Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

পনেরো মিনিটের সুনামিতে বাগানের স্বপ্ন ছারখার

কলকাতার মতো মোটরবাইকে নয়, অটোরিকশায় দ্রুত হোটেলে ফিরে গেলেন ওডাফা। ইচে-শিল্টনরা যখন করিডর ধরে টিমবাসের দিকে শরীরটাগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, দেখে মনে হচ্ছিল দুর্ঘটনায় হঠাৎ মৃত কোনও নিকটাত্মীয়কে দাহ করে ফিরে যাচ্ছেন। হতাশ। চরম বিস্মিত। বাগানের টিমবাস স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় আশপাশে আক্ষরিকই নিকষ অন্ধকার। কারা যেন নিভিয়ে দিয়েছিল রাস্তার সব আলো!

মেসির আলিঙ্গনে হ্যাটট্রিকের নায়ক। ছবি: এএফপি।

মেসির আলিঙ্গনে হ্যাটট্রিকের নায়ক। ছবি: এএফপি।

রতন চক্রবর্তী
কোচি শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১৫:৪৬
Share: Save:

কলকাতার মতো মোটরবাইকে নয়, অটোরিকশায় দ্রুত হোটেলে ফিরে গেলেন ওডাফা।

ইচে-শিল্টনরা যখন করিডর ধরে টিমবাসের দিকে শরীরটাগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, দেখে মনে হচ্ছিল দুর্ঘটনায় হঠাৎ মৃত কোনও নিকটাত্মীয়কে দাহ করে ফিরে যাচ্ছেন। হতাশ। চরম বিস্মিত।

বাগানের টিমবাস স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় আশপাশে আক্ষরিকই নিকষ অন্ধকার। কারা যেন নিভিয়ে দিয়েছিল রাস্তার সব আলো!

‘পয়া’ টি কে চাট্টুনি ভিভিআইপি বক্সে বসে ছিলেন গ্যাঁট হয়ে। করিম বদলাননি তাঁর ‘পয়মন্ত’ জামা। তবু আলো ফিরল না গঙ্গাপারের তাঁবুতে। সাড়ে তিন বছর ধরে চলা গ্লানির মুকুটে সংযোজিত হল আরও একটা কাঁটা ২০১৪-কোচি ফেড কাপ। কলকাতা লিগের পর মরসুমের দ্বিতীয় ট্রফিও অধরা রয়ে গেল করিম-ওডাফাদের।

প্রথম পনেরো মিনিটের চার্চিল-সুনামি। তীব্র চাপের মুখে রাম-প্রীতম-শৌভিক-পঙ্কজ-কাতসুমি-আইবরদের যৌথ কাঁপুনি শুষে নিয়ে গেল বাগানের সব রং, সব আশা। সব স্বপ্ন। যে ম্যাচটা জেতার জন্য সবুজ-মেরুনকে সেরা পারফরম্যান্স করতে হত, সেখানেই করিমের টিম পরিকল্পনাহীন। সব বিভাগেই ব্যর্থ।

“টিমটা প্রথম তিনটে ম্যাচ এত ভাল খেলল। আজ এত খারাপ খেলছে কেন? এত মিস পাস! ২-১ লড়াইয়ে ফিরতে পারার মতো স্কোরলাইন। কিন্তু আরও চাপ বাড়াতে হবে,” হাফটাইমে বলছিলেন অবাক স্ট্যানলি রোজারিও। তিন বছর আগে যিনি বাগানকে শেষবার ফেড কাপ ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু ২-১ থেকে ২-২ করবে কে? পুরো টিমই যে কাঁপছে! মাঠের যেখানে যে যা বল পাচ্ছেন, তুলে দিচ্ছেন যেন ‘ওডাফাও নমঃ’ বলে। এ রকম ‘সুস্বাদু স্ট্যাটেজি’ পেলে কোনও বিপক্ষ কোচ ছাড়েন? শুধু ওডাফাকে ঘিরলেই যে কেল্লা ফতে।

চার্চিল কোচ মারিয়ানো ডায়াসও সেই পথেই হাঁটলেন। পাশে নেই সুভাষ ভৌমিক। কিছুই হারানোর নেই। উল্টে সামনে রয়েছেদেখিয়ে দেওয়ার দুনিয়া। নিজেকে প্রমাণের সেরা সুযোগ সামনে পেয়ে গোয়াকে সন্তোষ ট্রপি জেতানো কোচ প্রথম থেকেই সাহসী হলেন। পাল্টা আক্রমণ আর অঙ্ক কষা ফুটবলে ‘ভোকাট্টা’ করে দিলেন হাইপ্রোফাইল করিমের টিমকে। সেই সঙ্গে বাংলাকেও। কারণ করিমের হাতে ছিল পালতোলা নৌকো ভাসানো এবং মশাল জ্বালানো—দুটো দায়িত্বই। মরক্কান কোচ পারেননি। এক বছর পর ফের বাংলা ছেড়ে গোয়ায় যাচ্ছে ফেড কাপ। ফাইনালে যে গোয়ারই দুই টিম।

কেন আপনার টিমের আজ এই হাল? ড্রেসিংরুমের এক কোণে দাঁড়ানো বিধ্বস্ত করিমের মুখ থেকে বেরোল, “টুর্নামেন্টের সবচেয়ে খারাপ খেললাম সেমিফাইনালের প্রথম পনেরো মিনিট। দু’গোলে পিছিয়ে পড়ার পর উঠে দাঁড়ানো কঠিন ছিল।” আপনার টিমের মাঝমাঠ বলে কিছু ছিলই না! এত মিস পাস! শুধুই লং বল! উইং প্লে বলে নেই! হঠাৎ কেন একসঙ্গে এত কিছুর অভাব?.“প্রত্যাশার চাপেই সব শেষ হয়ে গেল। সেমিফাইনালে উঠতেই সবাই বলতে শুরু করল আমরা ট্রফি পাচ্ছিই। কলকাতায় বাড়ি থেকে ফুটবলারদের কাছে ফোন আসছে, মিডিয়াও কথা বলছে ট্রফি নিয়ে। সেটাই কাল হল,” অজুহাত দিয়ে চলছিলেন বাগান কোচ। কিন্তু আপনার এই টিম তো ডার্বি জিতে এসেছিল? ডার্বির চেয়েও বেশি চাপ ছিল এখানে? “ডার্বি আর ফেড কাপ সেমিফাইনাল সম্পূর্ণ আলাদা,” জবাব করিমের।

কিন্তু চার্চিল কোচের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে কেন করিমের ‘প্ল্যান বি’ দেখা গেল না? চার্চিলের স্ট্র্যাটেজি ছিল, কাতসুমি-ডেনসনকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ করে দেওয়া। যাতে তাঁদের থেকে ওডাফা আর ক্রিস্টোফার গোল করার বল না পান। সেই কাজে চার্চিল কোচ লাগিয়েছিলেন, মিশরের সাবানা আর গোয়ার লেনিকে। বাগান বক্স থেকে বেশির ভাগ বল জমা পড়ছিল তাঁদের পায়েই। যা ধরে দুই চার্চিল মিডিও বাড়াচ্ছিলেন কখনও উলফ, কখনও বলবন্তকে। এর থেকে বাগানের বেরনোর জন্য দরকার ছিল উইং প্লে। কিন্তু সেখানে তো আজ দুই বঙ্গসন্তান রাম মালিক আর পঙ্কজ মৌলা কম্পমান। বল পেলেই মিস পাস অথবা ওডাফাকে অহেতুক খুঁজে গেলেন দুই তরুণ। নিট ফল, বাগান মাঝমাঠ শাসন করতে পারল না।

ওডাফা-ক্রিস্টোফারের সঙ্গে বাগান ডিফেন্সের মাঝখানে ব্যারিকেড হয়েছিল চার্চিলের মাঝমাঠ। কোচি স্টেডিয়ামের যেখানে ক্রিকেট পিচ তার চারপাশে কুড়ি গজের বৃত্তের বিশাল ফাঁকা জায়গাটায় দাপালেন লেনি-সাবানা-আলেস-থাংজামরা। প্রশংসা করতেই হবে হোসিয়ারপুরের ছেলে বলবন্ত সিংহের। শুরুর তিন মিনিটের মধ্যে কর্নার থেকে পাওয়া বলে হেডে গোলটা করার সময় চার্চিল স্ট্রাইকারের আশেপাশে কেউ ছিলেন না। বলা যায়, হেডের সময় বাগান ডিফেন্সকে বোকা বানিয়ে বলবন্ত নিজেকে ফাঁকা করে নিয়েছিলেন। গোয়ার পারিবারিক ক্লাবটির প্রথম বার ফেড কাপ ফাইনালে ওঠার পিছনে সাবানা যদি হন প্রধান গায়ক, তা হলে বলবন্ত ছিলেন মূল তবলচি। যে পেনাল্টিটা থেকে চার্চিল ২-০ করল সেটাও বলবন্তের জন্যই। তাঁর ঝড় আটকাতে গিয়েই তো রুখতে নিজেদের ডিফেন্সে বিপদ ডেকে এনেছিলেন আইবর। পনেরো মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল বাগান।

ম্যাচটা তার পরেও পেন্ডুলামের মতো দুললেও বাগানের মুঠোয় আসেনি। তার মধ্যেই অবশ্য ক্রিস্টোফারের শট পোস্টে লাগল। উল্টো দিকে বলবন্তের হেডও পোস্টে লেগে ফিরল। ওডাফা ১-১ করার পর শঙ্কর ওঁরাও একটা ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন। ২-২ করার সেটাই সেরা সুযোগ। খোঁড়াতে থাকা ওডাফা ছাড়া বাগানের কাউকেই চোখে পড়েনি। সবচেয়ে খারাপ কাতসুমি আর ক্রিস্টোফার। ক্রিস্টোকে নিয়ে এ দিনের পর একটা লাইন লিখতে হচ্ছেই, ক্রিস্টোফার কলকাতা লিগে সুন্দর, বাকি কোথাও নয়।

সামনেই আইএফশিল্ড। আই লিগ। ফেড কাপের আলো নিভে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে, এ বারও আর কিছু হওয়ার নয়। করিমদের টিমবাসের দিকে তাকিয়ে কলকাতা থেকে আসা জনাচারেক বাগান সমর্থককে আক্ষেপ করতে শোনা গেল, “আবার মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজতে হবে। ওদের তবু কলকাতা লিগ আছে, আমাদের তো ডার্বি জয় ছাড়া কিছুই নেই।”

বাগান আবার বাগানে। যেখানে ফুলের বদলে আবার কাঁটা!

মোহনবাগান: শিল্টন, প্রীতম, ইচে, আইবর, শৌভিক (কিংশুক), রাম (জাকির), কাতসুমি, ডেনসন, পঙ্কজ (শঙ্কর), ওডাফা, ক্রিস্টোফার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mohun bagan federation cup
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE