Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

সোনার হরিণ তৈরির রহস্য

ওঁরা মানে ফুটবল দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা স্কাউটের দল। আধুনিক যুগে ফুটবলের সব চেয়ে রোমহর্ষক চরিত্র। রাশিয়া বিশ্বকাপ মোটেও কিলিয়ান এমবাপেকে আবিষ্কার করেনি। বন্ডির পার্ক থেকে এই স্কাউটেরাই তাঁকে খুঁজে বার করেছেন বারো বছর আগে।

তারকা: কিলিয়ান এমবাপে। ফাইল চিত্র

তারকা: কিলিয়ান এমবাপে। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৮ ০৪:৩৭
Share: Save:

প্যারিস, আমস্টার্ডাম বা সাও পাওলোর কোনও পার্ক। শহরতলির দিকে হলে হয়তো তা-ও নেই। জুটবে খুব জোর এবড়ো-খেবড়ো মাঠ।

সেখানেই ল্যাকপেকে পায়ে ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়ে ব্যস্ত পাঁচ-ছয় বছরের শিশুরা। তাদের মায়েরা নেহাতই বৈকালিক বিনোদন উপহার দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছেন বাচ্চাদের। ‘অল ওয়ার্ক অ্যান্ড নো প্লে মেকস জ্যাক আ ডাল বয়’ যে!

পার্কের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা কিছু চোখ কিন্তু ‘জ্যাক’ নয়, ‘জ্যাকপটের’ খোঁজে। খেলে চলে শিশুরা আর দূর থেকে সতর্ক দৃষ্টিতে জরিপ করতে থাকেন ওঁরা। লক্ষ্যভেদী অর্জুনের মতোই চোখ স্থির ‘শিকারে’।

ওঁরা মানে ফুটবল দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা স্কাউটের দল। আধুনিক যুগে ফুটবলের সব চেয়ে রোমহর্ষক চরিত্র। রাশিয়া বিশ্বকাপ মোটেও কিলিয়ান এমবাপেকে আবিষ্কার করেনি। বন্ডির পার্ক থেকে এই স্কাউটেরাই তাঁকে খুঁজে বার করেছেন বারো বছর আগে।

গুপ্তচরের মতো বিশ্বের বিভিন্ন ফুটবলপাগল শহরে পাড়ি দেন ওঁরা। প্রত্যেকের সরকারি পরিচয়পত্র আছে। তবে সেগুলো বের করেন একান্তই যদি প্রয়োজন হয়। নইলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা নেটওয়ার্ক ‘হ্যাক’ করে পৌঁছে যেতে পারে সোনার খনিতে। যেখানে রয়েছে এমবাপের মতো সোনার হরিণ।

ফ্রান্সের শহরতলি বা ‘বঁলিউগুলি’তে সব চেয়ে বেশি ঘুরে বেড়ান স্কাউটেরা। রবিবার মস্কোয় যে ফ্রান্স দল বিশ্বকাপ জিতল, তার অন্তত আট জন বেড়ে উঠেছেন এই সব ঘুপচিতে। এমবাপে যখন বন্ডির মাঠে প্রতিভার ঝলক দেখাতে শুরু করেছেন, ইংল্যান্ডে বসে তাঁর কথা জেনে গিয়েছিলেন আর্সেনালের সদ্যপ্রাক্তন ফরাসি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার। এতটাই শক্তিশালী স্কাউটদের নেটওয়ার্ক।

বিশ্বের সব বিখ্যাত ক্লাবের অ্যাকাডেমি আছে। সেখানে কিশোর বয়স থেকে প্রতিভা অন্বেষণ চলে। এক দিন এই প্রতিভা যখন তারকা হবে, তাঁকে চড়া মূল্যে বড় ক্লাবে বিক্রি করে মুনাফা লুটবে তাঁর আবিষ্কারকেরা। এই প্রক্রিয়ার পথিকৃৎ আয়াখ্‌স অ্যাকাডেমি। রিনাস মিশেলসের নেতৃত্বে নেদারল্যান্ডস টোটাল ফুটবলের অভিনবত্ব দেখিয়েছিল। অ্যাকাডেমির মাধ্যমে ফুটবলকে ঝকমকে করে তোলেন আর এক ডাচ— ইয়োহান ক্রুয়েফ। আয়াখ্‌সের বিখ্যাত অ্যাকাডেমিতে দাঁড়িয়েই ক্রুয়েফের মুখ থেকে বেরিয়েছিল ফুটবলের সেই অমর পরামর্শ— উদ্‌ভ্রান্তের মতো দৌড়বে না। ফুটবলে আসল হচ্ছে, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকা। এক সেকেন্ড আগে নয়, এক সেকেন্ড পরেও নয়।

আয়াখ্স অ্যাকাডেমির নকশাই পরে ক্রুয়েফ তুলে নিয়ে যান বার্সেলোনার লা মাসিয়ায়। সেই মিশেলস, সেই ক্রুয়েফের মতো উদ্ভাবকের দেশ নেদারল্যান্ডসই এ বার বিশ্বকাপের যোগ্যতা পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি। ফুটবল তার মানে কত কঠিন, কত নির্মম খেলা! ভারত তা হলে কত পিছনে থাকতে পারে!

দু’ভাবে খেলা যায় ফুটবল। এক) শুধুমাত্র প্রতিভার উপরে নির্ভর করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকো খেলার মাঠে। স্কিল তৈরি করো। তা হলেই অন্যদের টেক্কা দেওয়া যাবে। এটা এখনও ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকার পদ্ধতি। দুই) ক্রুয়েফের দেখানো আয়াখ্‌স প্রক্রিয়া। যেখানে ফুটবলার আসলে সিস্টেমের ফসল। প্রতিভা খুঁজে পেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখো না, লগ্নি করো। রাশিয়া চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ফুটবল কোন হাইওয়ে ধরে এগোচ্ছে।

লিয়োনেল মেসিকে ১৩ বছর বয়সে লা মাসিয়া অ্যাকাডেমিতে সই করানোর জন্য বার্সেলোনা এতটাই মরিয়া ছিল যে, রেস্তোরাঁয় বসে ন্যাপকিনের উপরে লিখিত চুক্তি সেরে ফেলেছিলেন ক্লাবের কর্তারা। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো তৈরির কারখানা পর্তুগালের স্পোর্টিং লিসবন অ্যাকাডেমি। সেখানে ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। প্রথম দেখেই আলেক্স ফার্গুসন এতটা মুগ্ধ হয়েছিলেন স্যর যে, সে দিনই পাকা কথা সেরে ফেলে ম্যান ইউনাইটেড। ম্যাচের এক ঘণ্টা পরেও মাঠ ছেড়ে যেতে পারেনি ম্যান ইউ। কারণ, মাঠে বসেই ফার্গুসন এবং ম্যান ইউ কর্তারা রোনাল্ডোকে নিয়ে চূড়ান্ত কথাবার্তা সেরে নিচ্ছিলেন।

রোয়সিতে তাঁর আবাসনের পাশের মাঠে সারা দিন খেলতেন পোগবা। স্কাউটরা ঠিক জেনে গিয়েছিল। গরিবের ছাপ লেগে থাকা ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে মা ডাকতেন, ‘‘পল, চলে আয়, চলে আয়। পড়াশুনোও তো করতে হবে।’’ আর খেলতে খেলতে পোগবা উত্তর দিতেন, ‘‘যাব না, যাব না। আমি ফুটবলার হতে চাই। দেখবে, এক দিন ওয়ার্ল্ড কাপ জিতব আমি।’’

পোগবা তাঁর কথা মিলিয়ে দিয়েছেন রবিবারের মস্কোয়। তাঁকে ট্রফি তুলতে দেখে নিশ্চয়ই সব চেয়ে আনন্দিত তাঁর পুরনো পাড়ার স্কাউটেরা। যাঁরা রোয়সির পাড়ায় হানা দিয়ে প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন ফুটবল পেটাতে থাকা অক্লান্ত এক শিশুকে। পোগবা যে-দিন ৮৯ মিলিয়ন পাউন্ডে (প্রায় ৮০০ কোটি টাকা) ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে সই করলেন, সে-দিন তাঁর ছেলেবেলার ক্লাবেও আনন্দ উৎসব। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী, কোনও ক্লাব যদি কিশোর বয়স পর্যন্ত কোনও ফুটবলারকে তৈরি করে, তা হলে তাঁর ট্রান্সফার ফির-র ০.২৫ শতাংশ সেই ক্লাব পাবে। পোগবাকে তৈরি করার জন্য রোয়সি পেতে পারে প্রায় ৪০০,০০০ ইউরো।

রবিবার মস্কোর মাঠে শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সব চেয়ে গভীর দৃশ্যটা তৈরি হল। রিজার্ভ বেঞ্চের ফুটবলারদের নিয়ে মাঠের দিকে ছুটলেন কোচ দিদিয়ে দেশঁ। রিজার্ভ বেঞ্চের ফুটবলারদের বয়স? ২১, ২১, ২২, ২৩...। একটা দৌড় শেষ হল, আর একটা দৌড় শুরু হল। একটা দল চ্যাম্পিয়ন, তাদের পরের প্রজন্ম তৈরি চার বছর পরের মহাযজ্ঞের জন্য। ক্রুয়েফের সেই অমর বাণী— ফুটবল হল ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় উপস্থিত হওয়ার খেলা। এক সেকেন্ড আগে নয়, এক সেকেন্ড পরেও নয়! ফ্রান্সের পার্ক আর রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা স্কাউটদেরও তো সেটাই মন্ত্র। নিঃশব্দে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় উপস্থিত হয়ে যাও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE