Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
অ্যাথলেটিক্সের সোনার মেয়ের কাহিনি

বিরাট-মন্ত্র ও সচিনের জার্সি নতুন প্রেরণা ‘ধিং এক্সপ্রেসের’

ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ‘পোস্টার গার্ল’-এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিরাট কোহালি নিয়ে তাঁর আগ্রহের কারণ। উত্তরে জাকার্তায় সদ্য সমাপ্ত এশিয়ান গেমস থেকে জোড়া পদকজয়ী হিমা বললেন, ‘‘বিরাট কেন? সঙ্গে সচিন স্যারও থাকবেন।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:৪০
Share: Save:

ক্রিকেটের মরসুমেও গুয়াহাটি সরগরম তাঁকে নিয়ে। সরুসজাই স্টেডিয়ামের গায়ে ৪২ লক্ষ টাকায় সম্প্রতি ফ্ল্যাট কিনেছেন। গৃহপ্রবেশ আগামী মার্চে। দেড়শো কিলোমিটার দূরে তাঁর গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার ধারে বড় বড় সব পোস্টারে তাঁর মুখ। অসমে যখন প্রথম দিন-রাতের একদিনের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, তখন সেই রাজ্যের ‘শুভেচ্ছা দূত’ গুয়াহাটি থেকে ২১৯২ কিলোমিটার দূরের জাতীয় শিবির পাটিয়ালায়। ফোনে ধরা হলে তাঁর আক্ষেপ, ‘‘গুয়াহাটিতে থাকা ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালির সঙ্গে দেখা হল না।’’

শুক্রবার, দশমীর সন্ধেয় নগাঁও জেলার কান্ধুলিমারিতে তাঁর বাড়িতে বসে হিমাকে ফোনে যোগাযোগ করা হলে ‘ধিং এক্সপ্রেস’ (হিমার গ্রামের নাম ধিং, তাই এই নামেই তাঁকে এখন ডাকছে ভারতীয় ক্রীড়ামহল) বললেন, ‘‘২৫ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে অর্জুন পুরস্কার নেওয়ার সময় বিরাট ভাইয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপ হল। ওঁকে বলেছিলাম, গুয়াহাটিতে খেলতে গেলে মাঠে যাব আপনার খেলা দেখতে। কিন্তু জাতীয় শিবিরে চলে আসায় সেটা আর হয়ে উঠল না।’’

ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ‘পোস্টার গার্ল’-এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিরাট কোহালি নিয়ে তাঁর আগ্রহের কারণ। উত্তরে জাকার্তায় সদ্য সমাপ্ত এশিয়ান গেমস থেকে জোড়া পদকজয়ী হিমা বললেন, ‘‘বিরাট কেন? সঙ্গে সচিন স্যারও থাকবেন। বিরাট ভাই আমাকে দিয়েছেন জীবনে ফিটনেস ও শৃঙ্খলা ধরে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র। আর সচিন ওঁর শেষ টেস্ট ম্যাচের জার্সিতে এবং ব্যাটের প্রতিকৃতিতে সই করে দিয়েছেন।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘এশিয়ান গেমসের পদক বা জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পদকের চেয়ে কোনও অংশে কম প্রেরণামূলক নয় এই দুই উপহার। তাই দুই ক্রিকেট তারকার প্রতিই শ্রদ্ধা, সমর্থন সব সময় রয়েছে।’’

বিস্ময়: হিমা দাসের প্রাপ্তি সচিনের দেওয়া জার্সি।

বিরাট তাঁকে কী উপদেশ দিয়েছেন, জানতে চাইলে হিমা ফোনে বলতে থাকেন, ‘‘বিরাট ভাই বলেছেন, মন ইতিবাচক রাখো। আর সেটা থাকবে ফিটনেস চনমনে থাকলেই। সেখানে কোনও আপস করবে না। আর যদি পরিকল্পনা ছাড়া কখনও কোনও কাজ করতে যাও, তা হলে মনে রেখো তুমি নিজেই ব্যর্থ হওয়ার পরিকল্পনা করছ। কথাগুলো এখন রোজ নিজেকে বলি।’’

আর তেন্ডুলকর? দশমীর বিকেলে ফোনে কথা বলার সময়ে হিমার গলায় খুশির উচ্ছ্বাস। বললেন, ‘‘সচিন স্যরকে সামনে দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। ওঁর বাড়িতে যাওয়ার পরে আমার সঙ্গে দু’ঘণ্টা গল্প করেছেন। সঙ্গে ওঁর স্ত্রী অঞ্জলি ম্যাডামও ছিলেন। দু’জনেই মাথায় হাত দিয়ে বলেন, অলিম্পিক্সের পদকটা তোমার গলায় দেখতে চাই।’’ এখানেই না থেমে হিমা বলে চলেন, ‘‘সচিন স্যার এর পরেই ওঁর শেষ টেস্টে ভারতীয় দলের শার্ট নিয়ে এসে তাঁর উপর লিখে দেন, ‘হিমা তোমার স্বপ্ন সত্যি হোক, দেশকে গর্বিত করে চলো।’ সঙ্গে ছোট ব্যাটে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। যা আমার কাছে নতুন প্রেরণা।’’

গুয়াহাটি থেকে ১৫০ কিমি দূরের গ্রাম ‘ধিং’। শুক্রবার বিকেলে যখন সড়কপথে হিমার বাড়ি গিয়ে পৌঁছানো গেল, তখন সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। দাস‌ বাড়ির পনেরো জনের যৌথ পরিবারে তখন অনেকেই নেই। মেজ মেয়ে রিন্টি-কে নিয়ে হিমার বাবা রঞ্জিৎ দাস স্থানীয় নদীতে দশমীর বিসর্জন দেখতে গিয়েছেন। বাড়িতে ছিলেন মা জোনালি দাস। হিমার দুই যমজ ভাই-বোন বর্ষা ও বসন্ত, পিসি ভাগ্যশ্রী, জ্যাঠা-জেঠিমা ও তাঁদের পুত্র-পুত্রবধূরা।

বাড়িতে রাখা ট্রফি। নিজস্ব চিত্র

তাঁরাই জানাচ্ছিলেন, গত এক বছরে কতটা বদলে গিয়েছে কৃষক পরিবারের দিনলিপি। হিমার মা জোনালি বলছিলেন, ‘‘নিরানব্বই সালের শেষ দিকে আমাদের গ্রামে এসেছিলেন ড. ভূপেন হাজারিকা। ওঁর শরীরটা একটু খারাপ ছিল সে দিন। তাই আমার বাড়ির খাটে বিশ্রাম নিয়েছিলেন কিছুক্ষণ। মাস খানেক পরে বাড়িতেই সেই খাটেই জন্ম নেয় আমার মেয়ে। সে দিন থেকেই আমার মনে হত, আমার মেয়ে একদিন দারুণ কিছু করবে। সেটা ও করে দেখিয়েছে।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘কন্যাসন্তান হওয়ায় যাঁরা সে দিন দেখতে আসেননি, তাঁরাই এখন আমার মেয়ের অটোগ্রাফ নিয়ে যাচ্ছে।’’ বলার সময় মায়ের দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল।

বাড়ির লোকেরাই জানালেন, এশিয়ান গেমস থেকে ফেরার পরে আগামী ১১ অক্টোবর থেকে তিন দিন গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন হিমা। তখন ওঁর প্রিয় ‘চিকেন কারি’ ও ট্যাংরা মাছের ঝাল রেঁধে খাইয়েছেন মা, জেঠিমারা। হিমার জেঠিমা আবেগরুদ্ধ গলায় বলে ফেললেন, ‘‘আমাদের এই গরীবের ঘরে ওই তিন দিনে কে না এসেছেন! রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে গ্রামের সবাই। গ্রামের সবাই ওর অটোগ্রাফ চায়। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখন ‘হিমা’ হতে চায়। এ কথা যখন কানে শুনছিলাম, মহিলা হিসেবেই দারুণ গর্ব হচ্ছিল। গোটা এলাকাতেই আমাদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে ঘরের মেয়ে।’’ হিমার দাদারা গ্রামে তেরি করেছেন, ‘হিমা’স ব্রাদার্স অ্যাসোসিয়েশন’। সেই ‘ফ্যান ক্লাব’-এর সচিব হিমার জ্যাঠতুতো দাদা রাজীব বলছিলেন, ‘‘দুর্গাপুজোর আগে কার্বি-আংলং জেলায় কার্বি উৎসব হচ্ছিল। তা দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে যে-ই না লোকে জানতে পারল আমি হিমার দাদা, সঙ্গে সঙ্গে আমাকেই মঞ্চে তুলে নতুন পোশাক ও উপহারসামগ্রীতে ভরিয়ে দিল। বোনের জন্য সমাজে আমাদের সম্মানও অনেক বেড়ে গিয়েছে।’’

হিমার গ্রামের ছেলে নিলয় ডেকাও ছিলেন। পেশায় গাড়িচালক। কলকাতা থেকে আসা সাংবাদিককে তিনিও বলছিলেন, ‘‘ছোট্ট মেয়েটা গ্রামের ধানখেতের মাঠে ফুটবল খেলত ছেলেদের সঙ্গে। সেই মেয়েটা যে দিন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অর্জুন পুরস্কার নিচ্ছিল, তখন আমি গুয়াহাটিতে যাত্রী নামাচ্ছি। রাস্তার পাশে টিভিতে সেই ছবি দেখে যে-ই না বলেছি, আমার গ্রামের মেয়ে, তখন বন্ধুরা বলল, তা হলে আমাদের খাওয়া। গর্বে বুকটা ভরে যাচ্ছিল।’’

প্রতিবেশী সরস্বতী দাস আপ্লুত হিমার সৌজন্যে রাতারাতি গ্রামের রাস্তাঘাট ঠিক হয়ে যাওয়া, রাস্তার আলো ঝলমলে হয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এসে বলে গিয়েছেন, হিমার খেলার মাঠটা স্টেডিয়াম বানিয়ে দেবেন। হিমা একাই আমাদের কান্ধুলিমারি গ্রামকে তুলে নিয়ে গিয়েছে বিশ্বের মানচিত্রে।’’

স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর গ্রামকেই পাল্টে দিচ্ছেন ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের বিস্ময় প্রতিভা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hima Das Sachin Tendulkar Virat Kohli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE