প্র্যাকটিসে চনমনে সনি। সোমবার। ছবি: উৎপল সরকার
বন্ধু সনি,
প্রথমেই তোমাকে ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা জানাই। গোয়ায় এখন উৎসবের মেজাজ। আলোয় সেজে উঠেছে বাড়ি-হোটেলগুলো। ঠিক কলকাতার দুর্গাপুজোর মতো। সমুদ্রের বিচে কত লোক! আমাকে চার্চিল ব্রাদার্স যেখানে ফ্ল্যাট দিয়েছে সেটা বেনোলিনের খাদারা পার্ক। একটু দূরেই নীল সমুদ্র। এখন সেখানে সারা রাত উৎসব চলছে। কিন্তু কেন জানি না আমার সেখানে যেতে এতটুকু ইচ্ছে করছে না। সঙ্গে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে থাকা সত্ত্বেও। কারণ বলটা-ই যে আমার পায়ে নেই। আমার এখনকার টিম চার্চিলকে তো ফেডারেশন বাতিল করে দিয়েছে এএফসি-র লাইসেন্সিং শর্ত না মানায়। সামনে তাই কোনও টুর্নামেন্ট নেই। গত দশ বছর গোয়ায় ক্রিসমাস চলছে আর আমি এ ভাবে বসে যন্ত্রণা ভোগ করছি কখনও হয়নি। যন্ত্রণাটা আরও বেড়েছে এটা ভেবে, মোহনবাগান কাল ফেড কাপে খেলতে নামছে আর আমি ওডাফা, বাগান সমর্থকদের আদরের ‘গোলমেশিন’ ওদের টিম হোটেলের একটু দূরেই বসে আছি--- একা। মনে হচ্ছে অন্য কোনও গ্রহে বসে আছি যেন। কেউ আমার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে না, মিডিয়া ইন্টারভিউ নিতে হামলে পড়ছে না, অনুশীলনের পর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য খাতা বাড়াচ্ছে না কেউ। কিন্তু গত তিন বছর আমিই তো ছিলাম মোহনবাগান। আর এখন? সব প্রত্যাশা সরে গিয়েছে তোমার দিকে। ট্রফির জন্য চাতকপাখির প্রত্যাশা নিয়ে কোটি কোটি সমর্থক তাকিয়ে আছে তোমার দিকে। আট মাস আগের ওডাফা যেন, এখনকার তুমি। সে জন্যই তোমাকে চিঠিটা লেখা।
কলকাতার সব খবর আমি রাখি। তোমাকে দেখে আমার তিন বছর আগে বাগানে প্রথম আসার কথা মনে পড়ছে। দারুণ মিল খুঁজে পাচ্ছি তোমার আর আমার মধ্যে। তোমাকে নিয়ে যেমন বাগান সমর্থকরা প্রত্যাশার ফানুসে উড়ছে এখন, কর্তারা ভাবছেন সাড়ে চার বছরের ট্রফির খরা একাই কাটাবে তুমি। এ রকম তো আমাকে নেওয়ার সময়ও ভেবেছিল সবাই। চার্চিলে তখন প্রচুর গোল করছিলাম, আই লিগে বারবার হায়েস্ট স্কোরারও হচ্ছি বলেই আমাকে নিয়েছিল মোহনবাগান। যেমন বাংলাদেশের শেখ জামালের হয়ে আইএফএ শিল্ডের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখে তোমায় নিয়েছে এ বার। কোটি টাকা দিয়ে। শুনলাম তুমি আজ ভারনার নাগোয়া মাঠে প্র্যাক্টিসের পর মিডিয়াকে বলেছ, নতুন এক স্বপ্ন নিয়ে ভারতে খেলতে এসেছ। সেরা বিদেশি হতে চাও ভাল খেলে। বাগানকে ট্রফি জেতানোই এখন একমাত্র লক্ষ্য তোমার। আরে আমিও তো মনে আছে এ রকমই বলেছিলাম, বাগানের হয়ে প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করার পর। আমার কথা শুনে তখন মাঠ ভর্তি করে আসতে শুরু করল বাগান সমর্থকরা। আসবেই তো। ট্রফি না পেয়ে পেয়ে যে ওরা তীব্র হতাশ, বুভুক্ষু। কিন্তু ওদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলাম কই? সব স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল আমার। গোল করেছি অনেক, কিন্তু তিন বছর ধরে একটা ট্রফিও দিতে পারলাম না। বাতিল করে দেওয়া হল আমাকে। কেউ বুঝল না ফুটবল এগারো জনের খেলা, একা ট্রফি দেওয়া যায় না। আমি গোল করছি, কিন্তু আমার ডিফেন্স গোল খাচ্ছে! কী করব? আর চোট-আঘাতে বিপর্যস্ত হলে ইচ্ছে থাকলেও কিছু করা যায় না। যাক সে কথা। ও সব পুরনো কাসুন্দি না ঘাঁটাই ভাল। আর ব্যর্থরা বেশি কথা বললে লোকে বলে, অজুহাত।
যে কথা বলছিলাম, তোমাদের টিমটা এ বার খারাপ নয়। তুমিও নাকি সেটা স্বীকার করেছ। ফেড কাপে তোমাদের শুধু কোচ বদলেছে। সুভাষ ভৌমিকের জায়গায় সঞ্জয় সেন। এটা তো কলকাতায় আকছারই ঘটে। বিশেষ করে মোহনবাগানে। ওতে কিছু মনে কোরো না। কলকাতায় থাকলে সয়ে যাবে সব কিছু। আমার তিন বছরে মনে হয় ছ’সাত জন কোচ বদলেছিলেন কর্তারা। তুমি ছাড়া টিমে কোচ বদলের পর বেলো রজ্জাক, ডেনসন আর আনোয়ার এসেছে। বেলো বহু দিন খেলছে। একটু স্লো। জানি না, ওর সঙ্গে আনোয়ার না কিংশুক কে স্টপারে খেলবে। প্র্যাক্টিসে নাকি বেলো আর আনোয়ার খেলেছে। তোমাদের প্রথম প্রতিপক্ষ বেঙ্গালুরু কিন্তু খুব ব্যালান্সড টিম। প্রথম ম্যাচেই সালগাওকরের মতো টিমকে হারিয়েছে। সুনীল ছেত্রী গোলটা চেনে। একটু বাঁ দিক থেকে খেলছে। শন রুনি একা স্ট্রাইকার। দীর্ঘ দিন একসঙ্গে খেলছে পুরো টিমটা। নিজে সাসপেন্ড থাকায় ওদের কোচ মাঠে থাকছেন না শুনলাম। তবে প্রথম ম্যাচে দেখলাম গ্যালারিতে বসে ৪-২-৩-১-ই খেলাচ্ছেন ওদের কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউড। সুনীল-শন রুনির গোল আটকাতে গেলে কিন্তু তোমাদের ডিফেন্সকে সতর্ক থাকতে হবে। আমার চিন্তা তোমাদের দুই স্টপারই জীবনে প্রথমবার একসঙ্গে খেলবে! শুনলাম তোমাদের টিমের ফর্মেশন ৪-১-৩-১-১। বলবন্ত একা স্ট্রাইকারে। একটু নীচে বোয়া। বোয়া নাকি এখন ভাল খেলছে? মানে আগের চেয়ে ভাল। ছেলেটা রোবাস্ট টাইপের ফুটবলার। আমার বা তোমার মতো স্কিল নেই। তবে গায়ে জোর আছে। ধাক্কাধাক্কি করে খেলে। দু’পাশের উইং দিয়ে তুমি আর কাতসুমি খেলবে শুনেছি। মাঝমাঠে ডিফেন্সের সামনে ডেনসন বল হোল্ড করবে। লালকমল পাসার হিসাবে থাকবে। তোমাদের নতুন কোচ সঞ্জয় তো বলেছেন, “আমার প্রথম লক্ষ্য সেমিফাইনাল। আর বেঙ্গালুরু ভাল দল হলেও ওদের হারানো সম্ভব। আমার দলের অনেকের খেলাই তো বেঙ্গালুরু জানে না।” আরও শুনলাম বেঙ্গালুরু-সালগাওকর ম্যাচ দেখে এসে তোমাদের কোচ বলেছেন, “সুনীলের গোলগুলো তো পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা।” কিন্তু সেটা হয়তো তোমাদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতেই বলছেন। কোচেরা এ রকম বলেই। তবে আমি বলে দিচ্ছি, সুনীল কিন্তু অত্যন্ত সুযোগসন্ধানী, বেঙ্গালুরু টিমটা পুরো তরতাজা। কোনও ফুটবলার আইএসএলে খেলেনি। যে কোনও টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচটা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। না জিতলেই কিন্তু পুরো দলটা কেব্লে যায়। এর পর মিডিয়া এত সমালোচনা করবে যে তুমি পাগল হয়ে যাবে। আর বাগান সমর্থকদের গালাগালি, মুন্ডুপাত! বাপরে বাপভয়ঙ্কর। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। আমি যে কত এ সব সামলেছি।
তবে যেখানে যে-ই খেলুক, সবার লক্ষ্য থাকবে কিন্তু তুমি। সবাই ভাবছে তুমিই জেতাবে, তুমি। যেমন আমাকে ভাবত। আমি চাই তুমি প্রত্যাশার চাপ সামলে সফল হও। গোল করো, দলকে জেতাও। আমি যা পারিনি তা কি করতে পারবে তুমি? প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকব। গোয়ায় এসেছ, জিতে নিউ ইয়ার-টা ভাল কাটাও এই কামনা করি।
নববর্ষ আগাম শুভেচ্ছা-সহ
ওডাফা ওকোলি
পুনশ্চ: ফেড কাপে মোহনবাগানের উদ্বোধনী ম্যাচের আগের দিন তাদের সেরা ফরোয়ার্ড সনি নর্ডিকে চিঠি লিখতে বসলে বাগান-বিতাড়িত ওডাফা ওকোলি হয়তো এ রকমই লিখতেন।
আজ ফেড কাপে
বেঙ্গালুরু এফসি বনাম মোহনবাগান
(ভাস্কো, বিকেল ৪-০০)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy