Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

হঠাৎ শশাঙ্ক-যুগের পথে বোর্ড

জগমোহন ডালমিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর মতোই আকস্মিক তাঁর উত্তরাধিকার! যেমন রাজ্য ক্রিকেটে, তেমনই জাতীয় ক্রিকেটে। গোটা ক্রিকেট-ভারতকে আলোড়িত করে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর স্থানীয় উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হওয়ার পর এ বার জাতীয় ক্রিকেটেও ডালমিয়া-পরবর্তী মুখ বেছে নেওয়ার কাজটা বেসরকারি ভাবে সেরে ফেলা হল। তিনি— আগামী মঙ্গলবার যাঁর আটান্নতম জন্মদিন, সেই নাগপুর নিবাসী শশাঙ্ক মনোহর এক রকম অভিষিক্তই হয়ে গেলেন নতুন বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

শশাঙ্ক মনোহর

শশাঙ্ক মনোহর

গৌতম ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

জগমোহন ডালমিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর মতোই আকস্মিক তাঁর উত্তরাধিকার! যেমন রাজ্য ক্রিকেটে, তেমনই জাতীয় ক্রিকেটে।
গোটা ক্রিকেট-ভারতকে আলোড়িত করে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর স্থানীয় উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হওয়ার পর এ বার জাতীয় ক্রিকেটেও ডালমিয়া-পরবর্তী মুখ বেছে নেওয়ার কাজটা বেসরকারি ভাবে সেরে ফেলা হল। তিনি— আগামী মঙ্গলবার যাঁর আটান্নতম জন্মদিন, সেই নাগপুর নিবাসী শশাঙ্ক মনোহর এক রকম অভিষিক্তই হয়ে গেলেন নতুন বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
শশাঙ্কের শুভানুধ্যায়ীরা শনিবার রাতে বলছিলেন, বিসিসিআই খুব বিপজ্জনক জায়গা। যে কোনও কিছু যে কোনও সময় ঘটতে পারে। দোহাই এখনই শশাঙ্কের নাম চূড়ান্ত বলে লিখে দেবেন না। শশাঙ্ক নিজেও এই মুহূর্তে মুখ খুলতে ইচ্ছুক নন। ভাবী বোর্ড প্রেসিডেন্টকে যখন ধরা গেল শনিবার রাতে, তখন তিনি মহাবালেশ্বরে। পরিবারের সঙ্গে এগারো দিনের ছুটিতে। ছুটি দু’বার বিঘ্নিত হয়। প্রথম বার যখন ডালমিয়ার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তিনি কলকাতা উড়ে আসেন। দ্বিতীয় বার, গত পরশু রাতে যখন বোর্ড সচিবের আমন্ত্রণে তাঁকে যেতে হয় দিল্লিতে অরুণ জেটলির বাড়ি।
অরুণ জেটলি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যতই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক সামলান না কেন, যতই উপ-প্রধানমন্ত্রীসুলভ ব্যস্ততা তাঁর থাকুক না কেন, ভারতীয় ক্রিকেটের রিমোট কন্ট্রোল এখনও তাঁরই হাতে।
এখনও জেটলি যা বলেন তা-ই হয়। ক্ষমতার লড়ালড়িতে তিনিই চূড়ান্ত নির্ণায়ক। এ হেন জেটলি বৃহস্পতিবার রাতে নিজের বাড়িতে বসে শশাঙ্ককে বলেন, ‘‘আমি চাই আপনি ভারতীয় বোর্ডের হাল ধরুন। এই কঠিন সময়ে আপনাকেই দরকার।’’ সে সময় সেখানে ছিলেন প্রাক্তন বোর্ড কোষাধ্যক্ষ অজয় শিরকে এবং বোর্ড সচিব অনুরাগ ঠাকুর। শিরকে তখন বলেন, ‘‘শশাঙ্ক, তোমার কিন্তু ‘না’ করা উচিত নয়।’’ রাতের বৈঠকে উপস্থিত থাকা এঁরা সবাই একমত হন যে, ডালমিয়া অনেক কিছু সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। যা আধুনিক সময়ে ক্রিকেট বোর্ডের বিশেষ প্রয়োজন। বিশেষ করে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন নানান বিশৃঙ্খলা তৈরি করে যাওয়ার পর তো আরওই প্রয়োজন। কিন্তু যাবতীয় ইচ্ছে থেকেও ডালমিয়া সেই সংস্কারগুলো করতে পারেননি স্রেফ শেষ দিকের ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য। জেটলি বলতে থাকেন, শশাঙ্ক এই পদ নিলে বোর্ড নতুন গরিমা পাবে। আর ডালমিয়ার ইচ্ছেগুলোও মর্যাদা পাবে।

শশাঙ্ক এক কথায় রাজি হননি। শেষ যে বার বোর্ড প্রেসিডেন্ট ছিলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বলে গিয়েছিলেন, ‘‘আর কখনও বোর্ডের ত্রিসীমানাতেই আসব না।’’ সৎ এবং বলিষ্ঠ প্রশাসক হিসেবে তিনি এতটাই পরিচিত যে, তাঁর এই বয়ানকে কেউ ফাঁকা গুলি হিসেবে ভাবেনি। এ দিনও তিনি বলেন যে, ‘‘আমি পাঁচ বছর বোর্ড থেকে একেবারে দূরে। কী হচ্ছে না হচ্ছে দৈনন্দিন কিছুই জানি না। ওপর-ওপর জানি। এত দিন দূরে সরে থেকে দুম করে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঠিক করে চালাতে পারব কি না, সেটা নিয়ে আমাকে একটু ভাবতে হবে।’’ এই কথাকে কেউ নাটক হিসেবে ধরেনি। বাকিদের পীড়াপীড়িতে এর পর শশাঙ্ক বলেন, আমার সময় চাই। আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা দিন। তখন অনুরাগ ঠাকুর বলতে থাকেন, ‘‘অরুণজি ওঁকে একদম সময় দেবেন না। এখনই ওঁকে রাজি হতে বলুন।’’ জেটলি বলেন, ‘‘ঠিক আছে। ও যখন চাইছে সময় দেওয়া হোক।’’

এর পরেও মনোহর কিছুটা বিব্রত ছিলেন, যে হেতু তাঁর গোষ্ঠীরই শরদ পওয়ার বারবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। তাঁর আগ বাড়িয়ে নাম আসাটা লজ্জাকর হচ্ছিল। শশাঙ্ক এমন একটা অবস্থায় সাইডলাইন থেকে আচমকা উঠে এলেন, যেখানে ডালমিয়ার ফেলে যাওয়া মুকুটের জন্য তিন জন প্রতিদ্বন্দ্বী। তিন জনই স্টার্টিং ব্লকে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন।

শরদ পওয়ার।

রাজীব শুক্ল।

অমিতাভ চৌধুরি।

রাজীব এঁদের মধ্যে মুকুটের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। শোনা যাচ্ছিল জেটলির স্নেহধন্য হিসেবে তিনিই বসে যেতে পারেন বোর্ড প্রেসিডেন্টের চেয়ারে। কিন্তু রাজীবের সমস্যা হচ্ছিল, তিনি পওয়ার গোষ্ঠীর ভোটগুলো জোগাড় করতে পারছিলেন না।

পওয়ার— তিনি গোটা ন’দশেক ভোট জোগাড় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু জেটলির সম্মতি না পাওয়ায় বিজেপি-ভোটের দরজা তাঁর সামনে খুলছিল না।

আর ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থার প্রধান অমিতাভ চৌধুরি ছিলেন বকলমে শ্রীনির প্রার্থী। অমিতাভ চাইছিলেন ট্যাকটিক্যালি ম্যাচ জিততে। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে, যাতে পূর্বাঞ্চলের ছ’টা রাজ্য থেকে প্রস্তাব তোলা এবং সমর্থন করার লোক না পান পওয়ার-শুক্লরা। অমিতাভ আনন্দবাজারকেও বলেছিলেন, ‘‘কেন পূর্বাঞ্চলের লোক পূর্বাঞ্চলের ফেলে যাওয়া পদ পূর্ণ করবে না? তার মানে কি আমরা ধরে নেব গোটা পূর্বাঞ্চলে প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য লোকই নেই?’’

কিন্তু এই আবেগে বাকি ক্রিকেট-ভারতকে তিনি প্রভাবিত করতে পারেননি। বোর্ডে এই মুহূর্তে যা হাওয়া, তাতে শ্রীনির পছন্দের কোনও প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা আসা খুবই শক্ত। পওয়ার— তাঁকেও গত কাল শিরকে গিয়ে বলে আসেন, ‘‘আপনি দাঁড়ালে নির্বাচন হবে। আপনার সমর্থনে বিজেপির ভোট আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি না। সে ক্ষেত্রে শশাঙ্কই বোধহয় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।’’ পওয়ার সেই যুক্তি মেনে নেন, যতই তাঁর কাছে তা অপ্রিয় হোক। শ্রীনির সঙ্গে বৈঠক করে তিনি নিজের ভোট আর শ্রীনির ভোট জড়ো করেছিলেন। কিন্তু বিজেপির ভোট না পেলে যে নির্বাচন জেতা অনিশ্চিত, সেটা পওয়ার খুব ভালই জানেন। আর রাজীব শুক্লকে অর্ধেক লোকই বিশ্বাস করেন না।

সুতরাং সাইডলাইনে বসে থাকা শশাঙ্কই হয়ে যান সকলের গ্রহণযোগ্য প্রার্থী। এমন কেউ, যিনি দাঁড়ালে নির্বাচন হওয়ার আশঙ্কা নেই।

এ দিকে ‘আমি রাজি আছি’— এটা বলার জন্য শশাঙ্ক শনিবার অরুণ জেটলিকে ফোনও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ফোন বেজে যায়। শশাঙ্কের ধারণা হয় তখন জেটলি ডালমিয়ার বাড়িতে আছেন, তাই ফোন ধরতে পারছেন না। তিনি অজয় শিরকেকে বলে দেন, ‘‘অরুণজিকে বলে দেবেন আমি রাজি।’’ ওই সময়ই আলিপুর রোডের বাড়িতে বসে অভিষেক ডালমিয়া বলছিলেন জেটলিকে, ‘‘মনোহরের প্রতি আমাদের পুরো সমর্থন আছে। আর যে-ই হোক, শ্রীনি কিছুতেই নয়।’’ অভিষেককে খুব পছন্দ করেন জেটলি। তিনি আশ্বাস দেন, ডালমিয়া পরিবারের আবেগ মাথায় রাখা হবে।

আগামী ৪ অক্টোবরের মধ্যে বোর্ডের বিশেষ সাধারণ সভা ডাকা হবে। সেই সভাই শশাঙ্কের মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী রাজীব শুক্ল এর মধ্যেই ফোনে ভাবী বোর্ড প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিয়েছেন, শশাঙ্ক দাঁড়ালে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। বরং তাঁকে সব রকম সাহায্য জানাতে রাজি আছেন। শশাঙ্কের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার কাছাকাছি সময় ইডেনে সিএবির বিশেষ সাধারণ সভা বসার কথা। যেখানে আবার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম প্রেসিডেন্ট হিসেবে চূড়ান্ত হবে। সৌরভকে খুব পছন্দ করেন মনোহর। সৌরভ যখন ভারতীয় কোচ হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন মনোহর বলেছিলেন, ‘‘ওর কি মাথা খারাপ নাকি? ও কেন ভাবছে না যে, আমি বোর্ড প্রশাসনে এমন জায়গায় যাব যেখানে আমি নিজে কোচ ঠিক করব। কোচ হব না।’’

পূর্বাঞ্চল থেকে সৌরভের সিএবি-ই যদি শশাঙ্কের নাম প্রস্তাব করে, তা হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। ডালমিয়া তখন ওপরে বসে নির্ঘাত স্বস্তিতে থাকবেন যে, বাংলা আর ভারতীয় ক্রিকেট একই লাইনে চলছে।

আর শ্রীনি? তাঁর কী হবে? তিনি কি আইসিসিতে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যেতে পারবেন সেপ্টেম্বরে? অনেকেই মনে করছেন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তাঁর মনোনয়ন খারিজ করে চরমপন্থী শশাঙ্ক যাবেন আইসিসি বৈঠকে।

জিজ্ঞেস করায় রাতে শশাঙ্ক বললেন, ‘‘উফ আপনারা পারেন বটে! একটা জিনিস ঘটতে না ঘটতেই পরেরটা!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE