Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কাপ হারালেও নিজেদের সেরা বলছেন মদ্রিচ

এই হাসিটা বিশ্বকাপ দেখেছিল অলিভার কান, জ়িনেদিন জ়িদান, লিয়োনেল মেসির মুখেও। ফাইনালে দল হেরে যাওয়ার পরেও যাঁরা সোনার বল পেয়েছিলেন।

রতন চক্রবর্তী
মস্কো শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৮ ০৪:৪০
Share: Save:

বুকে ধরে আছেন সোনার বলটা। যেমন করে সদ্য জন্ম হওয়া শিশুকে ধরে রাখেন মা।

জার্সি খোলেননি ম্যাচ শেষ হওয়ার দু’ঘণ্টা পরেও।

চোখের কোণে তখনও জল। বার বার সেটা সামলানোর চেষ্টা করছেন। মুছছেন।

লুঝনিকি স্টেডিয়ামের বিশ্বকাপ ফাইনালের ট্র্যাজিক নায়কই মনে হচ্ছিল লুকা মদ্রিচকে।

খেলার শুরুতে স্টেডিয়ামে যখন বিশাল পর্দায় লুকার ছবি ও নাম দেখানো হল, তখন সব চেয়ে বেশি উচ্ছ্বাসে ভেসেছিল গ্যালারি।

আর যখন ফিরলেন, তখন পা যেন নড়ছে না। স্পষ্ট দেখলাম, সোনার বলটা হাতে নিয়েও চোখ মুছছেন। তাঁর পিঠে হাত রাখলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। একটু হাসলেন লুকা। তার পরে হাত তুললেন গ্যালারিতে হেরে যাওয়ার পরেও হাততালি দিয়ে গান গাইতে থাকা ক্রোট সমর্থকের দিকে। হয়তো তিনি জানতেন, হেরে যাওয়ার পরেও ক্রোয়েশিয়া সমর্থকদের উচ্ছ্বাস শুধু তাঁর জন্যই মজুত থাকবে।

এই হাসিটা বিশ্বকাপ দেখেছিল অলিভার কান, জ়িনেদিন জ়িদান, লিয়োনেল মেসির মুখেও। ফাইনালে দল হেরে যাওয়ার পরেও যাঁরা সোনার বল পেয়েছিলেন।

ভারতীয় সময় রাত দেড়টা নাগাদ তাঁকে যখন ধরা গেল, তখন রীতিমতো বিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়ার তারকা। ‘‘পেনাল্টিটা ছিল না। ওটা অন্যায় ভাবে দেওয়া হয়েছে। আসলে সেরা দল তো সব সময় ম্যাচ জেতে না। আমরাও জিতিনি। কিন্তু আমরাই সেরা দল,’’ বলছেন লুকা। বলতে বলতেই কিছুটা ধাতস্থ হলেন তিনি। তার পর বেরিয়ে পড়ল সেই জেদি চেহারাটা। ‘‘ওই পেনাল্টিটাই আমাদের দলের তাল কেটে দিয়েছিল। ২-১ হয়ে যাওয়াটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমরা চ্যাম্পিয়ন না হতে পারি। কিন্তু সেরা দল আমরাই।’’ পাশাপাশি তাঁর মুখ থেকে বেরোল, ‘‘রেফারির প্রথম দু’টো গোলের সিদ্ধান্তই বিতর্কিত। প্রথম গোলটার আগে যে ফ্রি-কিকটা দেওয়া হয়েছিল, সেটা ছিলই না। পেনাল্টিটাও না। আমাদের দাবিকে রেফারি গুরুত্ব দেননি।’’

রিয়াল মাদ্রিদে তিনি ঢাকা পড়ে থাকতেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ছায়ায়। মাঝমাঠ থেকে পাস বাড়ান অজস্র। তাতে গোলও হয়। কিন্তু আলো পড়ে সি আর সেভেনের গায়ে। সেটাই এত দিন দেখেছে ফুটবলবিশ্ব। গত এগারো বছর বিশ্ব ফুটবলে পার্শ্ব চরিত্র হয়েই ছিলেন এই ‘এল এম টেন’। ব্যালন ডি’ওর পাননি। কিন্তু এ বার পেয়ে গেলেন সোনার বল এবং সেটা বিশ্বের সব নামী তারকাকে হারিয়ে, ৩২ বছর বয়সে এসে। লুকা বলছিলেন, ‘‘সোনার বল পেয়ে ভাল লাগছে। এতদিন পর একটা স্বীকৃতি পেলাম বলে। কিন্তু আমি চ্যাম্পিয়ন হতে চেয়েছিলাম। পারলাম না। একটা সিদ্ধান্ত সব শেষ করে দিল।’’

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গিয়েছে তাঁকে নিয়ে একটি বিখ্যাত জীবনমুখী গানের লাইন। তাঁর জীবনের ওঠা-পড়া, যুদ্ধ, ব্রাত্য হয়ে থাকা সব নিয়েই লেখা হচ্ছে ‘নীরবে জাতিস্মরের গল্প বলা তোমার ধরন’। অথবা কোথাও লুকার ছবি দিয়ে লেখা হচ্ছে, ‘‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সঙ্গীত।’’ লুকা কি তাঁর সম্পর্কে সমর্থকদের মনের কথা জানেন? না হলে কেন তিনি বলবেন, ‘‘যুদ্ধের জন্য ক্রোয়েশিয়ায় তো এক সময় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল ফুটবল। রাজনৈতিক কারণে ফাঁকা স্টেডিয়ামেও খেলতে হয়েছে আমাদের। যুদ্ধের পরে ভাল স্টেডিয়াম তৈরি হয়নি। সেটা করা দরকার। অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে আমাদের ফুটবল। এ বার যদি হ্যান্ডবলের পাশাপাশি ফুটবলটাও জনপ্রিয় হয়। ফাইনালে ওঠার পর আশা করছি এটা হবে।’’ শুকনো, রুক্ষ মুখ থেকে বেরোয় কথাগুলো। আবারও বললেন, ‘‘আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। ক্রোয়েশিয়ার সবাই খুব আশা করেছিল ট্রফিটা নিয়ে যাব।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, পরপর তিনটি ১২০ মিনিটের ম্যাচ খেলার জন্যই কি দ্বিতীয়ার্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ক্রোয়েশিয়া? বিশ্বকাপে অসাধারণ ফুটবল উপহার দেওয়া লুকা বলে দিলেন, ‘‘আমাদের কোনও ফুটবলারকেই পরিশ্রান্ত বলে
মনে হয়নি।’’

ফ্রান্সের কাছে ট্রফি খোয়ানোর পরে ড্রেসিংরুমে দীর্ঘক্ষণ বসেছিলেন লুকা, ইভান রাকিতিচরা। মারিয়ো মাঞ্জুকিচকে দেখা গেল রীতিমতো কাঁদছেন মিডিয়ার সামনে এসেও।

লুকার মতোই পেনাল্টি নিয়ে বললেন তাঁদের কোচ জ্লটকো দালিচও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘রেফারি ভিডিয়ো প্রযুক্তির (ভার) সাহায্য নিয়ে পেনাল্টি দিয়েছেন। কিছু বলার নেই। কিন্তু ফাইনালের মতো এ রকম একটা ম্যাচে ওটা না দিলেও পারতেন।’’ কোচ বা অধিনায়ক পেনাল্টি নিয়ে সরব হলেও ক্রোয়েশিয়া ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট দাভর সুকের কিন্তু বলে গেলেন, ‘‘ওটা পেনাল্টি ছিল। ফ্রান্স যোগ্য দল হিসেবেই জিতেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE