Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Sports

মেদিনীপুর থেকে বেজিং অলিপিক্সে

মন দিয়ে খেলতেন। প্রাথমিক স্কুল থেকেই খেলায় আগ্রহ। বড়দের খেলতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়তেন। তবে বাড়ির সমর্থন ছিল পুরোমাত্রায়। কারণ মা-বাবা খেলাধুলোর চর্চা করতেন। একটা একটা ধাপ পেরিয়ে এশিয়ান গেমসে। সেখানে থেকে অলিপিক্সের মতো স্বপ্নের আসরে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

 বেজিং অলিপিক্সে সুস্মিতা। ফাইল চিত্র

বেজিং অলিপিক্সে সুস্মিতা। ফাইল চিত্র

সৌমেশ্বর মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০১:২০
Share: Save:

প্রশ্ন: বাংলায় অ্যাথলেটিক্স তেমন জনপ্রিয় কোনও খেলা নয়। কেউ সাফল্য পেলে তাঁকে নিয়ে নাচানাচি হয় ক’দিন। প্রশিক্ষণ, পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে হেপ্টাথেলনের মতো ইভেন্ট বেছেছিলেন। কোনও নির্দিষ্ট কারণে?

উত্তর: আমার বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। আমরা পুলিশ লাইনের কোয়ার্টারে থাকতাম। পুলিশ লাইন প্রাথমিক স্কুলে পড়তাম। স্কুল থেকে ফেরার সময়ে পুলিশ লাইন মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে বড়দের খেলা দেখতাম। খেলতেও খুব ইচ্ছে করত। স্কুলের রফিক স্যার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাবা-মাকে জানান, মেয়ে খেলাধুলো পছন্দ করে। ওকে খেলায় দাও। তার পরে বাবা আমাকে অ্যাথলেটিক্স কোচিং সেন্টারে প্রশিক্ষক সুব্রত পানের কাছে ভর্তি করেন। সেখান থেকেই আমার অ্যাথলেটিক্সে আসা। প্রথমে হাইজাম্প খুব ভাল দিতাম। ধীরে ধীরে হেপ্টাথেলনে যাই।

প্রশ্ন: চর্চা শুরু ঠিক কখন থেকে?

উত্তর: চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

প্রশ্ন: উইকিপিডিয়া খুললে দেখা যায়, আপনার পরিচয়ে লেখা মেদিনীপুর, ভারত। আপনার বাড়ি কোথায়?

উত্তর: আমার বাড়ি মেদিনীপুর শহরের রাজা রামমোহন নগরে।

প্রশ্ন: পড়াশোনা কি এই শহরেই?

উত্তর: অলিগঞ্জ ঋষি রাজনারায়ণ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তাম।

প্রশ্ন: অ্যাথলেটিক্সে শুরুর দিনগুলোর কথা শুনতে চাই।

উত্তর: আমার মা অনিমা সিংহ রায় ও বাবা অচিন্ত্য সিংহ রায় পড়াশোনার সময় খেলাধুলো করেছেন। মা হুগলির ধনেখালির ভাণ্ডারহাটি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তেন। ওই সময় জেলাস্তর পর্যন্ত খেলাধুলোয় যোগ দিয়েছিলেন। বাবা ধনেখালিতে জেলাস্তর পর্যন্ত ফুটবল খেলেছেন। তাই বাড়িতে খেলাধুলোর বিষয়ে আগ্রহ ছিল। বাবা-মা ও দাদা সৈকত সিংহ রায় আমাকে খুবই উৎসাহ দিত।

প্রশ্ন: কোনও ব্যক্তি বা প্রশিক্ষক, যাঁকে আপনি পথপ্রদর্শক বলে মনে করেন?

উত্তর: কোনও ব্যক্তি নন, আমার পথপ্রদর্শক অনেকেই। যেমন, রফিক স্যার, আমার বাবা-মা ও দাদা এবং সুব্রত স্যার। এঁদের সকলের প্রচেষ্টায় আমার খেলাধুলো শুরু হয়েছিল।

প্রশ্ন: অ্যাথলেটিক্স জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে হয় কোন ঘটনাকে?

উত্তর: স্টেপ বাই স্টেপ একটু করে এগোচ্ছিলাম। ভালই লাগছিল। সবার স্বপ্ন থাকে বিদেশ যাওয়া। ২০০০ সালে ওয়ার্ল্ড ইউথে যোগ দেওয়ার সময় প্রথম বিদেশ যাই। এর পর থেকেই আমার কাছে কলকাতার সাইয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ আসে। সাইয়ের অ্যাথলেটিক্স বিভাগের প্রধান কুন্তল রায়ের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পাই।

প্রশ্ন: সেই সময়ে প্রশিক্ষণের ভাল ব্যবস্থা ছিল জেলায়?

উত্তর: জেলায় পরিকাঠামোর অভাব ছিল। বিশেষ করে মাঠের অভাব ছিল।

প্রশ্ন: জেলা থেকে জাতীয় মুখ হয়ে ওঠার যুদ্ধের কথা বলুন।

উত্তর: জেলা থেকে ধাপে ধাপে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে পৌঁছেছি। ২০০০ সালে সাইয়ে সুযোগ পেয়েছি। ২০০০ সালে মস্কো ওয়ার্ল্ড ইউথ গেমসে হাইজাম্পে তৃতীয় হয়েছি। ২০০৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে হেপ্টাথেলনে দ্বিতীয় ও ২০০৭ সালে জর্ডনে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে হেপ্টাথেলনে তৃতীয় হয়েছিলাম। ২০০৯ সালে ক্যালিফর্নিয়ায় ইউএস ইন্ডোর ওপেনে ৬০ মিটার হার্ডলসে দ্বিতীয় হয়েছি। ২০০৬ সালে মেলবোর্নে কমনওয়েলথ গেমসে যোগ দিয়েছি। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে ইতালিতে ওয়ার্ল্ড কম্বাইন্ড ইভেন্টে যোগ দিয়েছি। ২০০৮ সালে বেজিংয়ে অলিম্পিক্স গেমসে যোগ দিয়েছি। ২০১০ সালে চিনে এশিয়ান গেমসে যাই। ২০১০ সালে দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসে যোগ দিই। ২০১৩ সালে পুণেয় এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দিই। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়ান গেমসে যোগ দিই। ২০০৬-১৪ সাল পর্যন্ত ১২টি সিনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে হেপ্টাথেলনে যোগ দিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে ‘খেল সম্মান’ পেয়েছি।

প্রশ্ন: প্রান্তিক জেলা থেকে গিয়ে প্রথম দিকে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয়নি?

উত্তর: অসুবিধে হয়নি। কারণ ভাল জিনিস সহজেই মানিয়ে নেওয়া যায়। ওখানে প্রশিক্ষকেরা আমাদের আগলে রাখতেন। খুব সহজ করে আমাদের বুঝিয়ে দিতেন। আর কী ভাবে আমাদের উন্নতি হবে তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন।

প্রশ্ন: জাতীয় স্তরের খেলায় জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা কোনটা?

উত্তর: সে রকম কিছু মনে নেই। কারণ সব প্রতিযোগিতায় ভাল করার চেষ্টা করতাম।

প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য পেয়েছেন। এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপে দু’বার পদক জয়। সেই জয়ের গল্প শুনতে চাই।

উত্তর: ২০০৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবার যোগ দিয়েছিলাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতার জন্য আমাদের নিয়মিত অনুশীলন চলতই। তাই এশিয়ান কাপের জন্য নতুন কিছু শেখার ছিল না। তবে অনুশীলনের সময় ও মনোসংযোগ বাড়াতে হয়েছিল। মানসিক ভাবে খুব একটা চাপ ছিল না। কারণ এর আগে ওয়ার্ল্ড ইউথ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। তবে দক্ষিণ কোরিয়া রওনা হওয়ার সময়ে একটা ঘটনার কথা মনে আছে। কলকাতা থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি যাওয়ার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছই। ট্রেনের টিকিট মিলিয়ে দেখার সময় চোখ কপালে ওঠে। শিয়ালদহ থেকে দিল্লি যাওয়ার টিকিটের বদলে দিল্লি থেকে রিটার্ন টিকিট কাটা হয়েছিল। এর ফলে রাজধানীতে যাওয়া হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কেটে পরের ট্রেনে দিল্লি পৌঁছই। কোরিয়ায় পৌঁছে সেখানকার মাঠ, পরিবেশ দেখে ভাল লেগেছিল। সব কিছুই আধুনিক উন্নত মানের। অনেক নামী দামি খেলোয়াড়কে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখে ভালই লাগছিল। তবে প্রতিযোগিতার সময় কোনও টেনশন ছিল না। কারণ নিজের খেলার বাইরে মাথায় কিছুই আসেনি। ওখানে হেপ্টাথেলনে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। দেশে ফিরে আসার পর সাইয়ে আমার বাবা-মাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ২০০৭ সালে জর্ডনে দ্বিতীয়বার এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দিই। পরিবেশ ভাল ছিল। তবে খাবার নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। ওখানকার খাবার পরিমাণ মতো খেতে পারছিলাম না। তার পরেও তারকা খেলোয়াড়দের মাঝে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে নিজের প্রশিক্ষক সঙ্গে থাকলে অনেক মানসিক জোর পাওয়া যায়। ওই প্রতিযোগিতায় হেপ্টাথেলনে তৃতীয় হয়েছিলাম।

প্রশ্ন: খেলার জীবনে কোনও আক্ষেপ আছে?

উত্তর: না। আমি খুব বেশি আশা করিনি। মনের ভিতর থেকে খেলাকে ভালবেসে ছিলাম। মন থেকে খেলতাম। তাই কোনও আক্ষেপ নেই।

প্রশ্ন: এখন কি নিয়ে ব্যস্ত? ক্রীড়া জগতের সঙ্গে যোগ আছে?

উত্তর: এখন কলকাতায় আয়কর বিভাগের অফিসে কর্মরত। নিজের ফিটনেসের জন্য ও আয়কর বিভাগের স্পোর্টসের জন্য নিয়মিত মাঠে যাই।

প্রশ্ন: জেলার অ্যাথলেটিক্সের হাল খুব খারাপ। প্রতিভার খোঁজ মিলছে। কিন্তু দারিদ্র থেকে পরিকাঠামো নানা বাধায় প্রতিভা ধরে রাখা যাচ্ছে না। আপনার মত বা পরামর্শ?

উত্তর: সত্যিই জেলার পরিকাঠামোর সমস্যা রয়েছে। ৪০০ মিটার দৌড়ানোর ট্র্যাক নেই। কোথায় কী ভাবে দৌড়াতে হয় অনেকেই জানে না। সার্বিক উন্নতির জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। খেলার প্রাথমিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে।

প্রশ্ন: জেলার ক্রীড়া পরিচালকদের কাছে কোনও প্রস্তাব?

উত্তর: কিছু বলব না।

প্রশ্ন: ক্রীড়া জগতের এমন কোনও শিক্ষা, যা আপনি নতুনদের জানাতে চান?

উত্তর: অনেকে মাঠে আসে শখে। অনেকে রোগা হওয়ার জন্য। অনেকে পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় ফিটনেসের জন্য, অনেকে এটাই কেরিয়ার করে। নতুনদের ঠিক করতে হবে তারা কী করতে চাইছে। ছোট থেকেই নিয়মিত বেসিক জিনিসগুলো করতে হবে। আমাদের জেলায় অনেক ট্যালেন্ট আছে। তবে তাঁদের অনেকে পেট ভরে খেতে পায় না। তাঁদের সাহায্য করতে হবে।

প্রশ্ন: এখন আপনার লক্ষ্য কী?

উত্তর: মানুষকে সাহায্য করার ইচ্ছে আছে। বিশেষ করে স্পোর্টসম্যানদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE