উল্লাস: টেস্ট জিতে বিরাট লাফ। গেটি ইমেজেস।
ম্যাচ জিতে অ্যাডিলেড ওভাল থেকে বেরোচ্ছেন বিরাট কোহালি। আর তিনি, শেন ওয়ার্ন তখন মাঠের মধ্যেই তৈরি অস্ট্রেলীয় টিভি সম্প্রচার সংস্থার তৈরি স্টুডিয়োর মঞ্চে বসা। লাইভ টিভিতে থাকতে থাকতেই হঠাৎ পিছন ঘুরে বসলেন ওয়ার্ন। তার পরে ভারত অধিনায়ককে ডাকতে শুরু করে দিলেন, ‘‘বিরাট, বিরাট। এক বার প্লিজ এ দিকে এসো। তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।’’ কোহালি দ্রুত বুঝে গেলেন, নিশ্চয়ই এটা ওয়ার্নের মারণ গুগলি হবে। তাঁর উইকেট নেওয়ার ফন্দি রয়েছে। হাসতে হাসতে হাত নেড়ে বলতে থাকলেন, ‘‘না, না আমি আসছি না, শেন।’’
ওয়ার্ন তবু নাছোড়। বলতে থাকলেন, ‘‘আরে, এক বারটি এসোই না। যাওয়ার পথে শুধু দেখে যাও। তোমার জন্য একটা স্পেশ্যাল শট ধরে রেখেছি।’’ তার পরে সম্প্রচারকারী সংস্থার কর্মীদের বললেন, বিরাটকে দেখাও শটটা। কোহালি এগিয়ে আসতেই পরদায় ভেসে উঠল সেই মুহূর্তটা। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে গানের তালে তালে নাচ করছেন ভারত অধিনায়ক। সেটা দেখে পাশে বসা অ্যাডাম গিলক্রিস্টও একমত হলেন, এ রকম একটা উত্তেজক দিনেও কোহালি যে নাচের মেজাজে ছিলেন, সেটা ভারতের জন্য সুবিধে হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভারত অধিনায়ক অনেকটা চাপমুক্ত ছিলেন।
কোহালি নিজে যদিও একটু আগে বলে গিয়েছেন, মোটেও তিনি সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছিলেন না। অস্ট্রেলীয়রা লড়াই করে যাচ্ছে দেখে তিনি কি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন? জিজ্ঞেস করা কোহালির জবাব, ‘‘অস্ট্রেলিয়া ভাল দল। আমরা কখনও ধরে নিইনি যে, ওরা লড়াই করবে না। তবে এটাও ঠিক, সব সময় আমি বরফের মতো মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছিলাম না। পরিস্থিতি সব সময় অনুকূল ছিল না।’’ অস্ট্রেলিয়ার টেলএন্ডারদের লড়াই যখন ক্রমশ ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের মনে উদ্বেগ তৈরি করছে, তখন কোহালিকে বেশ কয়েক বার প্রতিক্রিয়া দিতেও দেখা যায় মাঠের মধ্যে। ইশান্ত শর্মার ‘নো’ বল করার সময় সব চেয়ে হতাশ লাগছিল তাঁকে। যদিও ভারত অধিনায়ক পরে বলে গেলেন, ‘‘নো বলটার জন্য সব চেয়ে হতাশ হয়েছে ইশান্ত নিজে। আমি বরং ওকে পরে গিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ইশান্ত খুব ভেঙে পড়েছিল। বার বার বলছিল, এত সিনিয়র এক জন বোলার হয়ে আমি কী করে টেস্ট ম্যাচের এমন মোক্ষম সময়ে নো বল করতে পারি!’’ তিনি সব চেয়ে খুশি চার বোলার নিয়ে খেলেও কুড়িটি উইকেট তুলতে পেরেছেন দেখে। ‘‘আমি বোলারদের নিয়ে গর্বিত,’’ বলছিলেন কোহালি। গত এক বছরের হিসাবে ভারতীয় পেস বোলাররা এখন সাফল্যের শতকরা হারে বিশ্বের মধ্যে দু’নম্বরে। অ্যাডিলেডেও যখন ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় খুব বেশি রান ওঠেনি প্রথম ইনিংসে, বোলাররা ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছেন ভারতকে।
আরও পড়ুন: লায়ন গর্জন থামিয়ে হুঙ্কার ভারতের, বডিলাইনের মঞ্চে রুদ্ধশ্বাস ইতিহাস
যদিও শেষ দিনে ভারতীয় শিবিরের জন্য দুশ্চিন্তা হয়ে রয়ে গেলেন আর অশ্বিন। সাউদাম্পটনে দ্বিতীয় ইনিংসে ক্ষতকে কাজে লাগিয়ে ভয়ঙ্কর হতে পারেননি। এখানেও শেষ দিনে পেলেন মাত্র একটা উইকেট। সাউদাম্পটনে স্পিনারের দ্বৈরথে হেরে গিয়েছিলেন মইন আলির কাছে। এখানে হারলেন নেথান লায়নের সামনে। কোহালি যদিও পাশে দাঁড়ালেন তাঁর সিনিয়র বোলারের। বললেন, ‘‘অশ্বিনকে নির্দিষ্ট একটি ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল। দারুণ ভাবেই সেটা করেছে। খুব কৃপণ বোলিংও করেছে।’’ অধিনায়ক যতই পাশে দাঁড়ান, ব্যাটসম্যানদের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষত তৈরি হওয়া শেষ দিনের পিচে মাত্র এক উইকেট নেওয়া দলের সেরা স্পিনারের জন্য মোটেও খুব ভাল বিজ্ঞাপন হয়ে থাকছে না।
কোহালির মুখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনা গেল চেতেশ্বর পূজারাকে নিয়েও। বললেন, ‘‘অমূল্য ইনিংস খেলেছে পূজারা। ওর সঙ্কল্প ছিল দেখার মতো। আমরা জানতাম, বড় রান তুলতে পারলে ওরা চাপে পড়বে। কিন্তু দ্রুত উইকেট হারিয়ে সেটা হবে কি না সংশয় দেখা দিয়েছিল। পূজারার লড়াই আমাদের জয়ের ভিত গড়ে দেয়। প্রথম ইনিংসে ওর জন্যই আমরা লিড পেয়েছিলাম।’’ প্রথম ইনিংসে ১২৩ করার পরে দ্বিতীয় ইনিংসেও ৭১ করে যান পুজারা। অধিনায়কের মুখে অজিঙ্ক রাহানেকে নিয়েও প্রশংসা শোনা গেল। বললেন, ‘‘অজিঙ্কের এই ব্যাটিংটাই আমরা দেখতে চাই। ওর ক্ষমতা আছে বোলিংকে শাসন করার। অজিঙ্ক মানে চাপে থাকা ব্যাটসম্যান নয়, বোলারকে চাপে ফেলা ব্যাটসম্যান। এই টেস্টে সেই অজিঙ্ককেই আমরা দেখতে পেয়েছি। আশা করব, এখান থেকে বাকি সিরিজের আত্মবিশ্বাস পাবে ও।’’ আত্মবিশ্বাসী হলেও আত্মতুষ্টিতে ভুগতে নারাজ কোহালি যোগ করছেন, ‘‘প্রথম টেস্টে যে আমরা জিতেছি সেটা খুবই ইতিবাচক দিক। এর পর এই ভিতের উপরে আমাদের ইমারত গড়তে হবে। একটা টেস্ট জিতে আমরা মোটেও সন্তুষ্ট হচ্ছি না। লক্ষ্য, পুরো সিরিজ জয়।’’
আত্মতুষ্টিতে যে তাঁরা ভুগতে চান না, তার প্রমাণ মিলল সন্ধের সেলিব্রেশন পার্টিতে। জেতার পরে টিম ‘গেট টুগেদার’ হল ঠিকই কিন্তু মধ্যরাত হওয়ার আগেই যে যাঁর ঘরে পৌঁছে গেলেন। সেই বিজয়ী সম্মেলনেও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো বেজে চলল একটা আর্তি— সিরিজ জিতে ফিরতে হবে। কেউ কেউ এমন কথাও বললেন যে, একটা টেস্টই শুধু জিতেছি, সিরিজ এখনও অনেক বাকি। অস্ট্রেলিয়া যে রকম লড়াই করেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাতে কোহালিরা বুঝে গিয়েছেন সহজে জমি ছাড়বেন না লায়নরা।
আরও পড়ুন: কুলদীপ থাকলে হয়তো আরও আগে জয় আসত
সেটা আরও ভাল করে বোঝা গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক টিম পেনের কথা শুনে। আঙুলে চোট লাগলেও মরিয়া পেন বলে গেলেন, তিনি একদম ঠিক আছেন। কোনও ব্যথা অনুভব হচ্ছে না এবং পরের টেস্টে জন্য ফিট হয়ে যাচ্ছেন। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট মহলে গত কয়েক দিন ধরে একই সঙ্গে প্রশংসিত এবং নিন্দিত হয়েছেন পেন। একটা অংশের মত, তাঁকে কোথা থেকে ক্যাপ্টেন করে দেওয়া হল? অন্য অংশ বলছে, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট কখনও গর্বের হারের ধার ধারেনি। কিন্তু এখন সংস্কৃতি পরিবর্তনের সময়। জেতার চেয়েও সততা রেখে জেতা জরুরি। তাই পেনকে মেনে নিতে আপত্তি নেই। হারের পরে টেলএন্ডারদের লড়াইকে উদাহরণ করার কথা বলে গেলেন পেন। আর কোহালি চার বছর আগে এই অ্যাডিলেডেই দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করার পরেও হারের কথা মনে করে বললেন, ‘‘চার বছর আগে তফাত ছিল ৪৮ রানের। আমরা ছিলাম ফলাফলের অন্য দিকে। অস্ট্রেলিয়ায় এসে প্রথম বার ১-০ এগিয়ে যেতে পারাটা আমাদের আত্মবিশ্বাসকে অনেক বাড়িয়ে তুলছে।’’ ভারত অধিনায়ক তাঁর প্রথম বিবাহ বার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছেন বেশ ধুমধাম সহকারেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy