টেনশন ভুলতে টেনিস। শনিবারের গার্সিয়া। ছবি: উত্পল সরকার
ফিকরু তেফেরা কি খেলবেন?
ত্রাতা না কাঁটা— কোনটা ঝুলছে আন্তোনিও হাবাসের কপালে?
ইথিওপিয়ান স্ট্রাইকার গত দু’দিন এবং শনিবার অনুশীলন-ই করেননি। পুরো কলকাতা টিম বেরিয়ে যাওয়ার পর সবার শেষে টিম বাসে উঠতে যাচ্ছেন আটলেটিকো স্ট্রাইকার। ঘিরে ধরলেন শ’খানেক উত্সাহী দর্শক। অকাতরে সই বিলিয়ে কানে হেডফোন গুজে পা রাখলেন তিনি। বাসের পাদানিতে। জানিয়ে গেলেন, ‘‘কাল গোলের পর সমারসল্ট দেব।’’
কিন্তু ফিকরুর ব্যথাটা ঠিক কোথায়? টিমের সরকারি খবর, পিঠে ব্যথা। ভিতরের খবর, ব্যথাটা মনের! স্প্যানিশ ফুটবলারদের সঙ্গে তাঁর মানসিক ব্যবধান এতটাই বেড়েছে যে, তিনি ‘দ্যাখ কেমন লাগে’-র মতো আচরণ করছেন! চাইছেন, তাঁকে খেলানোর জন্য সবাই হামলে পড়ুক।
রবিবার এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে পেনাল্টি পেলে কে মারবেন? সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল কলকাতা কোচকে। পাশে তখন টিমের মার্কি ফুটবলার লুই গার্সিয়া। প্রশ্নটা শুনে গার্সিয়া হাসলেন। কাঁধও ঝাঁকালেন। মজাও পেলেন মনে হল। মুখের ভাবটা এমন করলেন যেন ‘ঠিক প্রশ্ন করেছেন। ফিকরুই তো যত সমস্যা তৈরি করছে’। আগের দিন পেনাল্টি মারার সময় বল নিয়ে গার্সিয়া-ফিকরুর কাড়াকাড়ি হয়েছিল। প্রশ্নটা সে জন্যই। হাবাস এত রেগে গেলেন যে, রীতিমতো চিত্কার করে বলতে শুরু করলেন, “ফিকরু, গার্সিয়া, বোরহা, হোফ্রে আমার টিমে যে কেউ পেনাল্টি মারতে পারে। এ সব প্রশ্ন কেন?”
আপনি বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার। টিমের মার্কি। আগের ম্যাচও দারুণ খেলেছেন। কিন্তু কাল খেলবেন?
প্রশ্নটা শুনে হালকা দাঁড়ি আর বাদামি চোখের রবার্ট পিরেস হেসে ফেললেন। “কোচ বলতে পারবেন। আমরা জিততে চাই। মুম্বইয়ে যেতে চাই। তা সে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকলেও সেটাই চাইব।” বলেই পাশে বসে থাকা জিকোর দিকে তাকালেন জিনেদিন জিদানের একদা সতীর্থ। কিছু একটা বললেনও। ইংরেজি না জানা ব্রাজিলের ‘সাদা পেলে’ কী বুঝলেন কে জানে। অদ্ভুতরকম শান্ত মুখটা নিয়ে ঘুরলেন পিরেসের দিকে। তারপর পাল্টা হাসি দিয়ে বোঝালেন, ‘আমি জানি তুমি টিমের ক্ষতি হয় এ রকম কিছু বলবে না’।
আইএসএলের ধুন্ধুমার সেমিফাইনাল খেলতে নামার আগের দিন দশ মিনিট আগে ও পরের দু’টো দৃশ্য বড় ক্যানভাসে বলে দিতে পারে ম্যাচের গতিপথ। দু’দলের ড্রেসিংরুমের রসায়নও হয়তো।
ফিকরু যখন বেরোচ্ছেন তখন তাঁর টিমেরই এক সতীর্থ বলছেন, “ও না খেললে ভালই হবে। আমাদের টিমের খেলার স্টাইলটা বদলাবে।” আর জিকোর টিমের এক বঙ্গসন্তান বলছিলেন, “আগের ম্যাচের ছয় জন ফুটবলার বদলাচ্ছে। আমরা অনেক শক্তিশালী হয়ে নামব।”
কোপা দেল রে থেকে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ— বিশ্বের সব নামী কাপের নক আউট নিয়ম উল্টে দিয়েছেন ধামাকা টুর্নামন্টের সংগঠকরা। দু’পর্বে ভেঙে ম্যাচ হয় যে কারণে সেটাই বদলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে গোল করলে বাড়তি সুবিধা নেই। বিদেশি রেফারির জঘন্য রেফারিং-এর মতো যা দেখে বিরক্ত সবাই। হাবাস থেকে জিকো, পিরেস থেকে গার্সিয়া— সবাই।
কিন্তু শিয়রে শমন। এ সব নিয়ে ভাবার কোনও ফুরসতই নেই কারও।
কলকাতা টিমে গোনা চলছে চোট ক’জনের। যুবভারতীর জঘন্য অ্যাস্ট্রোটার্ফ মিনি হাসপাতাল করে দিয়েছে হাবাসের টিমকে। অর্ণব মণ্ডল, কেভিন লোবো, ডেঞ্জিল, নাতো, ফিকরু, হোফ্রে— সবার চোট। কার্ডের জন্য নেই বলজিত্ সিংহ। হোফ্রে এ দিনও মাঠের বাইরে দৌড়ে গেলেন। অর্ণবের জায়গায় সিলভঁ মনসুরু খেলবেন। হাবাস এ দিন অনুশীলনে ফিকরুর বদলি তৈরি রাখলেন আর্নালকে। হোফ্রের বদলি পদানিও তৈরি।
কলকাতার মতো পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে জিকোর গোয়াতেও। তবে অন্য কারণে। গ্রুপ লিগের ম্যাচে বিশ্রাম দিয়েছিলেন যাঁদের, সবাই ফিরছেন টিমে। ভয়ঙ্কর সেট পিস অস্ত্র আন্দ্রে সান্তোস, স্লেপচিকা, রোমিও, মান্দার, সেদা, গ্রেগরি— সফল ফুটবলারদের যেন ছড়াছড়ি। গোয়ার উল্কার মতো উত্থানে যাঁদের কারও নামের পাশে গোল আছে, কারও অসাধারণ সেভ।
দু’টো টিমের অনুশীলনের ছবিও আলাদা। জিকোর টিমের অনুশীলন অদ্ভুত রকম শান্ত। শৃঙ্খলায় বাঁধা। কে কী করবে, সবই যেন কপিবুক মাফিক। সান্তোস, ক্লিফোর্ড মিরান্ডা পেনাল্টি, কর্নার, ফ্রিকিক মারবেন। আর রক্ষণ থেকে উঠে যাবেন দুই স্টপার— বেঙ্গেলুঁ আর গ্রেগরি। উইং প্লে থেকে রক্ষণের জমাট বাধার পরিকল্পনা— কে কী করবেন সবারই যেন জানা। উল্টো দিকে হাবাসের অনুশীলনে প্রচুর চিত্কার চেঁচামেচি। সবাই যেন ‘হেড মাস্টারের’ নির্দেশে জড়সড়। পজেশনাল মুভমেন্ট থেকে পেনাল্টি হাজির কলকাতার অনুশীলনেও, তবে অন্য রকম ভাবে। চিত্কার করছেন আর নিজে বল বাড়াচ্ছেন আটলেটিকো কোচ। বাকি সবাই রোবটের মতো নির্দেশ মানছেন। কোনও প্রাণ নেই যেন সেখানে।
স্প্যানিশ আর ব্রাজিলিয়ান ঘরানার যুদ্ধ দেখার আশা নেই। আড়াই মাসের লিগে নিজের মতো করে ঘর সাজিয়েছেন হাবাস আর জিকো। জিকো পেয়েছেন ডেম্পোর ফুটবলারদের। যাঁরা একসঙ্গে খেলেছেন বহু দিন। হাবাস সেই সুযোগ পাননি। সেটা একটা বড় অ্যাডভান্টেজ জিকোর গোয়ার। তবে জিকো নিজে বলছেন, “যুবভারতীর অ্যাস্ট্রোটার্ফের জন্য একটু এগিয়ে কলকাতা।” মনে হল বিনয় এটা। কারণ তাঁর হাতে যে সব ফুটবলার আছে, তাঁদের অনেকেই এখানে আই লিগ খেলে গিয়েছেন আগে। গার্সিয়ারা অবশ্য জিকোর ‘বাড়ানো বলে’ আত্মতুষ্ট হতে নারাজ।
জিকো বনাম হাবাসের এই তিন নম্বর যুদ্ধে জিতবে কে? শেষ দু’বারে একটিতে জিতেছে কলকাতা, অন্যটি ড্র হয়েছে। এ বার কে?
কলকাতার কোচ এবং ফুটবলারদের মধ্যে র্যান্ডম সমীক্ষা করে দেখা গেল গোয়ার পক্ষে বেশির ভাগেরই ভোট। কেন? ইস্টবেঙ্গলকে আই লিগ দেওয়া কোচ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য যুক্তি দিচ্ছেন, “গোয়ার টিমটা ব্যালান্সড। কিপার, ডিফেন্ডার, মিডিও, ফরোয়ার্ড সব জায়গাতেই নেতা আছে। কলকাতার যা নেই।”
আর মোহনবাগানের বর্তমান কোচ সঞ্জয় সেনের মন্তব্য, “গোয়াই এগিয়ে। উইং প্লে, সেট পিস, গোলমুখ খোলার দক্ষতা দুর্দান্ত। সান্তোস বলে ছেলেটা খুব ভাল।”
হাবাস যে গোয়ার শক্তি সম্পর্কে জানেন না, তা নয়। তবুও তিনি মগজাস্ত্রে শান দিচ্ছেন। আটলেটিকো দে কলকাতা যদি ফাইনালে ওঠে তা হলে সেটা যে তাঁর মুকুটে সেরা পালক হবে, সেটা হাবাসের চেয়ে বেশি কে জানে।
হট ফেভারিট চেন্নাইয়ান যদি হারে তা হলে জিকোর গোয়া হারবে না কেন? হাবাস তো এটা দেখেই শনিবার রাতে ঘুমোতে গেলেন। আশায় আশায়...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy