১) হামলার পর অন্য গাড়িতে করে স্টেডিয়ামে আক্রম। ২) ক্যাম্প চলছে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। ৩) আক্রমের জবানবন্দি নিচ্ছে পুলিশ। ৪) সেই আক্রান্ত মার্সিডিজ। ছবি এএফপি।
আশপাশের লোকজন যদি ঠিক সময় চেঁচিয়ে না উঠতেন, তা হলে কী হত ভাবলেই শিউরে উঠছে ক্রিকেটবিশ্ব।
আর আমাদের পাকিস্তানের অবস্থা তো প্রথমে আরও খারাপ ছিল। শুরুটা করেছিলেন আমাদের এখানকার এক জনপ্রিয় টেলিভিশন অ্যাঙ্কর। ঘটনাটার কথা শুনেই টুইট করে বসেছিলেন, ‘ওয়াসিম আক্রমকে হত্যা করার চক্রান্ত!’
করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের কাছের যে রাজপথে ঘটনাটা ঘটেছে, আমি তখন সেখান থেকে মাত্র কয়েক মিনিট দূরে। শাহিদ আফ্রিদির একটা প্রোগ্রাম ছিল, ওটা কভার করছিলাম। হঠাৎ শুনি এই ব্যাপার।
তখনই ওয়াসিমকে ফোন করলাম আর ওর গলা শুনে আমিও একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এত বছর ওকে চিনি, কোনও দিন ওর গলায় এ রকম আতঙ্ক শুনিনি। ও যে অক্ষত আছে, সেটুকু জেনে নিয়ে তাই তখন আর ওকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না।
ততক্ষণে ভূকম্পনের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। ফেসবুক-টুইটার খুলে দেখলাম, ওয়াসিম আক্রম নিয়ে পরপর প্রতিক্রিয়া আছড়ে পড়ছে। বিহ্বল প্রশ্ন উঠছে, করাচির মতো জনবহুল শহরের রাস্তায় দিনের আলোয় এক মহাতারকার উপর যদি এমন ভয়াবহ হামলা হতে পারে, তা হলে দেশের সাধারণ মানুষ কতটা নিরাপদ? কয়েক মুহূর্তের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ঢুকতে শুরু করল ক্রিকেট জগতের নানা নক্ষত্রের। ইমরান খান থেকে অনিল কুম্বলে, শাহিদ আফ্রিদি থেকে রামিজ রাজা— ক্রিকেটবিশ্ব, বিশেষ করে পাকিস্তান ক্রিকেটমহল, সরব হয়ে উঠেছে।
একটু পর খবর পেলাম, ওয়াসিম ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে পৌঁছে গিয়েছে। ওখানে একটা বোলিং ক্যাম্প চলছে, যেখানে আসবে বলেই করাচির ওই রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিল। তা সেখানে পৌঁছে ওয়াসিমের সঙ্গে খোলাখুলি সব কথা হল। তখন ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, বেশ ক্লান্ত। প্রচণ্ড উত্তেজনার পরে যে রকম অবসন্ন লাগে, বোধহয় তেমন কিছুর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
আমাকে বলল, ‘‘আরে, হঠাৎ করে একটা গাড়ি আমার মার্সিডিজের ডান দিকে ধাক্কা মারল। আমি তখনই রাস্তায় নেমে গাড়িটাকে আটকানোর চেষ্টা করলাম, আমার গাড়িটা তুবড়ে যাওয়া নিয়ে বলব বলে।’’ তার পর? ‘‘কী বলব, অনুতাপ দেখানো দূরের কথা, একটা লোক গাড়ি থেকে বেরিয়েই বন্দুকে গুলি ভরে আমার দিকে তাক করল।’’ একটু থেমে আবার বলল, ‘‘জানো, প্রথমে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবে দেখো তো, কেউ তোমার দিকে বন্দুক তাক করে গুলি করতে যাচ্ছে!’’
থ্রিলারের মারণ থাবা থেকে মুক্তি এল খুব সাধারণ ভাবে। অকুস্থলে জমে যাওয়া ভিড় থেকে কেউ কেউ চেঁচিয়ে ওঠেন বন্দুকধারীর উদ্দেশ্যে, ‘‘আরে, কাকে গুলি মারছ? উনি ওয়াসিম আক্রম!’’ শুনে বন্দুক ঘুরে যায়। গুলিটা আক্রমের গায়ে নয়, লাগে ওর গাড়ির চাকায়। পরের কয়েকটা আকাশের দিকে। ওয়াসিম বলছিল, ওকে চিনতে পেরেছিল বলেই হয়তো বেঁচে গিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে কাছের থানায় গিয়ে এফআইআর দায়ের করে ওয়াসিম। দুষ্কৃতীর গাড়ির নম্বরও বলে। পরে শুনলাম, করাচি পুলিশ গাড়িটা উদ্ধার করেছে। জানা গিয়েছে, তা উজেইর আহমেদ নামক কারও নামে রেজিস্টার করা। পুলিশের বিশ্বাস, দ্রুত দুষ্কৃতীকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
সব মিলিয়ে মিনিটপাঁচেকের ঘটনা। কিন্তু তার রেশ বুধবার দুপুর থেকে রাত— একটা গোটা দিন ধরে বারবার আতঙ্কে কাঁপিয়ে দিল আমাদের! নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিল জঙ্গিহানায় বিধ্বস্ত আমাদের দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে।
আর এমন একটা সময়, যখন আমাদের দেশের অবস্থা কিছুটা ভালর দিকে এগোচ্ছিল। জানেন তো, দু’মাস হল এখানে মিলিটারি অপারেশনস চলছে। আর বিশ্বাস করুন, তার পর থেকে এখানে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেক কমে গিয়েছে।
ওয়াসিম এখানকার সবচেয়ে বড় টিভি চ্যানেল জিও টিভির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। ও প্রথমে ওদের বলেছিল যে, এটা হয়তো গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা। কিন্তু ওই যে বললাম, এখানে ও রকম ঘটনা মাসখানেক ঘটেনি, তাই অনেকেই প্রথমে সেটা বিশ্বাস করতে চাননি। তার উপর কিছু টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখানো হতে থাকে যে, এটা টার্গেট কিলিং। মানে, নির্দিষ্ট কাউকে হত্যা করার চেষ্টা।
টুইটারে প্রতিক্রিয়া। সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।
ক্ষোভ-অসহায়তা-হতাশা-ঘৃণা মিশে ততক্ষণে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হওয়ার দিকে এগোচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত এগোল না, ওয়াসিমের জন্যই। ও নিজেই পরে বলল, এটা ‘রোড রেস’-এর রেশ। মানে গাড়ির চালকদের মধ্যে প্রায়ই যে রকম রেষারেষি ঘটে থাকে, সে রকম একটা ঘটনার চরম নিদর্শন।
‘‘এটা রোড রেস দুর্ঘটনা। শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে এর কোনও যোগাযোগ নেই। এটা বিশ্বের যে কোনও শহরেই ঘটতে পারত। গাড়ি চালানোর সময় সবাই-ই তাড়াহুড়োয় থাকে। বাকিদের ওভারটেক করতে চায়,’’ বিবৃতি দিয়েছে ওয়াসিম। তার পর আবার আপনাদের শহরকে টেনে এনে বলেছে, ‘‘কলকাতায় এক বন্ধুর সঙ্গে গাড়িতে কোথাও যাওয়ার সময়ও এ রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু বাকি বিশ্বের চেয়ে আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে অস্ত্র রাখেন আর ব্যবহার করেন। তাই ভয় করে।’’
পরে শুনলাম আরও বলেছে, ‘‘যেখানেই থাকি না কেন, কোথাও যাওয়ার সময় চেষ্টা করি দশ মিনিট আগে বেরোতে। যাতে তাড়াহুড়োয় ড্রাইভ না করতে হয়। আমার ভক্তদেরও সেটাই বলব। সতর্ক ভাবে গাড়ি চালান, কারণ প্রাণ হারানোর চেয়ে দেরি করে আপনার গন্তব্যে পৌঁছনো ঢের ভাল!’’
ওয়াসিম বলছে বটে, কিন্তু বিশ্ব জুড়ে এই প্রতিক্রিয়া অত সহজে থামবে কি? মনে হয় না। ভাবতে খুব খারাপ লাগছে যে, আমাদের দেশ যে গত কয়েক মাস এতটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল, সেটা বিশ্বের খুব বেশি লোক জানতে পারলেন না। তাঁরা জানলেন এই একটা ঘটনার কথা। জানলেন, এ দেশে সন্ত্রাসের বিষাক্ত তির এখনও প্রিয় ক্রিকেটার থেকে খুদে স্কুল পড়ুয়া— কাউকে রেয়াত করে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy