পেনাল্টি কর্নারের ব্যর্থতা থেকেই গেল। বৃহস্পতিবার রিওতে ভারতীয় হকি দল। ছবি: পিটিআই।
নেদারল্যান্ডস-২ (হফম্যান, উইরডেন)
ভারত-১ (রঘুনাথ)
খুব দুঃখের সঙ্গে উপরের হেডিংটা করলাম। তবে আমার কথা রিওতে ভুল প্রমাণ হলে সবচেয়ে খুশি হব আমি-ই।
দেখুন, নেদারল্যান্ডস বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা দল। ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন। সব বুঝলাম। কিন্তু এই সেদিন আমাদের বিরুদ্ধে জার্মানি ম্যাচ শেষ হওয়ার তিন সেকেন্ড আগে উইনিং গোল দিল। আর আমরা আজ শেষ মিনিটে পরপর পাঁচটা পেনাল্টি কর্নার পেয়েও গোল শোধ দিতে পারলাম না।
হতে পারে এ বার অলিম্পিক্সে এখনও পর্যন্ত ভারতের সাতটা গোলের ছ’টা পেনাল্টি কর্নার থেকে। কিন্তু চার ম্যাচে সর্দাররা যতগুলো পেনাল্টি কর্নার পেয়েছে, তার তুলনায় ছ’গোল যথেষ্ট কম। সাকসেস রেট পঁচিশ-ও নয়। আজই তো সাতটা পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল এল মাত্র একটা।
এই ভারতীয় হকি দল হয়তো কোয়ার্টার ফাইনাল যাবে। সেমিফাইনালও যেতে পারে। কিন্তু পদক জিতলে আমি অবাক হব। এরা ভাল প্লেয়ার। কিন্তু ওয়ার্ল্ড বিটার নয়। বল কন্ট্রোল, পজিশনিং, পাসিং, সাপোর্টিং— সব ঠিক আছে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বীকে চমকে দেওয়ার মতো যে রসদ তোমার খেলায় থাকতে হয় সেই ব্যাপারটা নেই। খেলায় ‘আননোন মেটিরিয়াল’ বলতে কিছু নেই। সবটাই প্রতিপক্ষের কাছে যেন চেনা। নইলে টানা পাঁচটা পেনাল্টি কর্নার কখনও সেভ হয়!
আমাদের সময়েও যেমন বল গোললাইন থেকে পুশ করার পর সেটা ডি-র মাথায় হাত দিয়ে থামানো আর হিট মারার মাঝে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের সামান্যতম দেরি হয়ে যেত, এখনও তাই। আজও তো রূপেন্দ্র বা রঘুনাথের ড্র্যাগ ফ্লিকের মুহূর্তে ওই বাড়তি সেকেন্ডের ভগ্নাংশের সময়টুকুতে ডাচ ডিফেন্স হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের ছেলেদের সামনেটা ব্লক করে দিল। এক-আধ বার নয়। টানা পাঁচ বার! যা দেখে খুব খারাপ লাগছিল।
রামনদীপদের ফিটনেস, স্পিড, পাওয়ার আমাদের সময়কার চেয়ে খানিকটা বেশি হতে পারে। কিন্তু এখনও সেটা ইউরোপিয়ানদের ছুঁতে পারেনি। আর পেনাল্টি কর্নারে এই তিনটে জিনিস সবচেয়ে দরকার। যাদের যত বেশি, তাদের হিট তত পারফেক্ট হয়।
আজই ডাচদের পেনাল্টি কর্নার মারার কথা এক বার ভাবুন। গোটা ম্যাচে দু’টো পেনাল্টি কর্নার পেয়েছে ওরা। দু’টোতেই গোল। একশো ভাগ সাকসেস রেট। সেই আমাদের সত্তরের দশক থেকে ডাচরা পেনাল্টি কর্নারে এ রকম পারফেক্ট। তখন টাইজ ক্রুজের ড্র্যাগ ফ্লিক ছিল মারাত্মক। আজ উইরডেন, হফম্যানের পেনাল্টি কর্নার মারা দেখে ক্রুজের কথা মনে প়়ড়ছিল আমার।
খুব খারাপ লাগলেও লিখতে বাধ্য হচ্ছি, পেনাল্টি কর্নার মারায় আমাদেরও তো সেই ট্র্যাডিশন চলেছে! বাহাত্তরের অলিম্পিক্স সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা ১৭টা পেনাল্টি কর্নার মিস করে হেরেছিলাম। এ দিন নেদারল্যান্ডসের কাছে সর্দাররা হারল শুধু স্টপেজ টাইমেই পরপর ৫টা পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করতে না পেরে। দিন কয়েক আগেই আনন্দবাজারে একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছিলাম, বাহাত্তরের অলিম্পিক্স থেকে ফেরার পরে একদিন বাড়িতে পাকিস্তান ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠলে ‘আমাদের ব্যাড লাক’ বলায় বাবা গর্জে উঠে বলেছিলেন, ‘‘কীসের ব্যাড লাক? বলো তোমাদের ব্যাড প্লে।’’ আজ আমারও একই কথা বলতে ইচ্ছে করছে রূপেন্দ্র-রঘুনাথদের। বাবা বেঁচে থাকলে বোধহয় চুয়াল্লিশ বছর আগে আমাকে বলা কথাটা আজ আবার বলতেন— কোচিং যতই পারফেক্ট হোক, প্লেয়াররা ইমপারফেক্ট খেললে জিতবে কী করে!
নইলে পিছিয়ে পড়েও ভারত ১-১ করায় মনে হয়েছিল, তিয়াত্তরের বিশ্বকাপ ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে আমাদের মতো দুর্দশা আজ হবে না সৃজেশদের। সেই ম্যাচের আট মিনিটের ভেতর আমরা দু’গোলে এগিয়ে গিয়েও সাডেনডেথে হেরে গিয়েছিলাম তিনটে পেনাল্টি স্ট্রোক মিস করে। তবে ডাচদের হারাতে ভারতের ডাচ কোচ চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেনি। ১-২ পিছিয়ে পড়ার পরে অল্টমান্সকে দেখলাম গোলকিপারকে বসিয়ে একজন বাড়তি অ্যাটাকার নামাতে। অনেকে বলতে পারেন, এটা তো সুইসাইডাল স্ট্র্যাটেজি! কাউন্টার অ্যাটাকে সুইপার-কিপার রঘুনাথকে ড্রিবল করলেই তখন ডাচদের সামনে ফাঁকা গোল। কিন্তু আমার মতে তখন ভারতের হারানোর কিছু ছিল না। বরং বদলি ফরোয়ার্ড হরমনপ্রীতের জন্যই তো শেষ সেকেন্ডে আমাদের পেনাল্টি কর্নারটা পাওয়া। যার ফলো-আপ আরও চারটে পেনাল্টি কর্নার!
সাহসী অল্টমান্সের মরিয়া ভাবটাই এখন ভরসা আমার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy