Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

কলকাতাকেই আঁকড়ে বিদ্রোহী এক ভিনদেশি

মন দিয়ে অটোগ্রাফ বুকে সই করে যাচ্ছেন পরের পর, ঠোঁটের দু’পাশ নড়ছে মাঝে মাঝে যেমন নড়ে সর্বক্ষণ। কোচ ট্রেভর বেলিসের ডাক এল এবং সোজা বাধ্য ছাত্রের মতো প্র্যাকটিস পিচে ঢুকে প্রাক্-ফাইনাল সাধনা। প্রতিক্রিয়া চাইব? দুরূহ ব্যাপার। আইপিএল নিযুক্ত এক জন করে নিরাপত্তারক্ষী সঙ্গে ঘুরছে ছায়ার মতো। প্রশ্ন করতে গেলেই আগে তাঁর রক্তচক্ষু! মুখের প্রতিচ্ছবি? বিবরণ নিষ্প্রয়োজন, কারণ সেটা ভাবলেশহীন! সুনীল নারিনকে দেখে কেউ বলবে, এত বলিষ্ঠ এক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কয়েক ঘণ্টা কেটেছে মাত্র!

বিতর্কের মাঝেও অবিচল। শনিবার বেঙ্গালুরুতে নাইটদের অনুশীলনে সুনীল নারিন।

বিতর্কের মাঝেও অবিচল। শনিবার বেঙ্গালুরুতে নাইটদের অনুশীলনে সুনীল নারিন।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৪ ০৩:০৬
Share: Save:

মন দিয়ে অটোগ্রাফ বুকে সই করে যাচ্ছেন পরের পর, ঠোঁটের দু’পাশ নড়ছে মাঝে মাঝে যেমন

নড়ে সর্বক্ষণ। কোচ ট্রেভর বেলিসের ডাক এল এবং সোজা বাধ্য ছাত্রের মতো প্র্যাকটিস পিচে ঢুকে প্রাক্-ফাইনাল সাধনা।

প্রতিক্রিয়া চাইব? দুরূহ ব্যাপার। আইপিএল নিযুক্ত এক জন করে নিরাপত্তারক্ষী সঙ্গে ঘুরছে ছায়ার মতো। প্রশ্ন করতে গেলেই আগে তাঁর রক্তচক্ষু!

মুখের প্রতিচ্ছবি? বিবরণ নিষ্প্রয়োজন, কারণ সেটা ভাবলেশহীন! সুনীল নারিনকে দেখে কেউ বলবে, এত বলিষ্ঠ এক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কয়েক ঘণ্টা কেটেছে মাত্র!

গৌতম গম্ভীর দৃশ্যত উত্তেজিত। কেকেআর ক্যাপ্টেনের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না, আইপিএল ফাইনালের মতো মহাযুদ্ধের আগে কী ভাবে এক জন ক্রিকেটারকে এমন অসহ্য চাপে ফেলে দিতে পারে তার নিজ দেশেরই ক্রিকেট বোর্ড! “আরে, এটা কি ডেড রাবার? এটা আইপিএল ফাইনাল। তার আগে এ ভাবে কোনও ক্রিকেটারকে চাপে ফেলে দেওয়া অন্যায়। শুনে রাখুন, সুনীল নারিন একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এত দূর আমাদের নিয়ে এসেছে। ওর জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম!”

টিম হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট বোর্ডকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে চলেছেন এক কেকেআর কর্তা। “ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি? বলল, আর ছেড়ে দেব। কেকেআর আইপিএল ফাইনাল খেলবে, আর নারিন যাবে ক্যাম্পে। আর মিডিয়াও পারে! ফালতু একটা ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে নাচানাচি করছে।” সংশ্লিষ্ট কেকেআর কর্তা জানতে চান, আজ পর্যন্ত ঠিক কতটা মর্যাদা ক্যারিবিয়ান স্পিনারকে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। আগে প্রামাণ্য নথি, তার পর ছাড়া না ছাড়ার তাত্ত্বিক প্রশ্ন!


নাইট সংসারেই থাকছেন নারিন।

কে ঠিক, কে ভুল প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক হল, আইপিএল ফাইনালের প্রাক্-লগ্নে অন্তত সুনীল নারিনের ঠিকানা পাল্টে গেল।

সুনীল নারিনের ঠিকানা মোটেও আর ‘কেয়ার অব ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট’ নয়। ওটা আপাতত ‘কেয়ার অব কলকাতা!’

ক্লাব বনাম দেশ বিতর্কের উত্তেজনার সেলসিয়াস যে বাড়িয়ে দিলেন ক্যারিবিয়ান অফস্পিনার। দেশের বোর্ডকে জানিয়ে দিলেন, তাঁর কাছে এখন কেকেআর আগে। কলকাতা আগে। দেশ পরে। আইপিএল শেষে।

অগুনতি চেষ্টা সত্ত্বেও যে কোনও রফাসূত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে না, তার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিলই। কেকেআর তো বটেই, নারিন নিজেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ডের মহাকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, আর দু’টো দিনের ছাড়পত্র তাঁকে দেওয়া হোক। তেমন হলে রবিবাসরীয় ফাইনাল খেলে পরের দিনই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের উড়ান ধরবেন। যোগ দেবেন জাতীয় শিবিরে। কিন্তু এই মুহূর্তে কেকেআর ছেড়ে চলে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দেশ ও ক্লাব কারও অমর্যাদা তিনি যেমন চান না, ঠিক তেমনই দু’টো ক্ষেত্রেই তাঁর দায়িত্ব আছে। কিন্তু ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট বোর্ড তাতে কর্ণপাত করেনি।

শুক্রবারই চরম নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছিল যে, প্রথম টেস্টের টিমে নারিন যদি থাকতে চান, তা হলে ১ জুন থেকে শিবিরে যোগ দিতে হবে। আইপিএল ফাইনাল খেললে চলবে না। দেশ বা ক্লাবের যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে। নারিন শেষ পর্যন্ত ক্লাবকেই বেছে নেন। যার পরপরই এ দিন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের পক্ষ থেকে মিডিয়াকে মেল করে জানিয়ে দেওয়া হল, নারিন নিজে সরে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ভারতে থাকতে চান। আইপিএল ফাইনাল খেলতে চান। আর তাই দেশের ক্যাম্পে যোগ দেবেন না। শুধু তা-ই নয়, নারিন প্রথমে বোর্ডকে বলেছিলেন ২৪ মে জানিয়ে দেবেন, ক্যাম্পে থাকবেন কি না। কিন্তু ২৪ মে-র বদলে ২৮ মে শেষ পর্যন্ত জানান যে, তাঁর পক্ষে ১ জুন যাওয়া সম্ভব নয়। অতএব নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনটে টেস্টে তিনি নেই। টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বিবেচ্য হবেন কি না, পরবর্তী ব্যাপার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান রিচার্ড পাইবাস বিবৃতি দিয়ে বলে দেন, “ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড বরাবর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটকে। তারা মনে করে, টেস্ট ম্যাচে নামার আগে এক জন প্লেয়ারের প্রস্তুতিতে যথেষ্ট দায়বদ্ধতা থাকা দরকার।”


ফাইনালেও বৃষ্টির ভ্রূকুটি।

যে ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট নারিন দেশের ক্রিকেটের প্রতি সেই দায়বদ্ধতা দেখাননি। তাই তিনি নেই। আইপিএল খেলবেন ভাল কথা। কিন্তু যত বড় স্পিনারই হোন, যথেষ্ট দায়বদ্ধতা না দেখালে দেশও তাঁকে ভাববে না।

ঘটনা হল, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে নারিন প্রথম নন। তাঁর আগেও দেশের বোর্ডের সঙ্গে টানাপড়েনের জেরে একটা সময় স্রেফ আইপিএল খেলে কাটিয়ে দিয়েছেন ক্রিস গেইল। ডোয়েন ব্র্যাভোও যে ব্যাপারে নারিনের ‘পূর্বসুরি’। ফুটবল বিশ্বে সাম্প্রতিক কালে নেইমারকে নিয়ে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন বনাম বার্সেলোনার টানাটানির ঘটনা বাদ দিলে, এমন বিশেষ ঘটতে দেখা যায় না দেশ ও ক্লাবের আলাদা ‘উইন্ডো’ থাকায়। অর্থাৎ, যে সময় দেশের খেলা থাকবে, ক্লাব ফুটবল বন্ধ। আবার ক্লাব ফুটবলের সময় দেশজ ফুটবলের ব্যাপার নেই। ক্রিকেটে তেমন নেই, এবং বেঙ্গালুরুর প্রাক্-ফাইনাল আবহ দেখলে মনে হবে, কোথাও গিয়ে যেন ম্যাচটাই বিদ্ধ এমন অযাচিত উদ্ভুত বিতর্কে।

অথচ মাঠের ‘ভিতর ও বাহিরে’ কী সব শিরশিরে যুদ্ধ! দেখলে যে কোনও ক্রিকেটরসিকের রসনা তৃপ্ত হবে।

বীরু বনাম গোতি।

ম্যাড ম্যাক্স বনাম নারিন।

কিলার মিলার বনাম মর্কেল।

সর্বোপরি, বীর বনাম জারা।

জাতীয় দলের এক সময়ের সতীর্থ দিল্লিওয়ালার বিরুদ্ধে শনিবার যুদ্ধের হুঙ্কার দিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন গম্ভীর। বলে গেলেন, রবিবার বীরু মাঠে দাঁড়িয়ে যতটা প্রার্থনা করবেন তাঁর উইকেটের, তিনিও ঠিক ততটাই করবেন বীরু নামলে। অস্ত্রও শোনা গেল তৈরি। মর্নি মর্কেল। মনে করা হচ্ছে যাঁর পেস মুশকিলে ফেলে দিতে পারে সহবাগকে। যতই বেঙ্গালুরুর উইকেট ব্যাটিং-সহায়ক হোক। যতই তিনি চেন্নাইকে ‘খুন’ করে আসুন না কেন। টিমটাকে নাকি ফাইনালের আগে একটা বিশেষ ‘জোন’-এ ঢুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। ক্রিকেটীয় ভাবে তো বটেই, মানসিক ভাবেও। যে ‘জোন’-এ শুধু ফাইনাল বাদে আর কিছু নেই। কেকেআর বলছে, তারা ফাইনাল পর্যন্ত উঠতে পারে সেটা কেউ ভাবেনি। পঞ্জাব উঠবে, সবাই জানত। তাই চাপটা পঞ্জাবের উপর বেশি। আর গ্রুপ লিগে ক’বার পঞ্জাব-বধ হয়েছে, প্লে-অফে কী হয়েছে সে সব নিয়ে ভেবেও লাভ নেই। লাভ নেই সহবাগ নিয়ে ভেবেও। যে কোনও এক জনের ব্যাটে-বলে হলেই তো গেল! তার চেয়ে ‘ফ্রেশ’ ভাবে নামা ভাল।

কী হবে?

শোনা গেল, ‘বীর-জারা’-র বীর রবিবার আসছেন। শাহরুখ খান আসছেন। ঠিক যেমন ইডেনে প্লে-অফে এসেছিলেন। এই পঞ্জাবেরই বিরুদ্ধে।

শনিবার রাতে বেঙ্গালুরুতে বৃষ্টি নামল। ঠিক ইডেন প্লে-অফের আগের দিনের মতো। পূর্বাভাস বলছে, রবিবারও সম্ভাবনা আছে।

শুধু টসটা জিতে যদি আরও এক বার ডাকওয়ার্থ-লুইসের খপ্পরে কিংসকে ফেলে দেওয়া যায়... ঠিক ইডেন প্লে-অফের মতো...!

চুম্বকে শেষ যুদ্ধ

• নারিন মুক্ত। ফাইনাল খেলছেন।
• ছোট মাঠ। ব্যাটিং সহায়ক উইকেট।
• কেকেআর সম্ভবত একই দল। পঞ্জাবের পেস আক্রমণ বদলাতে পারে।
• টিভি-র পর্দায় চোখ রাখুন রাত আটটা থেকে।
• বৃষ্টির আশঙ্কা থাকছে। পূর্বাভাস বলছে, সন্ধ্যায় কয়েক পশলা বৃষ্টি হতে পারে।
তবে চিন্নাস্বামীর জল নিকাশি ব্যবস্থা এত ভাল, যে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার কিছু পরেই খেলা শুরু হতে পারে।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ipltag rajarshi gangopadhyay sunil narine kkr
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE