Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

লজ্জার হারের ময়নাতদন্ত: প্রাথমিক পাঠ ভুলেই বিলেতে ভরাডুবি

ইংল্যান্ডে কেন বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের? কেন রান পাচ্ছেন বিরাট কোহালি আর ব্যর্থ তাঁর সতীর্থরা? কী ভাবে ফিরে আসতে পারেন তাঁরা? লন্ডনে দু’দিন ধরে পড়ে থেকে নানা রকম বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকল ভারতীয় দল। নানা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল আনন্দবাজারও।

সুমিত ঘোষ 
লন্ডন শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

ইংল্যান্ডে কেন বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের? কেন রান পাচ্ছেন বিরাট কোহালি আর ব্যর্থ তাঁর সতীর্থরা? কী ভাবে ফিরে আসতে পারেন তাঁরা? লন্ডনে দু’দিন ধরে পড়ে থেকে নানা রকম বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকল ভারতীয় দল। নানা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল আনন্দবাজারও।

আগেভাগেই বল খেলে দেওয়ার খেসারত: ইংল্যান্ডে সফল হওয়ার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে, যতটা সম্ভব দেরি করে শট খেলতে হবে। সেটা আক্রমণাত্মক শটই হোক কী রক্ষণাত্মক। তার কারণ ইংল্যান্ডের সুইং বোলিংয়ের সহায়ক আবহাওয়ার জন্য একেবারে শেষ মুহূর্তেও বল বাঁক নিতে পারে। জিমি অ্যান্ডারসনের মতো ‘সুইং কিং’ হলে আরওই দেরিতে বল বাঁক নিতে পারে। অ্যান্ডারসনের অস্ত্রই হচ্ছে লেট সুইং। অপেক্ষা করে না খেললে তাঁর সামনে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। ঠিক সেটাই হচ্ছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। ঘটনা হচ্ছে, এই ফর্মুলা যে ব্রেক্সিট হওয়ার পরে আবিষ্কৃত হল, এমন নয়। ইংল্যান্ডে সুইং, সিম খেলার নিয়ম খুব আদিকালেরই। সুনীল গাওস্কর, দিলীপ বেঙ্গসরকর, রাহুল দ্রাবিড়দের ভিডিয়ো দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভারতের এই দলের উপরের দিককার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র কে এল রাহুল প্রথম বার ইংল্যান্ডে টেস্ট খেলছেন। বাকিদের সকলের অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই ফর্মুলা তাঁদের অজানা থাকার কথা নয়। সমস্যা হচ্ছে, সচিন তেন্ডুলকর বা রাহুল দ্রাবিড়ের মতো শৃঙ্খলা এবং অধ্যবসায় দেখা যাচ্ছে না বিজয়, রাহানেদের মধ্যে। অস্ট্রেলিয়ায় কভারে আউট হচ্ছিলেন বলে কভার ড্রাইভ মারা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সচিন। সিডনিতে ডাবল সেঞ্চুরি করার ইনিংসে একটাও কভার দিয়ে শট খেলেননি। সেই শৃঙ্খলা এখনকার ভারতীয় ব্যাটিংয়ে একমাত্র কোহালি ছাড়া কারও মধ্যে নেই।

ব্যাটকে রাখো গায়ের কাছে: ইংল্যান্ডে দু’ধরনের চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হয় ব্যাটসম্যানদের। প্রথমে বল হাওয়ায় সুইং করে, তার পরে পিচে পড়ে সিম করবে। অর্থাৎ যত ক্ষণ না বল লাগছে ব্যাটে অথবা ব্যাটের পাশ দিয়ে বেরোচ্ছে, তত ক্ষণে রক্ষা নেই। দুনিয়ার অনেক ব্যাটসম্যানই এখানে এসে সমস্যায় পড়েছেন এই দুই চ্যালেঞ্জকে সামলাতে গিয়ে। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া থাকলে সারা দিন ধরেও বল নড়াচড়া করতে পারে। সেটাকে সামলানোর জন্য উপমহাদেশীয় স্টাইল বর্জন দিতে হয়। চেন্নাই বা কলকাতায় যেমন ছোট পায়ে অনের দিকে কব্জির মোচড়ে শট খেলে দেওয়া যায়, এখানে সেটা হওয়া কঠিন। রান করতে গেলে ব্যাটকে রাখতে হবে শরীরের সঙ্গে সাঁটিয়ে। শরীর থেকে দূরে খেলতে গেলেই বিপদ। রাহুল এবং রাহানের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি করে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের এই রোগ সারাতেই হবে।

বাইরে যাবে না ভিতরে আসবে: রাহানেকে আউটসুইংয়ের সঙ্গে ভিতরে আসা বলেও বিব্রত করছেন ইংল্যান্ডের পেসাররা। অ্যান্ডারসন দু’দিকেই বল বাঁক নেওয়াতে পারেন। এজবাস্টনে বেন স্টোকস ভিতরে আসা বলে রাহানেকে চাপে রাখতে রাখতে অফস্টাম্প থেকে দূরে আউটসুইং দেন। আর ভারতীয় সহ-অধিনায়ক বালকের মতো সেই ফাঁদে পা দিয়ে শরীর থেকে দূরে ব্যাট চালিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে আউট হন। কোনও কোনও ব্যাটসম্যান ইংল্যান্ড সফরে এসে দু’দিকের সুইং নিয়ে বিভ্রান্ত হলে নিরাপদ ফর্মুলা নিতেন। উইকেটকে সামলাও, বাইরের বল দেখে ছাড়তে থাকো। তাতে অনেক সময় বোলারকে পাল্টা চাপে ফেলা যেতে পারে। ব্যাটিংয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কী ভাবে ইনিংসকে সাজাব, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুনীল গাওস্কর বলতেন, বোলারকে এমন ভাবে খেলতে হবে যাতে সে তোমার শক্তিশালী জায়গায় বল করতে বাধ্য হয়। মাথা পরিষ্কার রেখে ইনিংস সাজানোর সেই পরিকল্পনাও বিজয়দের খেলার মধ্যে এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

কোহালি এবং অন্যরা: চার বছর আগে ইংল্যান্ড সফরে এসে ব্যর্থ হয়েছিলেন কোহালি। কিন্তু এ বারে প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি এবং হাফ সেঞ্চুরি করে বুঝিয়ে দেন, অতীতের ব্যর্থতা দিয়ে তাঁকে মাপতে যাওয়া ঠিক হবে না। তিনি কেন সফল আর কেন পারছেন না তাঁর সতীর্থরা? কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সবার আগে উঠে আসছে কোহালির টেকনিক্যাল তারতম্য ঘটানো। একে তো তিনি ক্রিজের বাইরে দাঁড়াচ্ছেন সুইংটা ভাঙার আগেই খেলবেন বলে। একই ফর্মুলা তিনি অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে প্রয়োগ করেছিলেন এবং মিচেল জনসনদের বিরুদ্ধে দারুণ ভাবে সফল হয়েছিলেন। চার বছর আগের সেই অস্ট্রেলিয়া সফরে চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি করেছিলেন কোহালি। ক্রিজের বাইরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আরও দু’টো জিনিস তিনি ক্রমাগত করে চলেছেন। অফস্টাম্পের বাইরে ব্যাটকে বলের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন না আগের মতো। এ বারে ব্যাট বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরীরের কাছাকাছি রেখে ভিতরের দিকে ঝুলিয়ে রাখছেন। তাতে অনেক ক্ষেত্রেই অ্যান্ডারসনদের বিষাক্ত সুইং ব্যাটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কানা খুঁজে পাচ্ছে না। এর পাশাপাশি, আউটসুইংয়ে ব্যাট ছোঁয়াতে বাধ্য হলে হাতের রাশ আলগা করে দিচ্ছিলেন। লর্ডস টেস্ট চলার সময়ে নাসের হুসেন, ডেভিড গাওয়াররা প্রেস লাউঞ্জে এসে বলছিলেন, ইংল্যান্ডে হাতটাকে নরম করে দেওয়ার রণনীতি মোক্ষম চাল কোহালির। এর ফলে ব্যাটের কানায় লাগলেও অনেক ক্ষেত্রে বল স্লিপ ফিল্ডারের হাত পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। আগেই মাটি ছুঁয়ে ফেলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE