Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
ডোপ-কলঙ্কের তদন্তে নেমে ধরা পড়ে ক্যানসার

একজনকেও নতুন বিশ্বাস দিতে পারলে সেটাই জয়, বলছেন টমাস

কেমোথেরাপির ছোবলে মাত্র তেইশ বছর বয়সে মাথার সব চুল পড়ে গিয়েছিল। শরীরে শক্তি বলতে কিছুই আর বেঁচে ছিল না। টমাস ফান ডার প্লেটসেনের দিকে নাকি তখন তাকানো যেত না। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে টমাসের ভাই, কোচ এবং তাঁর সবচেয়ে বড় ফ্যান মাইকেল পর্যন্ত ভেবে নিয়েছিলেন, এই শেষ।

.

.

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৬ ০৪:৫১
Share: Save:

কেমোথেরাপির ছোবলে মাত্র তেইশ বছর বয়সে মাথার সব চুল পড়ে গিয়েছিল। শরীরে শক্তি বলতে কিছুই আর বেঁচে ছিল না। টমাস ফান ডার প্লেটসেনের দিকে নাকি তখন তাকানো যেত না। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে টমাসের ভাই, কোচ এবং তাঁর সবচেয়ে বড় ফ্যান মাইকেল পর্যন্ত ভেবে নিয়েছিলেন, এই শেষ।

সেটা ছিল বছর দেড়েক আগের ঘটনা। আর এখন টমাস ফান ডার প্লেটসেনকে দেখে বোঝার উপায় নেই, ছিপছিপে সুন্দর তরুণের উপর কী ঝড় বয়ে গিয়েছে।

এই টমাসের মাথা ভর্তি বাদামি চুল। এই টমাস ইউরোপিয়ান ডেকাথলন চ্যাম্পিয়ন। এই টমাসের গন্তব্য হাসপাতাল বা কেমোথেরাপির ক্লিনিক নয়, এই টমাস যাচ্ছেন রিও!

আর বাকি প্রতিযোগীরা যখন সবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন যুদ্ধ জিতে বসে আছেন টমাস। তাঁর লড়াই তো পদকের স্ট্যান্ডে পৌঁছনো নয়। ক্যানসারের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ওঠা, রিও ভিলেজে অ্যাথলিটদের সান্নিধ্য আর সর্বোপরি রিওর যোগ্যতা অর্জন— এ সবই তাঁর জয়। এর সামনে কোথায় আসে এক টুকরো ফিতেয় বাঁধা ছোট্ট একটা চাকতি!

‘‘ফেরার রাস্তাটা খুব লম্বা ছিল। আমি যদি রিও পৌঁছে একজনকেও এই বিশ্বাসটা দিতে পারি যে, এ রকম পরিস্থিতিতে পজিটিভ থাকা যায়, তা হলে সেটাই আমার জয়,’’ বলেছেন বেলজিয়ান ডেক্যাথলিট টমাস।

যাঁর জীবনে চড়াই-উতরাই কম আসেনি। কুড়ি বছর বয়সে ক্যানসার ছিনিয়ে নেয় তাঁর বাবাকে। ২০১৪ ওয়ার্ল্ড ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পান। ঠিক তার পরেই আসে বেলজিয়ামের অ্যান্টি ডোপিং সংস্থার চিঠি— তাঁর নমুনায় নিষিদ্ধ হরমোন পাওয়া গিয়েছে।

পুরো ব্যাপারটা তিনি বুঝে ওঠার আগেই মিডিয়া টমাসকে নিয়ে পড়ে যায়। তাঁর সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় দেশে। কিন্তু টমাস জানতেন, ডোপ করেননি। ব্যাপারটার তদন্তে নামেন তিনি এবং আবিষ্কার করেন আরও ভয়াবহ এক সত্যের।

নিষিদ্ধ হরমোন নয়, তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে টেস্টিকুলার ক্যানসার।

যে সত্যিটা লণ্ডভণ্ড করে দেয় অ্যাথলিট টমাস তো বটেই, মানুষ টমাসের জীবনও। কেরিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আর গোটা জীবন ওলটপালট হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক— দুইয়ের মধ্যে যে কোনও একটা অন্য কাউকে হতাশা আর রাগে পিষে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট।

কিন্তু টমাস পিছু হঠেননি। যে হেতু তাঁর বিরুদ্ধে ডোপিংয়ের মারাত্মক অভিযোগ উঠেছিল, তাই ভীষণ ব্যক্তিগত এই অসুখ তিনি প্রকাশ্যে আনতে বাধ্য হন। যে সময় লোকে একাকীত্ব খোঁজে, সে সময় টমাস উঠে পড়ে লেগে যান যত বেশি সম্ভব মানুষকে তাঁর অসুখের কথা জানাতে।

‘‘ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। এত কম সময়ের মধ্যে আমাকে কাঠগড়ায় তুলে দেওয়া হল। নিজেকে বাঁচানোর সামান্য সময়টুকুও পাইনি। এর চেয়ে অন্যায় আর কী হতে পারে!’’ বলেন টমাস। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছে, সেটা বুঝে ওঠাও তখন তাঁর কাছে ছিল চরম বিলাসিতা। কারণ ততক্ষণে টিউমার সরাতে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে পরের পর কেমোথেরাপি সেশন।

ততক্ষণে তাঁর নামের পাশ থেকে ডোপিং কলঙ্কও উঠে গিয়েছে। তিন মাস পরে দেশের সেরা অ্যাথলিট হিসেবে ‘গোল্ডেন স্পাইক’ দেওয়া হয় টমাসকে। এবং সেই মুহূর্তেই টমাস ঠিক করে ফেলেন, ট্র্যাকে ফিরবেন।

যে অভিযানে ভাই মাইকেল হয়ে ওঠেন তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র। দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রেনিং ক্যাম্পে তাঁকে নিয়ে যান মাইকেল। দুই ভাইয়ের কেউই ডাক্তারি বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না। তাঁদের সম্বল ছিল সাহস, আশা আর কিছু শব্দগুচ্ছ— আত্মকরুণা দিয়ে ট্রেনিং হয় না!

মাইকেলের কথায়, ‘‘সর্বক্ষণ এটা নিয়ে অভিযোগ করলে বা কাঁদলে কী করে হবে? ব্যাপারটাকে ভুলে সামনে তাকাতে হবে। জীবনের ছোট ছোট জয়গুলো খুঁজে নিতে হবে।’’ ভোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন টমাস। কিন্তু মাঝে মধ্যেই অসুস্থ শরীরের কাছে হেরে যেতেন। সামান্য ওয়ার্ম আপ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠতেন। একটা দিন নির্বিঘ্নে কাটলে পরের দুটো দিন উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেতেন না। ‘‘আমি ওর সঙ্গে নির্মম ব্যবহার করতাম। কিন্তু টমাস জানত, ওকে পারতেই হবে,’’ বলেন মাইকেল।

আস্তে আস্তে পারছিলেনও টমাস। শারীরিক শক্তির অভাব ঢাকতে অ্যাথলেটিক স্কিল প্রয়োগ শেখা, নতুন ফোকাসে ঝাঁপানো— আস্তে আস্তে সবটাই আয়ত্ত করেছেন। ‘‘অন্য কোনও বিকল্প আমার ছিল না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। জানতাম, মাত্র একটা ভুল সব কিছু শেষ করে দেবে,’’ বলছেন টমাস।

রিওর যোগ্যতা পেতে গত গ্রীষ্মে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি গেমসে নামেন টমাস। গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে চোদ্দো নম্বরে শেষ করায় অল্পের জন্য রিওর টিকিট ফসকে যায়। তার পর গত শীতে হাজির নতুন আতঙ্ক— কনুইয়ে চোট। যার জন্য অলিম্পিক্স কোয়ালিফাইং পিছিয়ে দিতে হয় এ বছরের জুলাই পর্যন্ত।

আমস্টারডামে যে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ রিওর যোগ্যতার সঙ্গে তাঁকে এনে দেয় সোনার পদক। নতুন স্বপ্ন। নতুন বিশ্বাস।

অলৌকিক বললে অলৌকিক। কবিতা বললে কবিতা। রূপকথা বললে রূপকথা। টমাস ফান ডার প্লেটসেন অবশ্য একে অন্য নামে চেনেন— জীবন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Thomas Van der Plaetsen Rio Rio Olympics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE