Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

তিনি এখনও মসিহা, তবে শুধুমাত্র ফুটবলের নন

আর্জেন্টিনার রোজারিও শহর বিখ্যাত দু’টি মানুষের জন্মস্থান হিসেবে। এক জন চে গেভারা আর অন্য জন লিয়োনেল আন্ড্রেজ মেসি! সংগ্রামের ইতিহাস বোধহয় রোজারিও থেকেই শুরু হয়! ছোট্ট বেঁটে-খাটো লিয়োনেলের প্রথম সংগ্রাম শুরু হয়েছিল নিজের শরীরের সঙ্গে।

বিধ্বস্ত: ফ্রান্সের কাছে হারের পরে মেসি। ছবি: রয়টার্স

বিধ্বস্ত: ফ্রান্সের কাছে হারের পরে মেসি। ছবি: রয়টার্স

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী (লেখক)
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৮ ০৫:৩০
Share: Save:

মানুষ দেবতা গড়ে
তাহার কৃপার ’পরে
করে দেব মহিমা নির্ভর
’।

গত শনিবার আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের খেলার শেষে সেই স্কুল জীবনে পড়া এই কবিতার লাইনগুলোই মনে পড়ছিল বারবার! হেরে যাওয়া আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়ক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে! কাকে খুঁজছিলেন তিনি? ঈশ্বরকে? নাকি ভাবছিলেন এতদিন যাঁরা তাঁকে ঈশ্বর বানালেন, এ বার তাঁরাই তাঁকে ধুলোয় ফেলবেন!

আর্জেন্টিনার রোজারিও শহর বিখ্যাত দু’টি মানুষের জন্মস্থান হিসেবে। এক জন চে গেভারা আর অন্য জন লিয়োনেল আন্ড্রেজ মেসি! সংগ্রামের ইতিহাস বোধহয় রোজারিও থেকেই শুরু হয়! ছোট্ট বেঁটে-খাটো লিয়োনেলের প্রথম সংগ্রাম শুরু হয়েছিল নিজের শরীরের সঙ্গে। গ্রোথ ডেফিশিয়েন্সি ছিল লিয়োর! কিছুতেই বাড়ছিল না শরীর! এর সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি পাশে পেয়ে যান বার্সেলোনা নামক স্প্যানিশ জায়েন্ট এক ফুটবল ক্লাবকে। কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন, বারুদ ঠাসা আছে ওই ছোট্ট শরীরটার মধ্যে!

তবু লড়াইটা এককই ছিল! আর সেই তখন থেকে লিয়োকে কাটাতে হয়েছে একের পর এক বাধা! আর কাটাতে কাটাতে তিনি পার করে গিয়েছেন, অলিম্পিক্সের সোনা, পাঁচটা ব্যালন ডি’অর, কোপা দেল রে, স্প্যানিশ লিগ, সুপার কাপ, সোনার বুট-সহ অসংখ্য ট্রফির মাইল-ফলক! মানুষ বুঝেছেন, এমন এক জন খেলোয়াড় এসে গিয়েছেন মাঠে, যাঁর শিল্প দেখলে ভুলে যাওয়া যায় পেলে, বেকেনবাউয়ার বা মারাদোনাকে খেলতে না দেখার আক্ষেপ। মানুষ বলতে শুরু করেন, তিনি ফুটবলের ঈশ্বর! বলতে শুরু করেন ২০১৪-এ একটুর জন্য বিশ্বকাপ হাতছাড়া হয়েছে ঈশ্বরের, এ বার সেই শেষ খামতিটুকুও মিটিয়ে নেবেন তিনি। কারণ ফুটবল-বিশ্বে ফুটবল-ঈশ্বর পারেন না, এমন কিছু নেই!

মেসি কোনও দিন নিজেকে ঈশ্বর বলেননি! বরং বলেছেন, খেলতে নামলে তিনি আর পাঁচ জন খেলোয়াড়ের মতোই!

তবু সাধারণ মানুষ বলেন নানা কথা! জীবনে, খেলার মাঠে ঈশ্বর খোঁজেন তাঁরা! খোঁজেন সেই লোক, যাঁর মধ্য দিয়ে তাঁদের স্বপ্ন সফল হবে। এবং সত্যি তো লিয়ো সফল করেন সেই সব স্বপ্ন! বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের কাটাতে কাটাতে তিনি কাটিয়ে ফেলেন আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের চোয়াল-চাপা কষ্ট। কাটিয়ে ফেলেন ব্যর্থতা, মনখারাপ আর সেই সব মানুষদের, যাঁরা বলেছিলেন, আমাদের দ্বারা আর কিছু হবে না! তাই রসা রোড থেকে রোসারিও, বার্সেলোনা থেকে বুরুন্ডি— সবাই তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে! রাত জেগে দেখেন, কী করে অসম্ভব সব ম্যাচ জিতিয়ে দিচ্ছেন তিনি! কী ভাবে আমাদের ভাঙাচোরা জীবনেও আনন্দের রূপকথা বুনে দিচ্ছেন! তাই অসংখ্য মানুষ অজান্তেই নিজের জীবনের লড়াইকে বেঁধে ফেলেন তাঁর সঙ্গে। বলেন, পারলে লিয়োই পারবেন! কারণ, ফুটবল গ্রহে লিয়োই ঈশ্বর!

মেসি নিজেকে কোনও দিন ঈশ্বর বলেননি। বরং রোনাল্ডোর সঙ্গে তুলনায় বারবার সম্মান দেখিয়েছেন তাঁকে। শত সাফল্যেও মাথা নত রেখেছেন। নম্র থেকেছেন। দরিদ্র আফগান শিশু তাঁর ভক্ত শুনে দেখা করেছেন তার সঙ্গে! জামা-কাপড়ের মতো সম্পর্ক পাল্টানোর যুগে, সেই ন’বছর বয়সে যে মেয়েটিকে ভাল লেগেছিল, তাঁর সঙ্গেই বেঁধেছেন সংসার! লোকে তাঁকে ঈশ্বর বললেও বরাবর মাটিতে পা রেখেই চলেছেন লিয়ো!

তবু এই বিপণন সর্বস্ব বিশ্বে কেউ সাফল্যকে সহজ থাকতে দেবেন না! তাই জি.ও.এ.টি. আখ্যা দেওয়া হল তাঁকে! বলা হল ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’! বিখ্যাত স্পোর্টস ড্রিঙ্ক সংস্থা তাঁকে নিয়ে বানিয়ে ফেলল দারুণ এক অ্যানিমেশন! পাহাড় প্রমাণ এক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হল তাঁর উপরে! বলা হল, বিশ্বকাপ না জিতলে তুমি কীসের গ্রেট! কীসের ঈশ্বর!

লিয়োনেল মেসি ঈশ্বর নন। তাঁকে ঈশ্বর বানিয়ে তাঁর পতন হয়েছে বললে হয়তো সেনসেশন তৈরি হয়, কিন্তু সত্যিটা জানা যায় না!

ওই অভিশপ্ত শনিবার, ম্যাচ শেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেই ঈশ্বরকে খুঁজছিলেন হয়তো! হয়তো ভাবছিলেন, একটা পেনাল্টি মিস হল বলেই কি ফ্রান্সের সামনে পড়লেন! ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার তিনটে গোলের মধ্যে দুটোর পিছনে তাঁরই অবদান! তবু জীবন এত নিষ্ঠুর কেন ঈশ্বর! কেন এমন গোলকিপার, এমন ডিফেন্স লাইন নিয়ে খেলতে আসতে হল! কেউ এ সব মনে রাখবেন না! সবাই তো বলবেন, মেসি পারলেন না!

না মেসি পেরেছেন! জেতা হারার বাইরে তিনি এমন একটা জিনিস পেরেছেন, যা অন্য কেউ খুব একটা পারেননি! তিনি পেরেছেন আমাদের সাহস দিতে! শিখিয়েছেন আমাদের লড়াই না ছাড়তে। শিখিয়েছেন, অন্যকে ছোট করে নয়, বড় হতে হয় নিজের গুণেই! তাই বিশ্বকাপ না জিতলেও মেসি জিতেছেন আমাদের মনের ভয় আর দুর্বলতার বিরুদ্ধে। বুঝিয়েছেন, সাফল্য ব্যর্থতা ভুলে লড়াই করে যাওয়াই ফুটবল, জীবন! তাই তিনি ফুটবল-ঈশ্বর না হলেও, তাঁর প্রেরিত দূত নিশ্চিত! তিনি মেসি, ফুটবলের মসিহা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE