Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

সংহতিতেই সিংহাসন অর্জন করে নায়ক সেই দেশঁ

ফ্রান্সে বাস্তিল দূর্গ পতনের উদযাপন ছিল শনিবার। রাজতন্ত্র অবসানের জয়োৎসব পালন করেছিলেন সে দেশের মানুষ। তাঁর পর একদিনও পেরোল না। ফুটবলের রাজ সিংহাসনে ফিরল ছবি ও কবিতার দেশ।

মাহেন্দ্রক্ষণ: কুড়ি বছর পরে ফের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ট্রফি নিয়ে উল্লাস পল পোগবাদের। ছবি: গেটি ইমেজেস

মাহেন্দ্রক্ষণ: কুড়ি বছর পরে ফের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ট্রফি নিয়ে উল্লাস পল পোগবাদের। ছবি: গেটি ইমেজেস

রতন চক্রবর্তী
মস্কো শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৮ ০৪:২৭
Share: Save:

ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিলিয়ান এমবাপেরা যখন মাঠের মধ্যে আনন্দের সমুদ্রে ভাসছেন, কোমর দুলিয়ে নাচছেন, তখন রিজার্ভ বেঞ্জ থেকে উঠে দাঁড়ালেন দিদিয়ে দেঁশ।

মুষ্ঠিবদ্ধ দু’হাত আকাশের দিকে তুলে তিন তিন বার নিজেকে ঝাঁকুনি দিলেন। যেভাবে কুড়ি বছর আগে ফ্রান্সের প্রথম জয়ের বিশ্বকাপটা হাতে তুলে ধরেছিলেন, ভঙ্গিটা সে রকমই। সেই ছবিটাও ম্যাচের পর দেখানো হচ্ছিল স্টেডিয়ামের পর্দায়।

মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়েই এরপর তিনি দৌড়লেন তাঁর স্বপ্নপূরণ করা ছাত্রদের দিকে। কোচকে পাঁজাকোলা করে আকাশে তুলে দিলেন আঁতোয়া গ্রিজম্যান, উমতিতিরা। এমনভাবে কোচকে দোলাচ্ছিলেন ওঁরা যেন মস্কোভা নদীতে নিয়মিত চলা ক্রুজে ভাসছেন দেঁশ। হাসছেন তিনি। কালো কোটে তাঁকে মনে হচ্ছিল রাজাধিরাজ। গম্ভীর মুখে অনাবিল হাসি। গ্যালারিতে তখন সাদা-লাল-নীল পতাকা সগর্বে উড়ছে তাঁকে স্বাগত জানাতে। ফ্রান্স ফুটবলের নতুন প্রজন্মের ভগীরথ হয়ে দেশঁ গঙ্গা বয়ে এনেছেন কবিতার দেশে, তাঁকে নিয়ে তো উচ্ছ্বাস থাকবেই। গ্রিজম্যানদের তিনি পাঠিয়ে দিলেন গ্যালারির দিকে। হাততালি দিয়ে উৎসব পালনের জন্য। আকাশ থেকে ততক্ষণে হিরের টুকরোর মতো কাগজের টুকরো উড়ে পড়ছে বিজয়ীদের উপর। তার মধ্যেই দেশঁ চলে গেলেন ক্রোয়েশিয়া ফুটবলারদের কাছে। লুকা মদ্রিচ, রাকিতিচদের আদর করলেন প্রকৃত শিক্ষকের মতো।

ফ্রান্সে বাস্তিল দূর্গ পতনের উদযাপন ছিল শনিবার। রাজতন্ত্র অবসানের জয়োৎসব পালন করেছিলেন সে দেশের মানুষ। তাঁর পর একদিনও পেরোল না। ফুটবলের রাজ সিংহাসনে ফিরল ছবি ও কবিতার দেশ।

আরও পড়ুন: পেলের পর কনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল এমবাপের

আইফেল টাওয়ারের মতোই প্যারিসের ল্যুভঁর মিউজিয়াম বিশ্বখ্যাত। অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য ছবি দেখতে সেখানে ছুটে যান বিশ্বের চিত্রকর, পর্যটকরা। ফরাসিরা যে ভাবে কুড়ি বছর পর দিদিয়ে দেশঁর হাত দিয়ে ফের রাশিয়া থেকে কাপটা নিয়ে গেলেন, তাতে এই জয়ের ছবি সেখানে রাখা যেতেই পারে। হয়তো পাবলো পিকাসোর মতো কোনও চিত্রকর আনন্দে এঁকে ফেলবেন গ্রিজম্যান, এমবাপে বা পল পোগবাদের ছবি। যাঁদের গোল দৃষ্টিসুখ দিয়ে গেল। কোনও কবি লিখেও ফেলতে পারেন বিশ্বফুটবলের নতুনদের জয়গান নিয়ে কোনও কবিতা। মেসি, রোনাল্ডোদের সরিয়ে নতুন তারকার জয়গান তো শুরু হয়ে গেল মস্কো থেকে এ দিনই। তাদের নিয়ে তো লিখতেই হবে।

গোল, পাল্টা গোলে উত্তাল একটা ম্যাচ। ১৯৬৬-র পর বিশ্বকাপের ফাইনালে কখনও তো ছয় গোল হয়নি। বাহান্ন বছর পর সেটাই দেখল লুঝনিকি। গোলের সুগন্ধী ছড়িয়ে দেখল ফুটবলের জয়।

ফ্রান্সের প্রত্যেকটা গোলের পর গ্রিজম্যান বা এমবাপেদের উপর দলের ফুটবলারদের ঝাঁপিয়ে পড়া বা দিয়েগো মারাদোনার মতো পল পোগবাদের বুক বাজিয়ে, ‘‘দেখ আমরাই সেরা’ দেখানোর চারটে দৃশ্যের কোলাজও ঠাঁই পেতে পারে মিউজিয়ামে।

বিশ্বজয়ী: কাপ হাতে ফ্রান্সের গ্রিজ়ম্যানের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স

যোদ্ধাদের আত্মঘাতী হওয়ার উদাহরণ ইতিহাসে খুব একটা পাওয়া যায় না। দেশ দখল হয়ে গেলে অনেকসময় প্রতিপক্ষের অত্যাচার থেকে বাঁচতে নিজেরাই নিজেদের বুকে ট্রিগার টেপেন সেনারা। কিন্তু লুঝনিকিতে তো সেটা ছিল না। ম্যাচের শুরুতে কোণঠাসা হতে হতে যখন এমবাপে, গ্রিজম্যানদের তুলি আটকে যাচ্ছে, উমতিতিরা দম নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, তখনই তো লুকা মদ্রিচরা আত্মঘাতী হলেন। গ্রিজম্যান এ দিন হলেন ফ্রান্সের লিয়োনেল মেসি বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। সব সেটপিস নেওয়ার দায়িত্ব তাঁর। পেনাল্টি পেলে সবার আগে তিনি। ফ্রান্সের প্রথম দু’টো গেলের পিছনেই আতলেতিকো দে মাদ্রিদের স্ট্রাইকারের অবদান। প্রায় তিরিশ গজ দূর থেকে তাঁর ফ্রি-কিক থেকে উড়ে আসা বল যখন ক্রোয়েশিয়ার বক্সে পড়ছে তখন সেটা নিজের গোলেই ঢুকিয়ে দিলেন মারিয়ো মাঞ্জুকিচ। আত্মঘাতী গোলটা এত অপ্রত্যাশিত ভাবে হল যে, গ্রিজম্যান আঙুল তুলে দৌড়োনোর পর ফরাসি সমর্থকরা বুঝলেন গোলটা হয়েছে। তারপর গান শুরু করে দিলেন তাঁরা। কিন্তু সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া জাতি দাঙ্গার সময় কাঠের মোটা মোটা গুড়ি সীমানায় লম্বা করে ফেলে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন লুকা মদ্রিচের দেশের যোদ্ধারা। সেই রক্ত যাঁদের গায়ে তাঁরা তো লড়াইয়ে ফিরবেনই। ফেরালেনও পেরিসিচ। এরপরেও ফের আত্মঘাতী। সমতায় ফেরানোর গোলদাতাই খলনায়ক হয়ে গেলেন ক্রোয়েশিয়ার। গ্রিজম্যানের কর্নার নিজেদের বক্সে হাত লাগালেন পেরিসিচ। রেফারি ‘ভার’-এর দ্বারস্থ হলেন। পেনাল্টি হল। গ্রিজম্যান ২-১ করতেই ম্যাচ শেষ। সমতায় ফিরতে মরিয়া ছিল ক্রোয়েশিয়া। রক্ষণে আর নজর দেওয়ার সময় ছিল না তাঁদের। আর সেখান থেকেই পরপর দু’টো গোল ফ্রান্সের। স্বপ্নভঙ্গ ক্রোয়েশিয়ার।

এত দিন মেসি-রোনাল্ডোদের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ব্রাত্য লুকা মদ্রিচকে গোল্ডেন বল দেওয়ার জন্য ডাকা হতেই অঝোরে বৃষ্টি নামল। ফ্রান্স যখন কাপ নিচ্ছে তখনও অঝোরে ঝরছে বারি ধারা। ফুটবল ঈশ্বরের কৃপা যেন বর্ষিত হল দুই সাহসীর জন্য। ফ্রান্স এবং লুকা মদ্রিচ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE