Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কোচের অপদার্থতায় বিদায় ইস্টবেঙ্গলের

ডুডুর সঙ্গে হাত মেলাতে গেলেন তিনি। ডুডু হাত তো মেলালেনই না। উল্টে চিত্‌কার করে হাত ছুড়ে কিছু একটা বলতে বলতে ড্রেসিংরুমে চলে গেলেন। কোচের উপর বিরক্তি স্পষ্ট। র‌্যান্টি, অর্ণব, লোবোরা মাঠ থেকে ফিরছিলেন শ্মশান ফেরত যাত্রীদের মতো। তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। কেউ ছুঁয়েও গেলেন না একবার। তিনি আর্মান্দো কোলাসো সবার শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরলেন। বিধ্বস্ত!

ভুলের পর ভুল করে শেষ ফেড কাপ অভিযান। এ বার কি সরবেন কোলাসো! ছবি: উত্‌পল সরকার

ভুলের পর ভুল করে শেষ ফেড কাপ অভিযান। এ বার কি সরবেন কোলাসো! ছবি: উত্‌পল সরকার

রতন চক্রবর্তী
মারগাও শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:৩৭
Share: Save:

স্পোর্টিং ক্লুব-৪ (ভিক্টোরিনো-৩, উলফ)

ইস্টবেঙ্গল-৩ (র‌্যান্টি-পেনাল্টি, ডুডু, তুলুঙ্গা)

ডুডুর সঙ্গে হাত মেলাতে গেলেন তিনি। ডুডু হাত তো মেলালেনই না। উল্টে চিত্‌কার করে হাত ছুড়ে কিছু একটা বলতে বলতে ড্রেসিংরুমে চলে গেলেন। কোচের উপর বিরক্তি স্পষ্ট।

র‌্যান্টি, অর্ণব, লোবোরা মাঠ থেকে ফিরছিলেন শ্মশান ফেরত যাত্রীদের মতো। তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। কেউ ছুঁয়েও গেলেন না একবার। তিনি আর্মান্দো কোলাসো সবার শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরলেন। বিধ্বস্ত!

হাতে একটা ফাইল। ভাবা গিয়েছিল, তার ভেতর হয়তো পদত্যাগপত্র নিয়ে এসেছেন। না, আনেননি। ফেড কাপে দল খারাপ করলে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন রয়্যাল ওয়াহিংডো ম্যাচের পরেই। আজ টুর্নামেন্ট থেকে তাঁর দল ছিটকে যাওয়ার পরে বললেন উল্টো কথা।

“আমি জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো। সব দায় আমার। ক্লাব চাইলে আমাকে সরিয়ে দিতে পারে।” মানে নিজে সরবেন না। নিজের স্ট্র্যাটেজি তৈরি করার মতোই আর্মান্দোর মানসিক অস্থিরতাও স্পষ্ট। কী করবেন নিজেই জানেন না ইস্টবেঙ্গলের ‘হোম-সিক’ গোয়ান কোচ।

আর্মান্দো যে তীব্র চাপে আছেন আর অস্থিরতায় ভুগছেন সেটা বোঝা যাচ্ছিল ম্যাচের শুরু থেকেই। ঘনঘন পায়চারি করছিলেন টেকনিক্যাল এরিয়ার ভিতর। কখনও মাথা চাপড়াচ্ছেন বিশ্রী গোল খাওয়া দেখে। কখনও হতাশায় হাত ছুড়ে বসে পড়ছিলেন চেয়ারে। কিন্তু তাতে কী হবে? ইস্টবেঙ্গল যে এ বারও ফেড কাপ থেকে ছিটকে গেল, তার দায় ফুটবলারদের চেয়ে বেশি আর্মান্দোর।

তীব্র নাটকীয় এবং উত্তেজক ম্যাচে কার্যত কোচ-হীন স্পোটির্ং ক্লুব জিতে গেল শুধু জেদ আর একাত্মতার জোরে। যে দুটো জিনিসই আর্মান্দোর ইস্টবেঙ্গলের খেলায় ছিল না। ম্যাচটা পেন্ডুলামের মতো দুলতে দুলতে ১-০, ১-১, ১-২, ১-৩, ২-৩, ৩-৩, ৪-৩ হয়ে শেষমেশ স্পের্টিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

ঝুঁকবে না-ই বা কেন? ৩-১ এগিয়ে যাওয়ার পর পাড়ার ক্লাবের কোচও নিজের ডিফেন্স জমাট করেন। ইস্টবেঙ্গল কোচ সেটা করলেন না! অর্ণব-সুসাক স্টপারে হামাগুড়ি দিচ্ছেন, লোবো ব্লকার হিসাবে চূড়ান্ত ব্যর্থ দেখার পরেও আর্মান্দো উইংয়ের ফুটবলার বদলাতে শুরু করলেন। তাও দলের তিনটে গোলের পিছনে যে তুলুঙ্গা আর রফিকের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাঁদেরই।

ম্যাচটা দেখতে এসেছিলেন আই লিগ চ্যাম্পিয়ন বেঙ্গালুরু এফসি কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউড। যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে বলে গেলেন, “এই লোকটা পাঁচটা আই লিগ জিতেছে বিশ্বাস হচ্ছে না। তিন গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর নিজের ডিফেন্সে তালা লাগাল না! বিপক্ষ তো সুযোগটা নেবেই।”

দু’দিন আগেই পাড়ার মাঠ রায়া স্টেডিয়ামে ‘বাঘ’-এর মতো আচরণ করেছিলেন লাল-হলুদের কোচ। কুত্‌সিত গালিগালাজ দিতে-দিতে চড়াও হয়েছিলেন সাংবাদিকদের উপর। তাঁর স্ট্র্যাটেজির সমালোচনা হচ্ছে বলে। এ দিন সেই মিডিয়ার সামনে তাঁর মাথা নিচু। আশঙ্কায় কে কী কঠিন প্রশ্ন করে বসেন! বারবার বলছেন, “আমার কোচিং কেরিয়ারের দ্বিতীয় জঘন্য হার। ডেম্পোতেও একবার এ রকম হয়েছিল। মহীন্দ্রার বিরুদ্ধে। আমার কিছু বলার নেই। কী বলব!”

তাঁর ভুল স্ট্র্যাটেজি নিয়ে বারবার প্রশ্ন উড়ে এল সাংবাদিক সম্মেলনে। আর্মান্দো চুপ। বলবেনই বা কী? স্কুল-ছাত্ররা যেমন গরমের ছুটি, ক্রিসমাস, শীতের ছুটি পায়, সে রকমই নিজে বারবার গোয়ায় আসবেন বলে বছরে তিন-চারবার তিনি ছুটি দিয়ে দেন র‌্যান্টি-ডুডুদের। ফেড কাপে এসেও অনুশীলনের চেয়ে ছুটির দিন বেশি গিয়েছে ইস্টবেঙ্গলের। ফেড কাপে এমন অনেক দিন গিয়েছে যখন এখানে নিজের বাড়ি থেকে আসেনইনি টিম হোটেলে।

ফলে যা হওয়ার তাই হল! মারগাওয়ের এক অনামী ছেলে ভিক্টোরিনো ফার্নান্ডেজ গুনে-গুনে গোল করে হ্যাটট্রিক সেরে ফেললেন। ইস্টবেঙ্গলের মতো সুপার হেভিওয়েট টিম নিয়ে ছেলেখেলার ফল হাতেনাতে পেয়েছেন আর্মান্দো। এগারো কোটির টিমের হাতে কলকাতা ফেরার বিমানের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে স্পোটির্ং ক্লুব ফেড কাপ সেমিফাইনালে উঠে গেল। একদল অনামী আর বাতিল ফুটবলার দেখালেন হাফটাইমে দু’গোলে পিছিয়ে থেকেও পরের পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কী ভাবে দুমড়ে দেওয়া যায় অগোছাল, অপ্রস্তুত, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ একটা মেগা টিমকে।

ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার তালিকা বদলে গিয়েছিল খেলা শুরু হওয়ার মাত্র দশ মিনিট আগে। একেবারে অপ্রত্যাশিত কারণে। আর সেটাই একটা সময় আশীর্বাদ হয়ে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলে। ‘স্কোয়ার পাস’ ফুটবলার হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠা লিও বার্তোস ওয়ার্ম আপ করতে নেমে চোট পান। তীব্র সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও নিউজিল্যান্ডের এই অকেজো বিশ্বকাপারকে খেলিয়ে যাচ্ছিলেন আর্মান্দো। আজ কার্যত বাধ্য হয়ে নামালেন তুলুঙ্গাকে। ভারতীয় ফুটবলের ‘মামা’র বয়স তিরিশের কোটা পেরিয়েছে, কিন্তু এখনও কী দারুণ গতি! ইস্টবেঙ্গল যে তিনটে গোল পেল তার দুটোতে ‘মামা’র অবদান। ডুডুর গোলটা তুলুঙ্গার কর্নার থেকে। আর অন্যটা ‘মামা’ নিজেই করলেন।

মামার প্রথম দলে ফেরাটা যদি কাকতালীয় হয়, তা হলে মহম্মদ রফিকের নামাটা অঙ্ক মেনে। ওই পজিশনে যিনি খেলছিলেন সেই লালরিন্দিকারও চোট। আটলেটিকো দে কলকাতাকে চ্যাম্পিয়ন করার গোলটা যাঁর পা থেকে এসেছিল, সেই রফিক নেমেছিলেন ডিকার জায়গায়ই। শুরুতেই ০-১ পিছিয়ে পড়েও আর্মান্দোর দল ম্যাচে যে দারুণ ভাবে ফিরেছিল সেটা উইং থেকে মামা-রফিকের যুগ্ম ঝড়েই।

ইস্টবেঙ্গল কোচ আগের দিন বলেছিলেন, স্পোটির্ংয়ের দুই স্টপারের মধ্যে যে বিরাট ফাঁকা জায়গা থাকছে সেটা তাঁর দল কাজে লাগাবে। শুরুতে সেটা হলও। কিন্তু পোড়খাওয়া বিদেশি কালু স্পোটিংয়ের সেন্ট্রাল ডিফেন্সে দাঁড়িয়ে যেতেই আর্মান্দোর টিমের জারিজুরি শেষ। কোচেদের হাতে এ রকম অবস্থায় ‘প্ল্যান বি’ থাকে। কিন্তু যে দলটার ঠিকমতো অনুশীলনই হয় না তাদের হাতে বোধহয় থাকার কথা নয়। ইস্টবেঙ্গলেরও হাতে ছিল না।

ইস্টবেঙ্গল প্রশাসনে যা তীব্র ডামাডোল, আর্মান্দোকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন কে? তাঁকে ব্যর্থতার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কী, কোচের উপরই তো সব ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন কর্তারা। বুদ্ধি করে মোক্ষম চালই দিয়েছেন গোয়ান কোচ। কলকাতার বড় দলের কর্তাদের উপর তাঁকে সরানোর ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়েছেন। এ রকম কিছু মোক্ষম ফুটবল-বুদ্ধি যদি মাঠে দেখাতে পারতেন ইস্টবেঙ্গল কোচ!

ইস্টবেঙ্গল: শুভাশিস, অভিষেক, অর্ণব, সুসাক, খাবরা, তুলুঙ্গা (বলজিত্‌), লোবো, মেহতাব, রফিক (জোয়াকিম), ডুডু, র‌্যান্টি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

east bengal fed cup
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE