বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে কভার করার মধ্যে একটা অদ্ভুত রোমা়ঞ্চ আছে। দেশে-বিদেশে যখনই বাংলাদেশ টিমকে মাঠে ভ্রাম্যমান দেখি, হৃদয়ে কোথাও যেন একটা ঝুমঝুমি বাজে। ঐতিহাসিক ভাবে এটা যত না বাংলাদেশি খেলার জন্য, তার চেয়েও বেশি বাংলাদেশের খেলা ঘিরে আবেগের আকুলতার জন্য।
যত বার বাংলাদেশে ক্রিকেট কভার করতে গিয়েছি প্রতিবার একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় ভুগেছি। কোথাও যেন ভিড় করে আসত কলকাতা ময়দানি ফুটবলের পুরনো দিনগুলো। একই আকুলতা। একই রকম গর্জে ওঠা। আবার টিম হেরে গেলে সেই স্বপ্নের বাড়িটাকে ভেঙে ফেলা। সুরজিৎ সেনগুপ্ত যখন তাঁর খ্যাতির মধ্য গগনে এবং ইস্টবেঙ্গলের স্টার, তিনি এক দিন লিগ ম্যাচ খেলার জন্য টেন্টে ঢোকার মুখে দেখেন সেই লোকটি নেই যে রোজ ম্যাচের আগে দাঁড়িয়ে থাকে।
পরের ম্যাচে যথারীতি সে হাজির। সুরজিৎ বললেন, ‘‘আগের দিন দেখলাম না তো?’’ মধ্যবয়সী লোকটি বলল, ‘‘ছেলেটা হঠাৎ মারা গেল। পুড়িয়ে আসতে আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। হাফ টাইমের পরে ঢুকেছি।’’
প্রায় ৩৮ বছর আগের ঘটনা। সুরজিৎ এমনই স্তব্ধ হয়ে যান যে আজও সেই সংলাপের হ্যাং ওভার কাটাতে পারেননি। বলে কী লোকটা! ছেলেকে দাহ করে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে চলে এসেছে!
বাংলাদেশের ক্রিকেট দর্শকদের যদি এমন কোনও গল্প থেকে থাকে আমি আশ্চর্য হবো না। আর একটা জিনিস লক্ষ করেছি। বঙ্গ সমর্থকেরা দেশে-বিদেশে একই রকম প্যাশনে ভরা। এমন নয় যে শুধু দেশের সাপোর্টারদের আবেগের তীব্রতা বেশি, বিদেশের কম। একদমই না। বাংলাদেশ যেন স্বাধীনতার ৪০-৪২ বছর পর তার একতার সেরা মন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছে-ক্রিকেট। ভালবাসার খেলা নির্বাচনে ওই সব আর কোনও ব্যাপার নয় যে যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। দেশবাসী প্রত্যেকেই যেন ডাক পেয়ে গিয়েছে যে ক্রিকেটের সঙ্গে চলো রে।
আজ থেকে ৩০ বছর আগে জীবনের প্রথম ক্রিকেট সিরিজ কভার করতে গিয়েছিলাম শ্রীলঙ্কায়। সে বার দুর্ধর্ষ টিম ছিল ভারতের। কপিল-গাওস্কর-মোহিন্দর-বেঙ্গসরকার সমেত তখনকার সেরা। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে মেন্ডিসের অনভিজ্ঞ লঙ্কা জাস্ট ঘাবড়ে দিয়েছিল ভারতকে। সেই প্রথম দেখি অরবিন্দ ডি সিলভাকে। যিনি কপিল দেবের প্রথম বল হুক করে ছয় মারার দুঃসাহস দেখাতেন। হুকগুলো উড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারি আওয়াজ তুলত- কিল হিম। এক একটা উইকেট নিতেন সেই সিরিজের সেরা রুমেশ রত্নায়েকে আর শ্রীলঙ্কার বিখ্যাততম সমর্থক পার্সি অভয়শেখরা জাতীয় পতাকা নিয়ে উন্মত্ত ভাবে গোটা মাঠ ঘুরতেন। ওই রকম জঙ্গি আবেগ দেখে এক এক দিন হাঁ হয়ে যেতে হত।
তার পর যখন শ্রীলঙ্কা টেস্ট ম্যাচ ও সিরিজ জিতল- মাঠে জাতীয় উৎসব! নবীন দেশ ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে উঠে দাঁড়াতে চাইছে এটা সাংবাদিক জীবনের একেবারে গোড়ায় দেখেও আজও মনে গাঁথা।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট আবেগ যদি ফাস্ট বোলিং হয়। শ্রীলঙ্কারটা তাহলে মিডিয়াম পেস। এক ব্র্যাকেটেই পড়বে না।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরও বিশেষত্ব শুধু জনতা নয়। শুধু বোর্ড কর্তারা নন। সাংবাদিকেরাও তীব্র দেশজ আবেগের আধারে। বাইশ গজের ঘটনাবলির ওপর মিরপুর প্রেস বক্স যেমন প্রতিক্রিয়া দেয়, ক্রিকেট দুনিয়ায় তার দ্বিতীয় নমুনা নেই। সত্যি এক এক সময় মনে হয় বহুকাল আগের ইস্টবেঙ্গলকে গ্যালারিতে বসে ইস্টবেঙ্গলকে দেখছি। আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে এই জাতীয়তাবোধটা খুব অর্থবহ। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে একটা দেশ তার অন্তর্নিহিত হীনমন্যতা ও দারিদ্র থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইছে। তৃতীয় বিশ্বের যে কোনও দেশের কাছেই তো খেলার মাঠ গৌরবগাথা তৈরির জনপ্রিয়তম প্ল্যাটফর্ম। সেই আধারে দাঁড়িয়ে টিম পারফরম্যান্সের থার্মোমিটারের সঙ্গে সাংবাদিকের ব্যাক্তিগত পারদ তো ওঠানামা করবেই। যতই হোক না সে পেশাদার।
পুরনো ফাইল দেখতে দেখতে সে দিন হঠাৎ চোখে পড়ল বাংলার রঞ্জি ট্রফি জয় লিখতে গিয়ে অন্তত তিন জায়গায় লিখেছি ‘আমরা যখন ব্যাট করছিলাম’। যা পেশাদার সাংবাদিকের জন্য অমার্জনীয়। রিপোর্টার আবার ‘আমরা’ লিখবে কেন! কিন্তু সেই সময়টা ছিল প্রাক সৌরভ যুগ এবং আন্তঃরাজ্য ক্রিকেটেও বাংলার গভীর হীনমন্যতা। আনন্দবাজারেও তখন লেখালেখি হচ্ছে টেনিদার ম্যাট্রিক দেওয়া আর বাংলার রঞ্জি ট্রফিতে নামা একই ব্যাপার। ব্যর্থতার সংখ্যা এত বেশি যে ব্যর্থ হতে হতে এটা কত নম্বর হল তাও লোকে ভুলে গিয়েছে। দিল্লি বা মুম্বই ক্রিকেট টিম তখন কলকাতার ক্রিকেট লিখিয়েদের কাছে অবচেতনে ছিল বিদেশি রাষ্ট্র। সেই মনোভাব থেকেই কলমে অবচেতনে বেরোত ‘আমরা’। আজ আর বেরোয় না। প্রশ্নই নেই। হীনমন্যতাটাই যে নেই।
প্রতিক্রিয়া মুখর বাংলাদেশ প্রেস বক্সও একটা সময়ের পর এখনকার বাইশ গজ প্রভাবিত চেহারাটা হারিয়ে খানিক পেশাদারি হয়ে পড়তে বাধ্য। যে ভাবে একের পর এক টিমকে বাংলাদেশ হারিয়ে এগোচ্ছে তাতে পরিষ্কার একটা সঙ্কেত আছে। সঙ্কেত, এই টিম ম্যানেজমেন্ট রক্তের স্বাদ পেয়েছে। ঘোল বা সরবতে আর তাদের চলবে না।
এমনিতে ক্রিকেট খেলার সঙ্গে যে শান্ত, নির্ভীক, সাহসী, সংযত গুণগুলো জড়িয়ে রয়েছে, তার অনেক উপাদানই বাঙালি চরিত্রে নেই। বাঙালি সাধারণত আবেগের তীব্রতায় বিশ্বাসী। প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বাসী। উচ্ছ্বাসে বিশ্বাসী। গড়পড়তা ক্রিকেটার সেখানে অনেক নিস্পৃহ। তার ট্রেডমার্কই হল কিছুটা ঠোঁট চাপা আভিজাত্য। তার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ধৈর্য। তার আন্ডার স্টেটমেন্ট। যা একটা সময় ভিক্টোরিয়া যুগের ইংল্যান্ডেরও বৈশিষ্ট ছিল।
ক্রিকেট যত বলবে তার চেয়ে বেশি বলবে না। বাঙালি যত বলবে না তার চেয়ে বেশি বলবে।
এমন বৈপরীত্যে এটাই স্বাভাবিক যে আধুনিক ক্রিকেট কবিকে দুই বঙ্গেই বারবার পড়তে হবে-রেখেছ বাঙালি করে ক্রিকেটার করোনি।
ঐতিহাসিকভাবে মাশরাফি মর্তুজার আইপিএল ভাগ্য ক্ষতবিক্ষত এবং বিদীর্ণ দেখাতেও পারে। কিন্তু বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরেই তিনি।
মাশরফি দলবল নিয়ে যে প্রমাণ করেছেন- কবির আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি হবে ভিন্ন। রেখেছ বাঙালি করে আবার ক্রিকেটারও করেছ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy