Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আজ সঞ্জয়ের জেদ বনাম আর্মান্দোর মানসিকতার ডার্বি

লাল-হলুদ তাঁবুর প্রধান গেটে আর্মান্দো কোলাসোকে দেখে মনে হচ্ছিল, গিলোটিনের সামনে দাঁড়ানো কোনও লোক বুঝি! দেওয়াল লিখন লেখা হয়ে গিয়েছে, শুধু গলা যাওয়াটাই যেন বাকি! ময়দানের ফুটবল বহু কোচের বিদায় দেখেছে, কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের গোয়ান কোচ যে ভাবে বিদায় নিতে চলেছেন, সেই দৃশ্য কখনও চাক্ষুষ করেনি! মোহনবাগান চালু করেছিল, ক্লাব তাঁবুতে ডেকে এনে ফুল দিয়ে কোচ-ছাঁটাই প্রথা। ফালোপা বিদায়ের সময় ইস্টবেঙ্গল আরও একধাপ এগিয়ে যায়।

প্র্যাকটিস সেরে মাঠ ছাড়ছেন কোলাসো। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

প্র্যাকটিস সেরে মাঠ ছাড়ছেন কোলাসো। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫৩
Share: Save:

লাল-হলুদ তাঁবুর প্রধান গেটে আর্মান্দো কোলাসোকে দেখে মনে হচ্ছিল, গিলোটিনের সামনে দাঁড়ানো কোনও লোক বুঝি!

দেওয়াল লিখন লেখা হয়ে গিয়েছে, শুধু গলা যাওয়াটাই যেন বাকি! ময়দানের ফুটবল বহু কোচের বিদায় দেখেছে, কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের গোয়ান কোচ যে ভাবে বিদায় নিতে চলেছেন, সেই দৃশ্য কখনও চাক্ষুষ করেনি!

মোহনবাগান চালু করেছিল, ক্লাব তাঁবুতে ডেকে এনে ফুল দিয়ে কোচ-ছাঁটাই প্রথা। ফালোপা বিদায়ের সময় ইস্টবেঙ্গল আরও একধাপ এগিয়ে যায়। বিদায়ী ফালোপার হাত দিয়েই ফুল তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল তাঁর উত্তরসূরি আর্মান্দোকে।

কিন্তু এ বার ইস্টবেঙ্গলের আবহ আরও চমকপ্রদ। একইসঙ্গে লজ্জাজনক!

আজ আর্মান্দো যখন কলকাতা ডার্বিতে যুবভারতীর রিজার্ভ বেঞ্চে থাকবেন, ততক্ষণে তাঁর চেয়ারটাই হয়তো চলে গিয়েছে লাল-হলুদ রিজার্ভ বেঞ্চের একটু দূরে গ্যালারিতে বসে থাকা এক ডাচ ভদ্রলোকের দখলে।

ইস্টবেঙ্গলের একটি সূত্রের খবর, সোমবারই গভীর রাতে ওমান থেকে শহরে এসে পড়ছেন ডুডু-র্যান্টিদের নতুন কোচ এলকো সতৌরি। তিনি নাকি ডার্বির নব্বই মিনিটই পূর্বসূরি কোচের দলের পারফরম্যান্স দেখবেন। শেষ মুহূর্তে আর্মান্দো ‘ইউ-টার্ন’ না নিলে এ রকম চিত্রনাট্যই লিখে ফেলেছেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা।

ডেম্পোতে তাঁর কোচিংয়ে খেলা ফুটবলাররা মাঝেমধ্যে সহাস্য বলেন, ‘‘সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে এটাও হয়তো বিশ্বাস করতে পারি, কিন্তু আর্মান্দো পদত্যাগ করবেন বিশ্বাস হয় না!’’ সে জন্য পুরো চিত্রনাট্য জানা থাকলেও একটু কিন্তু-কিন্তু লাগছে ‘নিশ্চিত ছাঁটাই’ লিখতে। তবে গোয়া থেকে শহরে আর্মান্দোর স্ত্রী ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন। কোচ স্বামীর বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নিতেই তাঁর কলকাতায় আসা বলে ওয়াকিবহাল মহলের কাছে খবর। টাইসন, লোবো, জোয়াকিমের মতো ইস্টবেঙ্গলের গোয়ান ফুটবলারদের শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেও আর্মান্দো বিদায়ের যেন ইঙ্গিত। ডার্বির চব্বিশ ঘণ্টা আগেও টিম নিয়ে কোনও কথা বলেননি কর্তাদের রোষে পড়া ইস্টবেঙ্গল কোচ। ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, “কাল যদি চলে যাই তা হলে অবশ্য মধুর স্মৃতি নিয়ে যাব।” তাঁবু থেকে বেরোনোর সময় আর্মান্দোর এক বঙ্গসন্তান ফুটবলারের রসিকতা “কোচ তো শুনলাম ‘উদাসী হাওয়ার পথে পথে...’ নাকি গাইছে। ও কি সত্যিই চলে যাচ্ছে?”

একা কুম্ভ রক্ষা করার মতো মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্র অসুস্থতা সত্ত্বেও এ দিন সাতসকালে মাঠে চলে আসেন ফুটবলারদের বকেয়া মেটাতে। মন্ত্রী, মেয়র, মেয়র পারিষদ ইদানীং যাঁরা বিবৃতি দিয়ে বাজার গরম করে বাগান দখলের চেষ্টায় মশগুল থাকেন তাঁদের কারও দেখা নেই আই লিগের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগের সকালে। প্রায় এক মাসের মাইনে মেটানোর পরে মোহন-সচিবের বুজে আসা গলা থেকে ফুটবলারদের উদ্দেশ্যে শুধু বেরিয়েছে, “এই ম্যাচটার জন্যই আমরা টিম করি। সমর্থকেরা অপেক্ষায় থাকেন। চিন্তা কোরো না। সব টাকা পেয়ে যাবে। শুধু কাল জিতে আমাদের সম্মান রক্ষা করো।”

সে রকম আব্দার অবশ্য করেননি চাকরি হারাতে বসা ইস্টবেঙ্গল কোচ। আধঘণ্টার অনুশীলন শেষে প্লেয়ারদের গোল করে দাঁড় করিয়ে আর্মান্দো বলেছেন, “তোমরা বিশ্রাম নাও। নিজেদের মানসিক ভাবে তৈরি করো। কাল ঠিক সময়ে মাঠে চলে এসো।”

বাগান কোচ সঞ্জয় সেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইস্টবেঙ্গলের কোন দুর্বলতা আপনার চোখে পড়েছে? “মানসিক দুর্বলতা। পরপর দু’টো ম্যাচে গোল করে এগিয়ে যাওয়ার পরেও ওরা গোল খেয়েছে। আমার ছেলেদের বলেছি, ওই রকম কিছু ঘটলে ভেঙে পোড়ো না। লড়াই চালিয়ে যেও।” ইস্টবেঙ্গলে আবার অধিনায়ক খাবরা বাদে পুরো টিমের মুখে কুলুপ। কলকাতা ডার্বি কভার করতে আসা বিশ্বের এক নামী টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধিকেও লাল-হলুদ মাঠ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হল পাত্তা না দিয়ে। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আইএসএল ক্লাবগুলোর সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল-পেশাদারির পার্থক্যটা। ক্লাব বিপণনের বিশ্বব্যাপী সুযোগ এ ভাবে কেউ হাতছাড়া করে নাকি!

বাগান-বেঙ্গলের ডার্বি চলছে নব্বই বছর ধরে। কেউ হেরেছে, কেউ জিতেছে। কিন্তু ডার্বির আগে দুই ক্লাবের পরিবেশ কখনও সম্ভবত এমন থাকেনি। দুই তাঁবুতেই কেমন একটা থমথমে, জড়সড় আবহ। কোচ তাড়াও, ফুটবলারদের মাইনে নেই, বাগান-সচিব ছাড়া দুই প্রধানেই বড় কর্তাদের অনুপস্থিতি, মুখবন্ধের ফতোয়া কেমন যেন মরুভূমি মনে হয় দুই ক্লাব চত্বরকে। বড় ম্যাচের আগের দিনের সেই উত্তেজনা কোথায়? ইস্টবেঙ্গলে প্রথম এগারোর অনুশীলন হয়নি। আগের দিন ম্যাচ ছিল বলে। ফলে বোঝা যায়নি কে খেলবেন, কে নয়। তবে অস্ট্রেলীয় স্টপার মিলান সুসাকের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে দেখা গিয়েছে কোচকে। অর্ণব মণ্ডলের সঙ্গে জুটি বাঁধছেন হয়তো সুসাক। ডুডুও শুরু থেকে থাকবেন র্যান্টির পাশে। বাগানে রক্ষণ-মাঝমাঠ একই রেখে অনুশীলনের সময় স্ট্রাইকারে বারবার বদল এনেছেন সঞ্জয়। কখনও বলবন্ত, কখনও পঙ্কজ মৌলা সঙ্গী বোয়া-র। “সবাইকে শান্ত থেকে জেতার জন্য খেলতে বলেছি। নিজেদের গোল সামলে আক্রমণে যাব। ইস্টবেঙ্গল দেশের অন্যতম শক্তিশালী দল। তা সত্ত্বেও তিন পয়েন্টই কাল লক্ষ্য,” বলার সময় সঞ্জয়ের গলায় জেদ। সনি নর্ডি-কাতসুমিদের মধ্যে সেটা সঞ্চারিত হলে ডার্বি কিন্তু জমে যাবে।

আবার চাপের মুখে ইস্টবেঙ্গল সব সময় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। আর্মান্দোরও যুবভারতীতে ডার্বি-রেকর্ড ভাল। আজ জিতলে হয়তো শহিদের মর্যাদা পেয়ে যাবেন তিনি! সঞ্জয় জিতলে পা রাখবেন বড় কোচের মর্যাদা পাওয়ার মঞ্চে। বুগনভেলিয়া, ডালিয়া, গোলাপে রঙিন হয়ে থাকা বাগান-তাঁবুতে এনে দিতে পারবেন বসন্ত।

দেখার, বসন্তের হাওয়া দোলের আগে কোন রং মাখে লাল-হলুদ, না সবুজ-মেরুন!

মঙ্গলবারে

আই লিগ-- ইস্টবেঙ্গল: মোহনবাগান (যুবভারতী ৭-০০)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE