Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

কোপাকাবানার সৌন্দর্যও ম্লান উদ্বাস্তু অ্যাথলিটদের জীবন যুদ্ধে

ইয়েচ পুর বিয়েলের বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছিল সেনা-বোমায়। ঘরে খাবার, জল কিছুই নেই। মা পাশের একটা বাড়িতে বছর ন’বছরের ছেলেকে রেখে খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন রাস্তায়। ফিরেছিলেন মৃতদেহ হয়ে। প্রাণ বাঁচাতে সেই দৌড় শুরু শিশু বিয়েলের।

রতন চক্রবর্তী 
রিও দে জেনেইরো শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৬ ০৪:০৯
Share: Save:

ইয়েচ পুর বিয়েলের বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছিল সেনা-বোমায়। ঘরে খাবার, জল কিছুই নেই। মা পাশের একটা বাড়িতে বছর ন’বছরের ছেলেকে রেখে খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন রাস্তায়। ফিরেছিলেন মৃতদেহ হয়ে। প্রাণ বাঁচাতে সেই দৌড় শুরু শিশু বিয়েলের। গাছের ফল পেড়ে খেয়ে, নদীর জল খেয়ে আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে করতে জায়গা হয়েছিল দক্ষিণ কেনিয়ার উদ্বাস্তু শিবিরে।

উসেইন বোল্ট যে অলিম্পিক্স ট্র্যাকে দৌড়বেন সেখানেই দক্ষিণ সুদানের ইয়েচ দৌড়বেন।

রোস নাথিক লোকোনিয়েন গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া মা, দাদুর শবদেহ টপকে দৌড়তে শুরু করেছিলেন কবে, এত দিন পর আর মনে নেই! তবে সুদানিজ মেয়ের মনে আছে, তখন তাঁর বয়স বড়জোর সাত কী আট বছর। সেনার গুলিতে বাড়ির সবাই মারা গেলেও সেই রাতে খাটের তলায় রাতে শুয়েছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছিলেন। এটাও মনে আছে, রাস্তায় একবার এক সেনা দলের খপ্পরে পড়ে গিয়েছিলেন। লোলুপ দৃষ্টির সেনাদের হাত থেকে তাঁর সম্মান বাঁচিয়েছিলেন এক কম্যান্ডার। তিনিই বলে দিয়েছিলেন, কোন পথে যেতে হবে পড়শি দেশের কোকুমা ক্যাম্পে। একরত্তি মেয়ে সেখানে পৌঁছে দেখেন আরও হাজার কুড়ি মানুষ তাঁর মতোই পরিজনহারা।

লোকেনিয়ান রিওতে মেয়েদের আটশো মিটার দৌড়বেন ‘‘আমরা পশু নই, আমরাও পৃথিবীর সন্তান’’ শুধু এটা জানাতে। বলছিলেন, ‘‘পদক হয়তো পাব না । কিন্তু সব মানুষ যা পারে, আমরাও পারি এটা প্রমাণ করতেই অলিম্পিক্সে আসা।’’ একরাশ জেদ তখন অষ্টাদশী তরুণীর চোখমুখে। অথচ কী রোগাটে- জিরজিরে তাঁর চেহারা!

অলিম্পিক্স স্টেডিয়ামে তখন ফুটবল চলছে। তার পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে দেখা গেল অনেক মিডিয়ার লোকজন বুম আর ক্যামেরা নিয়ে হাজির। পাশ নিয়ে গান গাইতে গাইতে, ড্রাম বাজাতে বাজাতে চলেছে প্রচুর নারী-পুরুষ। সবাই কোনও না কোনও দলের জার্সি পরে স্টেডিয়ামমুখী। মিডিয়ার ভিড় দেখে মনে হয়েছিল নেইমার বুঝি এসেছেন। পরক্ষণেই ভুল ভাঙল। সেখানে আসলে রিও অলিম্পিক্সের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর চরিত্রগুলো হাজির। যাঁরা এই সে দিন মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে বিশ্বের সর্বোত্তম শো-র জমকালো আলোর নীচে এসে দাঁড়িয়েছেন। নেই রাজ্যের বাসিন্দা হয়েও তাঁরা সবাই তারকা। বোল্ট, ফেল্পস, লিন ডান, জকোভিচ, নেইমারের মতোই ওঁরাও এখানে হাইপ্রোফাইল চরিত্র।

সৌজন্যে আর্ন্তজাতিক অলিম্পিক্স কাউন্সিল (আইওসি)। অন্য সব দেশের ক্রীড়াবিদরা যখন জাতীয় পতাকা নিয়ে মার্চপাস্টে অংশ নিলেন এ দিন রাতে, তখন ওই দশ জনের হাতে থাকল আইওসি-র পতাকা। সংগঠক ব্রাজিলের দলের ঠিক সামনে হাঁটলেন ওঁরা। জীবনে সম্ভবত প্রথম বার ভয়হীন ভাবে।

ওঁরা কারা? যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের নাগরিক, সীমাহীন গৃহযুদ্ধের শিকার একদল উদ্বাস্তু। যাঁদের কোনও দেশ নেই। ঠিকানা শরণার্থী শিবির। খাবার বানানোর উনুন নেই, থালা-বাটি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় পেট ভরানোর আশায়। রোগে ভুগে মাঝেমধ্যেই মারা যায় শিশু, কিশোর, বৃদ্ধরা। এঁরা কেউ প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছেন দক্ষিণ সুদান থেকে, কেউ কঙ্গো থেকে, কারও বাড়ি ছিল সিরিয়া অথবা ইথিওপিয়ায়।

ওঁদের যিনি কোচ হিসেবে এসেছেন সেই ভলকার ওয়াগনর জার্মান। তিনিই সংবাদমাধ্যমের ভিড়টাকে বলছিলেন, ‘‘খালি পায়ে দৌড়ত ওরা। এবড়ো খেবড়ো মাঠে। রাস্তায়। বেলাগামহীন ভাবে। যখন ওদের বাছা হল তখন ভেবেছিলাম কী করব এদের নিয়ে? তবে ওদের দৌড়নোর ইচ্ছে প্রবল। অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি। যাঁদের এনেছি তারা কিন্তু অন্য দেশের অ্যাথলিটদের মতোই ট্রায়াল দিয়ে এসেছে। প্রায় পঞ্চাশ জনের থেকে ওদের বেছেছি।’’

আসলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা শরণার্থীদের মানবিক সমস্যার দিকটাকে তুলে আনার ভগীরথ আইওসি প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ। তিনি-ই রিও অলিম্পিক্সের মঞ্চে উদ্ধাস্তু সমস্য তুলে আনতে এই প্রজেক্ট তৈরি করেন বছর দু’য়েক আগে। এর আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের শরণার্থী অ্যাথলিটরা এক-আধজন গেমসে নামেননি যে তা নয়। কিন্ত সংগঠিত ভাবে এই প্রচেষ্টা এই প্রথম। বছর খানেক আগে আইওসি বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে অ্যাথলিট খুঁজে আনার দায়িত্ব দেয় বিশ্বরেকর্ড করা ম্যারাথনার টেগলা লরুপকে। তাঁরই আবিষ্কার লোকেনিয়ান, ইয়েচ, অ্যাঞ্জোলিনারা। যাঁদের বেঁচে থাকার গল্প নিয়ে এক-একটা বড় উপন্যাস হতে পারে। কত যে অদ্ভুত জীবনকাহিনি!

দলটার সঙ্গে ঘুরছেন ইউনেস্কো এবং আইওসির দুই প্রতিনিধি। তাঁরাই জানালেন, এই দলে এমন দু’জন জু়ডোকা আর একজন সাঁতারু আছেন যাঁদের বেঁচে থাকার গল্প চমকে দেওয়ার মতো। জু়ডোকা পোপলে মিসিঙ্গা এবং ইয়োলেন্ডে মোবিকা। কঙ্গো যুদ্ধের সময় যাঁদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল প্রাণে বাঁচতে। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে না চাওয়ায় পোপলেকে আটকে রাখা হয়েছিল গুহার মধ্যে একটা জেলে। আর মেয়ে জুডোকা মোবিকাকে ধরা হয়েছিল অন্য উদ্দেশ্যে। শেষ পর্যন্ত গণ-ধর্ষিতা হতে হয়নি তাঁকে। আশ্রয় নিয়েছিলেন উদ্ধাস্তু শিবিরে।

ফেল্পসকে নিয়ে এত মাতামাতি। কিন্তু কিংবদন্তি সাঁতারুর পুলেই ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে নামতে চলা সিরিয়ান উদ্বাস্তু কিশোরী ইয়াদ্রা মার্দিনির বেঁচে থাকার গল্প শুনলে মনে হয় এই শরণার্থীও তো মহাতারকা। সাতারের পুলে না হোক, জীবন-যুদ্ধ জয়ে তো বটেই। বিধ্বস্ত দেশ থেকে পালাতে গিয়ে সমুদ্রে যখন ডুবে যায় তাঁদের ভাড়া করা ডিঙি নৌকা, তার পরে সাড়ে তিন ঘণ্টা নাগাড়ে সাঁতার কেটে পাড়ে পৌঁছেছিলেন মার্দিনি। বাবা-মার খোঁজ পাননি বাড়িতে বোমা পড়ার পর। ভাইদেরও না। প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছিলেন যাঁদের সঙ্গে সেই কুড়িজনের দলের অনেকে ডিঙি নৌকো উল্টে মারা যান। কিন্তু মার্দিনি আর তাঁর দিদি জঙ্গলে লুকিয়ে রাত কাটিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে, পাহাড়-দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছেছিলেন বার্লিনের শরণার্থী শিবিরে। যার মাঝে তাঁদের পেরোতে হয়েছিল ছ-ছ’টা দেশ।

যে অসাধারণ লড়াইকে সম্মান জানাতে দেওয়া হয়েছে আইওসি-র সলিডারিটি পুরস্কার। শরণার্থীর অন্ধকার জীবন থেকে অলিম্পিক্সের বিশ্ব-মঞ্চে উত্তরণ। রিওতে অনেকে পদক পাবেন। রেকর্ড ভাঙা-গড়া হবে। তারকাদের ঝলকানিতে উথাল-পাথাল হবে স্টেডিয়াম থেকে সাঁতারের পুল। পাশাপাশি রিও শরণার্থী দলের মুক্ত বিহঙ্গ হওয়াকেও সেলাম জানাবে। হয়তো সবার আগে। যাঁদের যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার আলোয় কোপাকাবানার সৌন্দর্যও কখনও কখনও ম্লান হবে বইকী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE