Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
কোন ওভারে কত রান, কত রানরেট সবই আছে প্রস্তাবে

অ্যাশেজের মধ্যেই গড়াপেটার কালো ছায়া ক্রিকেটে

গোপন ক্যামেরায় অভিযুক্ত জুয়াড়িদের একজন হিমাচল প্রদেশে জন্ম হওয়া সোবার্স জোবান। হিমাচল এবং দিল্লির হয়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৪:২১
Share: Save:

অ্যাশেজে পার্‌থ টেস্ট শুরুর দিনেই ফের গড়াপেটার বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল ক্রিকেট। ইংল্যান্ডের ট্যাবলয়েড ‘দ্য সান’-এর গোপন অভিযানে উঠে এসেছে বিস্ফোরক সব তথ্য। গড়াপেটা অপারেশনের কেন্দ্রে রয়েছে দুই ভারতীয় জুয়াড়ি। গড়াপেটা চক্রে তাই ফের উঠে এসেছে ভারতীয় ক্রিকেট বাজারের ভূমিকা।

গোপন ক্যামেরায় অভিযুক্ত জুয়াড়িদের একজন হিমাচল প্রদেশে জন্ম হওয়া সোবার্স জোবান। হিমাচল এবং দিল্লির হয়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিংবদন্তির অনুসরণে নামকরণ থেকেই অনুমান করা যায়, ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। লেগস্পিন, গুগলি বল করত জোবান। আপাতত তার ‘ফিক্সিং গুগলি’-তেই বোল্ড ক্রিকেট! জোবানের বাবা যদিও ইংল্যান্ডের ট্যাবলয়েডের প্রকাশ করা চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, তাঁর ছেলে নির্দোষ।

তবে ট্যাবলয়েডের দাবি, ক্রিকেটারের পরিচিতি কাজে লাগিয়ে গড়াপেটায় সক্রিয় হয়েছিল জোবান। কেউ যাতে সন্দেহ না করে তার জন্য ঘরোয়া ক্রিকেটারদের এখন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে জুয়াড়িরা। কোনও বর্তমান ক্রিকেটারকে দুর্নীতিতে টানতে গেলে তাঁর পরিচিত এই অনামী, ঘরোয়া ক্রিকেটার ‘মিডল ম্যান’ হয়ে উঠতে পারে।

জোবানের সঙ্গে এই গড়াপেটার অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে আরও দুই ভারতীয়। এক জনকে ডাকা হয়েছে ‘মিস্টার বিগ’ নামে। ধরে নেওয়া হচ্ছে, এই ব্যক্তি ক্রিকেট জুয়ার অন্যতম প্রধান মস্তিষ্ক। অন্যজন দিল্লি-নিবাসী তামাক ব্যবসায়ী প্রিয়ঙ্ক সাক্সেনা। গোপন ভিডিওতে এরা দাবি করেছে, একটি সেশনকে ‘ফিক্স’ করতে গেলে ৬০ লক্ষ টাকা লাগবে। দু’টো সেশনের জন্য ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। গোপন ক্যামেরা অভিযানের ভিডিওতে জোবানকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘কোন ওভারে কত রান হবে, সে সব করিয়ে দেব। কখন উইকেট পড়বে, বলে দেব। টসে জিতলে কোন টিম কী করবে, আগে থেকে জেনে যাবে তোমরা।’’

আরও পড়ুন : ফুল স্লিভ জার্সিতে লুকিয়ে থাকে বেটিংয়ের ইশারা

ক্রিকেটে এই সব বিষয়গুলির উপরেই কোটি কোটি টাকার বেটিং হয়। আগে থেকে জানা থাকলে সেই মতো ‘বেট’ লাগিয়ে প্রচুর টাকা কামাতে পারে কোনও ব্যক্তি। আর সেটা নিশ্চিত করতেই ক্রিকেটারদের টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার দুর্নীতিও রয়েছে। সেটাকেই বলে গড়াপেটা বা ‘ম্যাচ ফিক্সিং’।

অ্যাশেজে গড়াপেটা করার প্রসঙ্গও এসেছে। জোবান-রা ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের বলে, ‘‘অ্যাশেজ টেস্টে যদি ফিক্স করতে চাও, করিয়ে দেব। কোন সেশনে কী ঘটবে, তার উপরে কাজ হতে পারে।’’ এর পরের অংশ আরও রোমহর্ষক। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে সক্রিয় এক ‘সাইলেন্ট ম্যান’-এর কথা বলে দুই ভারতীয় জুয়াড়ি। জোবান প্রস্তাব দেয়, আগ্রহী থাকলে ‘সাইলেন্ট ম্যান’-এর সঙ্গে কথা বলবে প্রিয়ঙ্ক। সন্দেহ করা হচ্ছে, ‘সাইলেন্ট ম্যান’ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে গড়াপেটার কোনও ‘পাণ্ডা’। দুর্নীতিগ্রস্ত ক্রিকেটারের সঙ্গে ‘লিঙ্ক’ হিসেবে এই ব্যক্তি কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা উঠছে।

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা গড়াপেটার এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁসে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও জানিয়েছেন, এ নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনও প্রমাণ নেই কারও বিরুদ্ধে। আইসিসি-র হাতে পুরো রিপোর্ট তুলে দিয়েছে ‘দ্য সান’। ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা জানিয়েছে, তারা সব কিছু খতিয়ে দেখছে। তবে সরাসরি কোনও ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে প্রমাণ নেই গড়াপেটার। আইসিসি আরও জানিয়েছে, চলতি অ্যাশেজ সিরিজের কোনও টেস্টে গড়াপেটা হয়েছে বলেও প্রমাণ নেই। পার্‌থ টেস্টেও জুয়াড়িরা সক্রিয় বলে তাঁরা মনে করছেন না। যদিও গোপন অভিযানের ভিডিওতে রয়েছে, ভারতীয় জুয়াড়িরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, টস থেকেই গড়াপেটা শুরু হয়ে যাবে। এমন কথাও তারা বলেছে যে, অস্ট্রেলীয় জুয়াড়িরা ‘এই ম্যাচটি’ কিনে নেবে। তবে কোন ম্যাচের কথা বলা হয়েছে, সেটা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। জোবান-রা ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের জানিয়ে দেয়, কত ওভার পরে কত রান হবে তা সাফ সাফ বলে দেওয়া হবে। যেমন ১০ ওভার, ৩৬ রান। সেই মতোই ‘খেলা’ হবে। বিনিময়ে তাদের প্রাপ্য টাকাটা দিয়ে যেতে হবে ভারতে এসে।

বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া পার্‌থ টেস্টেই স্পট ফিক্সিং করার কথা হয়েছিল কি না, তা এখনও অপরিষ্কার। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্‌থের কোনও ম্যাচ ভারতের ক্রিকেট বাজারে বেশি আকর্ষণীয় হতেই পারে। অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য শহরের চেয়ে পার্‌থের সঙ্গে ভারতের সময়ের ব্যবধান অনেক কম। মাত্র আড়াই ঘণ্টার ব্যবধান থাকায় ভারতের বাজারে পার্‌থের ম্যাচ নিয়ে হাইস্পিড টেলিফোন বেটিং সওদার পরিমাণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।

দিল্লি এবং দুবাইয়ে প্রায় চার মাস ধরে চলা গোপন অভিযানে ‘দ্য সান’-এর সাংবাদিকদের সামনে দুই ভারতীয় জুয়াড়ি আরও প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা ম্যাচের যে কোনও সময়ের গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করে স্পট ফিক্সিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। কথোপকথনের সময় এক জুয়াড়ি এমনও দাবি করে যে, প্রাক্তন এবং বর্তমান অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গেই সে কাজ করেছে। তার মধ্যে একজন বিশ্বকাপজয়ী অলরাউন্ডার।

তাদের কিনে নেওয়া ক্রিকেটারেরা মাঠে দাঁড়িয়ে নানা ভাবে সঙ্কেতও দেবে বলে ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের জানায় জুয়াড়িরা। আইপিএলে শ্রীসন্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল পকেট থেকে তোয়ালের রুমাল বের করে সিগন্যাল করার। এখানে হেলমেট হাত দিয়ে তুলে ধরা, লাল ঘড়ি পরা বা গ্লাভস বদলের মতো ইশারার কথা বলা হয়েছে। মাঠ থেকে কোনও খেলোয়াড় এ সব করে সঙ্কেত দেওয়া মানেই, আগে থেকে ঠিক করা স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী শুরু হয়ে যাবে বেটিংয়ের খেলা।

গোপন ভিডিওতে ভারতীয় জুয়াড়ি ‘মিস্টার বিগ’-কে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘ম্যাচের আগে আমি তোমাদের বলে দেব, অমুক ওভারে এই পরিমাণ রান হবে। তোমরা তার পর ওই ওভারের উপর সমস্ত বেটিংয়ের টাকা লাগাবে।’’ পরিচয় গোপন রাখা সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন করেন, এই স্পট ফিক্সিংয়ের সূত্র কি ভরসা করার মতো? জুয়াড়ির জবাব, ‘‘এক হাজার শতাংশ নিশ্চিত থাকতে পারো।’’ এর পর ‘দ্য সান’-এর রেকর্ডেড টেলিফোন কলে জোবান-কে বলতে শোনা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় ‘সাইলেন্ট ম্যান’-এর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। ‘গড়াপেটা হবে’।

কথাটা হয়তো প্রতীকি হয়ে থেকে যাচ্ছে ক্রিকেটে— গড়াপেটা চলবে!

কীভাবে হচ্ছে ফিক্সিং

• নতুন এসেছে ‘মিডল ম্যান’ প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা।
• ভারতে প্রতি বছর এখন ৮ লক্ষ ৬৩ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা মূল্যের বেআইনি বেটিং হয় বলে খবর।
• ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে দুনিয়া ব্যাপী সতর্কতার জেরে পাল্টে গিয়েছে জুয়াড়িদের অপারেশনের ভঙ্গিও।
• গড়াপেটা নিয়ন্ত্রণকারীদের সর্বোচ্চ স্তরে এখনও আছেন মাফিয়া ডন-রা। অ্যাশেজের গড়াপেটা বিস্ফোরণেও নাম উঠেছে ডি-কোম্পানির।
• ক্রিকেটারদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পরিষ্কার ভাবমূর্তি থাকা ব্যক্তিদের ‘মিডল ম্যান’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
• পরিষ্কার ভাবমূর্তি থাকা ব্যক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্দেশে ‘মিডল ম্যান’ হিসেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাছা হচ্ছে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের। মনে করা হচ্ছে, সোবার্স জোবান-কে আনা হয়েছিল সেই লক্ষ্য নিয়েই।
• প্রাক্তন ক্রিকেটার হোটেলে বা মাঠে বর্তমান ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেখা করলে বা কথা বললে কেউ সন্দেহ করবে না। এই কারণেই তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মত।
• অধিকাংশ ক্ষেত্রে জুয়াড়িরা এখন সরাসরি ক্রিকেটারদের কাছে যায় না। ‘মিডল ম্যান’-এর মাধ্যমে তাদের হাতে ‘স্ক্রিপ্ট’ পাঠিয়ে দেয়। ‘স্ক্রিপ্ট’ মানে তাতে সবিস্তার লেখা থাকবে, কী ধরনের ফিক্সিং করতে হবে।

গ্যালারিতে সক্রিয় ‘স্পটার’

• জুয়াড়িদের পক্ষ থেকে এখন বিভিন্ন মাঠে হাজির হয়ে যাচ্ছে ক্রিকেট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বিশেষজ্ঞরা। এদের বেটিং সার্কিটে বলা হয় ‘স্পটার’।
• টিভি-তে ম্যাচের সম্প্রচার হতে কয়েক সেকেন্ড সময় বেশি লাগে। মাঠে বসে থাকলে টিভি-র আগেই দ্রুত জেনে নেওয়া সম্ভব, কী ঘটছে।
• বিক্রি হয়ে যাওয়া ক্রিকেটার বা অধিনায়ক সঙ্কেত দিলেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্যালারি থেকে খবর দিয়ে দেবে ‘স্পটার’।

ক্রিকেটারদের সঙ্কেত

• বোলারের ক্ষেত্রে ফুলস্লিভ জার্সি পরে বল করাটা একটা সঙ্কেত।
• ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে তেমনই গ্লাভস বদল করার মানে হতে পারে জুয়াড়িদের বলা, আমি তৈরি।
• ফিল্ডার তেমনই মাঠের একটি জায়গায় রাখা হেলমেট সরিয়ে আবার তা যথাস্থানে রেখে দিতে পারে।
• কোনও কোনও ক্রিকেটার লাল রংয়ের ঘড়ি পরেন সঙ্গেত দেওয়ার জন্য, দাবি করেছেন জোবান।
• কোনও কোনও বোলার অত সরাসরি সঙ্কেত দিতে সাহস পান না। তাঁদের জন্য বিকল্প, ওয়াইড বল করা। জোরে বোলার হলে মাথার উপর দিয়ে অনেক উঁচুতে বাউন্সার দিয়ে এই ওয়াইড বলটি করা হতে পারে।
• বল করার জন্য দৌড় শুরু করে থেমে যাওয়ার সঙ্কেতও ব্যবহার করা হয়। এই টোটকা ব্যাটসম্যানও কাজে লাগাতে পারেন। একই ভাবে সাইটস্ক্রিনে অসুবিধের ইঙ্গিত করে বোলারকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে।

কী নিয়ে হয় বেটিং

• ওভারে ন্যূনতম কত রান হবে। • রানরেট মন্থর করে দেওয়া। • ইচ্ছা করে উইকেট হারানো। • সরাসরি ফলকে প্রভাবিত করা। • টসে জিতলে ব্যাটিং না ফিল্ডিং করবে দল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE