চ্যাম্পিয়ন: বুয়েনস আইরেসে যুব অলিম্পিক্স থেকে ভারতকে ঐতিহাসিক সেই প্রথম সোনা এনে দেওয়ার পথে ভারোত্তোলক জেরেমি লালরিননুঙ্গা। সোমবার রাতে। ছবি: পিটিআই।
শ্রেয়া ঘোষাল ও জাস্টিন বিবারের গানের ভক্ত। আর ফুটবলে লিয়োনেল মেসির।
পাঁচ বছর বয়সে জাতীয় বক্সিং চ্যাম্পিয়ন বাবার পরামর্শে প্রথমে সে গিয়েছিল ফুটবল মাঠে। কিন্তু সেখানে বয়স কম বলে খেলার সুযোগ মিলত না। বাধ্য হয়ে তাই চলে আসতে হয় ভারোত্তোলনে। আইজলের সেই কিশোর ভারোত্তোলক জেরেমি লালরিননুঙ্গা-ই সোমবার রাতে যুব অলিম্পিক্স থেকে ভারতকে প্রথম সোনা এনে দিলেন। সেই মেসির দেশ আর্জেন্টিনা থেকেই।
জেরেমির সোনার ফলে যুব অলিম্পিক্সে এ পর্যন্ত সেরা পারফরম্যান্স ভারতীয় দলের। চার বছর আগে ২০১৪ সালে চিনে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় একটি রুপো ও একটি ব্রোঞ্জ পেয়েছিল ভারত। ২০১০ সালে যুব অলিম্পিক্স শুরুর বছরেও রুপো ও ব্রোঞ্জ নিয়েই ফিরেছিল ভারত।
ভারতীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধেয় আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে যখন ফোনে ধরা হল জেরেমিকে, সেখানে তখন সকাল। যুব অলিম্পিক্সের ইতিহাসে ভারতের প্রথম সোনাজয়ী প্রাতঃরাশ সারছেন। শুভেচ্ছা জানাতেই বছর পনেরোর মিজো ছেলে হাসতে শুরু করেন খিলখিলিয়ে। তার পরেই ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর আক্ষেপ, ‘‘আর্জেন্টিনায় এসে আমার নায়ক মেসির সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। মেসি এখানে নেই। বদলে ভারোত্তোলনে আমার আদর্শ, গ্রিসের বিখ্যাত খেলোয়াড় পিরোস দিমাসের (বর্তমানে মার্কিন ভারোত্তোলক দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর) সঙ্গে সোনা জেতার পরে দেখা হল। প্রচুর মূল্যবান পরামর্শ পেলাম। এটা বড় প্রাপ্তি।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘তখনও জানতাম না যে, আমি সোনা পেয়েছি। তার পরে যখন ঘোষণা হল, আর পোডিয়ামে সোনার পদক গলায় ‘জনগণমন’ গাইছিলাম, তখন দারুণ অনুভূতি হচ্ছিল। বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল সেই সময়।’’
জেরেমি বলে চলেন, ‘‘পাঁচ বছর বয়সে যখন ফুটবল মাঠে সুযোগ না পেয়ে বাড়িতে কান্নাকাটি করতাম, তখন বাবা একদিন বলেন, আর ফুটবল মাঠে যেতে হবে না। আজ থেকে আমার সঙ্গে অনুশীলন করবি।’’ জেরেমি বলেন, ‘‘ভিলেজে ফিরেই তাই বাবাকে ফোন করে খবরটা দিই। উনি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। তার পরে বলেন, দেখো, তোমার মাথা যেন ঘুরে না যায়। এটা সবে শুরু। তোমার তিনটে আসল পরীক্ষা কিন্তু ২০২০, ২০২৪ আর ২০২৮ সালের অলিম্পিক্স। সেখান থেকে সোনা আনতে না পারলে কেউ তোমাকে মনে রাখবে না। আগামী দশ বছরের কথা মাথায় রেখো।’’
জেরেমির বাবা লালনেইতলুয়াঙ্গা প্রাক্তন বক্সার। বর্তমানে মিজোরামে পূর্ত বিভাগের কর্মী। তাঁর সঙ্গেই প্রথম বক্সিং রিংয়ে ছয় বছর বয়স থেকে বক্সিংয়ে অনুশীলন শুরু জেরেমির। মিজো ভারোত্তোলক এ বার বলে ওঠেন, ‘‘মাঝে মাঝে বক্সিং অনুশীলন না থাকলে বড় বড় পাথর দু’হাত দিয়ে মাথার উপরে তুলে ধরতাম। আমি বন্ধুদের চেয়ে কতটা শক্তিশালী, সেটাই দেখানোর উদ্দেশ্য থাকত। এ ভাবেই চলার মাঝে একদিন এক সেনা কর্তার নজরে আসে বিষয়টি। তিনিই আমার খোঁজ নিয়ে বাবার কাছে চলে আসেন। সেটা ২০১১ সালের কথা। আমার বয়স তখন মাত্র আট। উনি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ভারোত্তোলনের কোচ। তার পরেই স্থানীয় এসওয়াইএস অ্যাকাডেমিতে শুরু হয় আমার ভারোত্তোলনে হাতেখড়ি।’’
এর আগে বিশ্ব ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে দেশকে রুপো এনে দিয়েছিলেন জেরেমি। চলতি বছরে জোড়া জাতীয় রেকর্ড ভেঙে যুব ও জুনিয়র এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপ থেকেও রুপো ও ব্রোঞ্জ পান তিনি। সোমবার রাতে যুব অলিম্পিক্সে দুই ধাপে ২৭৪ কেজি (১২৪ কেজি ও ১৫০ কেজি) তুলে সোনা জিতে নেন মিজোরামের ছেলে। ২৬৩ কেজি তুলে রুপো পান তুরস্কের তোপতাস কানের। কলম্বিয়ার ভিয়ার এস্তিভেন জোসে ব্রোঞ্জ পান ২৬০ কেজি তুলে।
সাফল্যের পরে মিজো ভারোত্তোলককে নিয়ে ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যবর্ধন রাঠৌরের টুইট ‘জেরেমির ঐতিহাসিক সোনা! পনেরো বছরের ছেলে পুরুষদের ৬২ কেজি বিভাগে যুব অলিম্পিক্স থেকে প্রথম সোনা এনে দিল। ধন্যবাদ ‘ইয়ং ম্যান’, যুব অলিম্পিক্স থেকে ভারতকে প্রথম সোনা এনে দেওয়ার জন্য।’
জেরেমির কোচ বিজয় শর্মা এই মুহূর্তে ছাত্রের সঙ্গে আর্জেন্টিনায়। ফোনে তিনি বলছিলেন, ‘‘ছেলেটা দারুণ প্রতিভাবান। ২০১৬ সালে প্রথম আমার কাছে আসে। অনুশীলনে দেখতাম, বড়দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওজন তুলছে। তাই দেখে অবাক হয়েই আমার কাছে নিয়ে আসি। ওর শরীরে ইতিহাস গড়ার মতো শক্তি রয়েছে। ভবিষ্যতে দেশকে গর্বিত করবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সোমবার সকালে ওকে বলেছিলাম, তোমার কাজ পারফরম্যান্স দেখানো। পদকের চিন্তা ভুলে যাও। সেই নির্দেশ মেনেই ভারতে নজির গড়ল আমার
ছাত্র জেরেমি।’’
২৬ অক্টোবর ১৬ বছরে পা দেবে জেরেমি। ২১ অক্টোবর দেশে ফিরেই চলে যেতে হবে পাটিয়ালার শিবিরে। তাই এখনই বাড়ি যাওয়া হবে না। তাতে যদিও আক্ষেপ নেই সোনার ছেলের। তাঁর কথায়, ‘‘বাবার কথা মাথায় রেখেছি। আগামী দশ বছরে তিনটে অলিম্পিক্স সামনে। যার প্রথমে টোকিয়ো অলিম্পিক্স। সেখান থেকে সোনা পেলে স্বপ্ন সার্থক হবে। তার জন্য জীবনে সব ত্যাগ করতে রাজি আছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy