এই ম্যাচ খেলার জন্য কোনও কোচের প্রয়োজন হয় না!
আই লিগে ইস্টবেঙ্গলের মরণ-বাঁচন ম্যাচ। যার উপর নির্ভর করছিল কাতসুমি ইউসা-দের খেতাবি ভাগ্য। অথচ গোকুলম এফসি-র বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল কোচ খালিদ জামিলের স্ট্র্যাটেজি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
দুপুর দু’টোয় ম্যাচ। কোঝিকোড়ের তাপমাত্রা পৌঁছে গিয়েছিল প্রায় ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খালিদ ফরোয়ার্ডে একা পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া ডুডু ওমাগবেমিকে রেখে দল নামাল। শুরুতেই তো পিছিয়ে পড়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ‘বৃদ্ধ’ ডুডুর পক্ষে গোকুলমের রক্ষণ ভেঙে গোল করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব ছিল। প্রথমার্ধে এক বারও গোল করার সুযোগ তৈরি করতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। তা সত্ত্বেও ভাগ্য সহায় ছিল বলে হাফটাইমের ঠিক আগে পেনাল্টি থেকে গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দিয়েছিল কাতসুমি।
ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে যাওয়ার পরে ভেবেছিলাম, দ্বিতীয়ার্ধে খালিদ স্ট্র্যাটেজিতে কিছু পরিবর্তন আনবে। ভেবেছিলাম, ফুটবলারদের ও বল ধরে খেলার নির্দেশ দেবে। কারণ দল যখন এগিয়ে থাকে, তখন নিজেদের মধ্যে বেশি পাস খেলে সমতা ফেরাতে মরিয়া হয়ে ওঠা বিপক্ষের ফুটবলারদের ছন্দ নষ্ট করে দিতে হয়। চেষ্টা করতে হয় কাউন্টার অ্যাটাকে গোলের রাস্তা খুঁজতে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে সঁ জরমাঁ-র বিরুদ্ধে এই স্ট্র্যাটেজিতেই বাজিমাত করেছিল জিনেদিন জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ। বিশ্বের সব দলই এই স্ট্র্যাটেজিতে খেলে। ব্যতিক্রম খালিদের ইস্টবেঙ্গল।
দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ার পরে উল্টে ইস্টবেঙ্গলই ধীরে ধীরে ম্যাচ থেকেই হারিয়ে গেল। গোকুলম ফুটবলারদের বরং অনেক বেশি উজ্জীবিত দেখাল। ৫৫ মিনিটে গোল করে সমতা ফেরাল কিভি ঝিমোমি। কলকাতা ময়দান থেকে উত্থান ওর। গোলটার জন্য কিভি ধন্যবাদ দিতে পারে ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক অর্ণব মণ্ডলকে!
খেলাটা দেখতে দেখতে আশির দশকে আইএফএ শিল্ডের একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমি তখন এরিয়ানে। সবুজ-মেরুন রক্ষণে ছিল বাবলুদা (সুব্রত ভট্টাচার্য)। পেনাল্টি বক্সের ঠিক সামনে আমাকে পাস দিয়েছিল পার্থ দে। গোলে শট নেওয়ার আগেই বলটা আমার পা থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল বাবলুদা। সেকেন্ডের কম ভগ্নাংশের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছিল। অবাক হয়ে দেখলাম, অর্ণব কোনও বাধাই দিল না কিভিকে।
গোকুলম সমতা ফেরানোর পরে ভেবেছিলাম, খালিদ এ বার আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলবে। কারণ, এই ম্যাচটা জিততেই হতো ইস্টবেঙ্গলকে। ড্র তো হারেরই সমান। ৭৫ মিনিট হয়ে যাওয়ার পরে খালিদের মনে হল দুই স্ট্রাইকারে যাওয়ার। নামাল মোহনবাগানের বাতিল আনসুমানা ক্রোমাকে। স্ট্রাইকারের প্রাথমিক জ্ঞানটাই ওর নেই। আর এক বিদেশি এদুয়ার্দো ফেরিরা। দল সংকটে অথচ ও মাঠ ছেড়ে উঠে গেল কিভি গোল করার তিন মিনিট পরে। ওর নাকি মাথা ঘুরছিল। আমার তো মনে হল, এদুয়ার্দো পালিয়ে গেল। শুনেছিলাম, সুধীর কর্মকার চোট নিয়েও দিনের পর দিন খেলে গিয়েছেন। আর মনাদার (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য) বিরুদ্ধে এবং সঙ্গে তো আমি নিজেই খেলেছি। দেখেছি দলের স্বার্থে প্রাণ বিসর্জন দিতেও তৈরি। গোকুলমের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল রিজার্ভ বেঞ্চে মনাদাকে দেখে সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল। দলের সঙ্গে রয়েছে, অথচ কিছু করতে পারছে না। কারণ, এখনকার ফুটবলাররা শুধু আর্থিক চুক্তির সময়ই যাবতীয় পেশাদারিত্ব দেখায়। মাঠে নেমে নয়। এই বিদেশিদের যারা সই করিয়েছে, তাদের ফুটবল বোধ নিয়েও আমার সংশয় রয়েছে। ব্যতিক্রম মহম্মদ আল আমনা ও কাতসুমি। ওরা দু’জনই যা লড়াই করল।
অতীতে এই ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইস্টবেঙ্গল বহু ম্যাচ জিতেছে। আশা করেছিলাম, শনিবার কোঝিকোড়েও লাল-হলুদ ঝড় দেখব। ভাবিনি ওরা এই ভাবে আত্মসমর্পণ করবে। দ্বিতীয় গোলও খেল একই ভুল করে। এ বার তো নিজের গোলেই বল ঢুকিয়ে দিল লাল-হলুদ ডিফেন্ডার সালামরঞ্জন সিংহ। ফুটবল খেলতে শুরু করার পরে শুনতাম, লাল-হলুদ জার্সি পরলেই তেতে ওঠে ফুটবলাররা। ইস্টবেঙ্গলে সই করার পরেই ব্যাপারটা উপলব্ধি করি। তবে এখন যারা লাল-হলুদ জার্সি পরে খেলছে, তাদের কোনও তাগিদ নেই। দায়বদ্ধতাও নেই। লিখতে বাধ্য হচ্ছি, লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলার যোগ্যতাই নেই ক্রোমা-দের।
১৯৯৩ সালে এশিয়ান কাপ উইনার্স কাপে ইরাকের আল জাওরা-র বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের বলেছিলাম, বিদেশি দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের যে লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে, তা ম্লান হতে দেওয়া যাবে না। প্রাণ বাজি রেখে খেলতে হবে। তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। ওই সময় এশিয়ার অন্যতম সেরা দল আলজাওরাকে ৬-২ উড়িয়ে দিয়েছিলাম। ইস্টবেঙ্গলের গৌরবময় ইতিহাসও এখনকার ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করে না। আর খালিদকে নিয়েও যত কম বলা যায়, তত ভাল। একটা দলকে (আইজল এফসি) আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করলেই ভাল কোচ হওয়া যায় না। পরিকল্পনাহীন কোচিং করিয়ে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানে সফল হওয়া যায় না। ও ফিজিক্যাল ট্রেনার গার্সিয়া মিরান্দাকেও কাজ করতে দিচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কারণ, ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের ফিটনেসের অভাব স্পষ্ট।
অঙ্কের বিচারে হয়তো ইস্টবেঙ্গলের এখনও আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি কিন্তু খুব একটা আশাবাদী নই। খেতাবি দৌড়ে মিনার্ভা এফসি নয়, ইস্টবেঙ্গলের প্রতিপক্ষ এখন যে ইস্টবেঙ্গল-ই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy