Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ডার্বি-ব্যর্থতা ভুলতে মরিয়া ইস্টবেঙ্গল, অধরা লিগের খোঁজে মোহনবাগান

ডার্বির লড়াইয়ে আজ জিতবে কে? লাল-হলুদ না সবুজ-মেরুন!

যুবভারতী দেখবে গুরু বনাম শিষ্যের লড়াই! সত্তর ছুঁতে যাওয়া সুভাষই চার বছর আগে তাঁর সহকারী হিসেবে মোহনবাগানে নিয়ে এসেছিলেন  শঙ্করলালকে। হাতেখড়ি দিয়েছিলেন কোচিংয়ে।

আজ মুখোমুখি শঙ্করলাল ও সুভাষ। ফাইল চিত্র

আজ মুখোমুখি শঙ্করলাল ও সুভাষ। ফাইল চিত্র

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:০৬
Share: Save:

সরস্বতী পুজোয় যিনি হাতেখড়ি দেন, তিনি কি গুরু? যদি হন, তা হলে সুভাষ ভৌমিক এবং শঙ্করলাল চক্রবর্তীর মধ্যে আজ, রবিবারের বিকেলে সম্পর্কটা হবে সে রকমই।

যুবভারতী দেখবে গুরু বনাম শিষ্যের লড়াই!

সত্তর ছুঁতে যাওয়া সুভাষই চার বছর আগে তাঁর সহকারী হিসেবে মোহনবাগানে নিয়ে এসেছিলেন শঙ্করলালকে। হাতেখড়ি দিয়েছিলেন কোচিংয়ে। চিমা ওকোরির সঙ্গে সংঘর্ষে শেষ হয়ে যাওয়া এক ‘অতৃপ্ত’ ফুটবলারকে তুলে আনেন কাঁটা এবং ফুল বিছানো রাস্তায়। দুই প্রধানের কোচের পদটা তো তাই।

কিন্তু বরানগরের ছেলে গোকুলে বেড়ে উঠে যে তাঁকেই এক দিন ‘বধ’ করার কৌশল খুঁজতে বসবেন, সেটা কে জানত! চমকপ্রদ ব্যাপার হল, এমন একটা ম্যাচে সুভাষ সেই কৌশলের মুখোমুখি, যখন তাঁর চাকরির ভবিষ্যৎ সরু সুতোয় ঝুলছে।

ডার্বি মানেই বাঙালির কাছে ‘এ স্বাদের ভাগ হবে না’ বিজ্ঞাপন। লিয়োনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, কিলিয়ান এমবাপে, লুকা মদ্রিচকে দেখা চোখ ওই এক দিনই উধাও হয়ে যায় বঙ্গ সংস্কৃতি থেকে। সেখানে লাল-হলুদ সবুজ-মেরুন, ইলিশ-চিংড়ি বাঙাল-ঘটির বিভাজন। যুবভারতীর কাউন্টারে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও টিকিট না পেয়ে কাদামাখা জামাপ্যান্ট পরে যে ছেলেটি কয়েক মাইল হেঁটে শনিবার চলে এসেছিল চাঁদনি চকের আইএফএ অফিসে, সে-ও দেড় মাস আগে দেখেছিল বিশ্বকাপ ফাইনাল। তাঁর অবস্থা দেখে দয়া করে নিজের ডার্বির টিকিটই দিয়ে দিলেন রাজ্য সংস্থার এক কর্মী। টিকিটটা পেয়ে মাথায় তা ঠেকিয়ে প্রণাম করল ছেলেটি। মনে হল, মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের বিশ্বকাপ ফাইনালের টিকিট পেয়েছে সে! আজ রবিবারের ম্যাচ নিয়ে দু’ভাগ হয়ে যাওয়া বাঙালির কাছে ‘ডার্বি’ তো সব সময়েই তাঁদের নিজস্ব বিশ্বকাপ অথবা এল ক্লাসিকো! তা সে খেলার মান যত খারাপই হোক।

বহু দিন পর সেই ম্যাচেই দু’দলের রিজার্ভ বেঞ্চে মুখোমুখি দুই বঙ্গসন্তান কোচ। আদতে টিডি-র জোব্বা পরে বসলেও লাল-হলুদের কোচের ব্যাটন তো সুভাষের হাতেই। উল্টো দিকে মোহনবাগান কোচের চেয়ারে শঙ্করলাল। ডার্বির আগে অবশ্য দু’জনেই একে অন্যকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। শঙ্করলাল যেমন বলে দিয়েছেন, ‘‘কম। দেশের সফলতম কোচ উনি।’’ আর সুভাষের মুখ থেকে বেরিয়েছে, ‘‘শঙ্করলাল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। ওঁর পাঁচ শতাংশ বুদ্ধি যদি আমার থাকত!’’ দু’জনের বিনয় দেখে মনে হয়, আজ বিকেলের নব্বই মিনিট দুই ঠান্ডা মাথার মগজাস্ত্রের দ্বৈরথ দেখবে চৌষট্টি হাজারের যুবভারতী।

দুই মগজাস্ত্র থেকে বেরোতে পারে কী কী তূণ? সুভাষ সল্টলেকের মাঠে যা অনুশীলন করিয়েছেন, তাতে ৪-৪-১-১ ফর্মেশন তিনি বদলাচ্ছেন না। জবি জাস্টিনের পিছনে আল আমনা। টিমে একটাই বদল। এক মাস বসে থাকার পর বিশ্বকাপার জনি আকোস্টা খেলবেন। স্টপারে তাঁর পাশে সম্ভবত কিংশুক দেবনাথ। কিন্তু রাইট ব্যাকে সামাদ আলি মল্লিকের বদলে কি মেহতাব সিংহ? বুঝতে দেননি সুভাষ।

শেষ ছ’টি ডার্বি জেতেনি ইস্টবেঙ্গল। শেষ দুটি ডার্বিতে লাল-হলুদের মাঝমাঠের জেনারেল আমনা ব্যর্থ। দু’টোই জানেন ইস্টবেঙ্গল টিডি। তাঁর হাতে বিদেশি স্ট্রাইকার নেই। সুভাষের ভরসা দলের ঝকঝকে মাঝমাঠ। লাল-হলুদের দুটো উইং বাজপাখির মতো ডানা মেলে গোল-শিকারি হয়। তিন পাহাড়ি অস্ত্র চুলোভা, ডিকা, রালতেরা টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়োয়। তবে এ বার আমনা এবং কাশিম আইদারাও খুব ভাল খেলছেন। যা ভরসা দিচ্ছে সুভাষকে।

কিন্তু মোহনবাগানের দুরন্ত ফর্মে থাকা দিপান্দা ডিকা-হেনরি কিসেক্কাদের কি মাঝমাঠে থামাতে পারবে ইস্টবেঙ্গল? সাত ম্যাচে দশ গোল করা ফেলা বিদেশি স্ট্রাইকার জুটি যদি হয় মোহনবাগানের সেরা অস্ত্র, তা হলে তাদের উইং প্লে-র জন্য রয়েছে বাংলা-কেরল বাহিনী। জঙ্গল মহলের অদম্য মেহনতি যুবক পিন্টু মাহাতো আর কেরলের সমুদ্রতীরের মৎসজীবী পরিবারের ছেলে ব্রিটো পি এম— দু’জনেরই জীবন তো শুধু সংগ্রামের। ডার্বি-অভিষেকের ম্যাচে দু’জনে যে আগুন হবেন, বলাই বাহুল্য। কিন্তু মোহনবাগানের বড় সমস্যা হল, পালতোলা নৌকোয় মাঝমাঠ থেকে পাসের জোয়ার আনার লোকের অভাব। এটা জেনেও শেষ চার ম্যাচের দলে পরিবর্তন হচ্ছে না। ৫৯টি ডার্বি খেলা অভিজ্ঞ মেহতাব হোসেনকে তাই শুরুতে না নামিয়ে রিজার্ভ বেঞ্চেই রাখা হচ্ছে। ডার্বিতে সফল আজহারউদ্দিন মল্লিকও বসবেন মেহতাবের পাশে। দু’জনকেই পরের দিকে নামিয়ে বাজিমাত করার ভাবনা মাথায় ঘুরছে শঙ্করলালের। বলেও দিলেন, ‘‘পরিস্থিতি বুঝে ওদের ব্যবহার করব।’’

সুভাষের আবার সমস্যা ডার্বিতে নামলেই তাঁর দল সাম্প্রতিক কালে সমস্যায় পড়ছে। ইস্টবেঙ্গল টিডি বলেও ফেলেছেন, ‘‘একটা গাড়ি কাদায় আটকে গেলে তাকে টেনে তোলা কঠিন। সেটাই চেষ্টা করছি।’’ অভিজ্ঞ সুভাষ জানেন, ডার্বি-ভয় থেকে ছেলেদের মুক্ত করার উপায় একটাই— মানসিক ভাবে পুরো দলকে চাঙ্গা করা। সেই ‘ওষুধ’ অবশ্য হঠাৎই এসে গিয়েছে তাঁর হাতে। যাঁর নাম, জনি আকোস্তা। কোস্টা রিকার এই বিশ্বকাপারকে নিয়ে আগ্রহ চরমে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চাপান-উতোর শুরু হয়েছে দুই প্রধানের সমর্থকদের মধ্যে। ৯৭ বছরের কলকাতা ডার্বি ইতিহাসে তাঁরা বহু প্রাক্তন বিশ্বকাপারকে দেখেছেন। কিন্তু জনির মতো ‘টাটকা’ কাউকে দেখেননি। মোহনবাগানের ডিকা-হেনরির দৌরাত্ম্য আটকাতে জনি কতটা সফল হন, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকবে আজকের সূর্য ডোবা বিকেল। শনিবার সকালে অবশ্য জনিকে দেখা গেল বেশ গম্ভীর মুখে। ভাষা-সমস্যার জন্য সতীর্থ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না। আল আমনার সঙ্গে একই গাড়িতে করে এলেন অনুশীলনে। ঘিরে ধরা লাল-হলুদ সমর্থকরা স্লোগান দিতে শুরু করলেন। তাতেও হাসি নেই। তিরিশ বছর বয়স হলেও দেখা গেল অনুমান ক্ষমতা প্রখর। হেডও বেশ ভাল। একটু ঝুঁকে হাঁটলেও খেলাটা পিছন থেকে তৈরি করতে পারেন। ডার্বিতে বিদেশির অভিষেক হয়েছে অনেক। সেলিম নুর, ফেলিক্স, ডুডু ওমাগবেমি, আক্রম মোগরাভি। ১৯৬৩-তে লাল-হলুদ জার্সির নুর ছাড়া কেউ নায়ক হয়ে ফিরতে পারেননি। জনি কি পারবেন? তাঁর একটা বড় অসুবিধা, একটা ম্যাচও খেলেননি কিংশুক বা মেহতাবের সঙ্গে। বৃহস্পতিবারের ক্লোজ ডোর অনুশীলনে কর্নারের সময় লম্বা জনিকে বিপক্ষের বক্সে পাঠানোর অভ্যাস করিয়েছিলেন সুভাষ। সেই খবর এসে গিয়েছে মোহনবাগান কোচের কাছে। এ দিন নিজেদের মাঠে শঙ্করলাল তা আটকানোর পাঠ দিয়েছেন ছাত্রদের। ‘‘আমি ডিকা-হেনরিকে সতর্ক করেছি। পাশাপাশি জনি আমাদের বক্সে এলে কে কী করবে বুঝিয়ে দিয়েছ। সবে বিশ্বকাপ খেলে এসেছে, গুরুত্ব তো দিতেই হবে।’’

ডার্বির ফলের ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। ফেভারিটরা হেরে যায়, পিছিয়ে থাকা দল জেতে। আকাশ বিদীর্ণ করে তীব্র শব্দব্রহ্মের মধ্যে খুঁজে নেয় নতুন নায়ক। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ডার্বির ৩৬৫তম সংস্করণও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE