। কোচেরা এসে তাকে নিরস্ত্র করেন। পদক জেতার উচ্ছ্বাস উপভোগ না করে, কেন নেমে পড়েছিলে রেঞ্জে? সৌরভের সাদামাঠা জবাব, ‘‘অক্টোবরে আবার তো নামতে হবে রেঞ্জে। আজ থেকেই ওটার জন্য অনুশীলন শুরু করে দিয়েছিলাম।’’ তোমার স্বপ্ন কী? এই প্রশ্ন শুনে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘‘তেমন কিছু নেই।’’ পরে একটু ভেবে বলে দেয়, ‘‘অলিম্পিক্সের পদক।’’

সৌরভ যে কিছু করতে পারে সেটা বোঝা গিয়েছিল জুন মাসেই। জার্মানিতে জুনিয়র আইএসএসএফ জুনিয়র বিশ্বকাপে রেকর্ড গড়ে সোনা জেতার পরে। তার ছোটবেলার কোচ অমিত পাথরনের কাছে নিয়মিত পাঁচ-ছয় ঘণ্টা অনুশীলন করে সৌরভ। পড়াশুনা, চাষ সঙ্গে বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে অনুশীলন! কী ভাবে তুমি এত জিনিস সামলাও? সৌরভ বলে দেয়, ‘‘হয়ে যায়। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দাদা খেতে কাজ করে। বাবা-দাদা-মা আমাকে সব ঠিক করে দেয়।’’

গ্রামের সরল ছেলের মুখে হাসি খেলে যায়। সরল হাসি। যা সোনার চেয়েও মনে হয় দামি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE