সপ্তাহের শুরুতে খবরটা শোনার পর থেকেই একটু মন খারাপ হয়ে আছে। শুনলাম, হিন্দুস্থান মোটরস নাকি অ্যাম্বাসাডর গাড়ি তৈরি করাই বন্ধ করে দিচ্ছে! আমার কাছে যে গাড়ি কিংবদন্তির থেকে কম নয়!
ওদের এই সিদ্ধান্তের পিছনে যুক্তিটা বুঝি। ঠিক কী ধরনের অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে এমন পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ল, সেটা আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়। তবু খবরটায় আমি রীতিমতো হতাশ। খানিকটা আবেগতাড়িতও হয়ে পড়েছি।
দিল্লিতে বড় হয়ে ওঠার বছরগুলোয় ‘ট্যাক্সি’ বলতে একটা গাড়িই বুঝতাম। দশাসই হলদে-কালো অ্যাম্বাসাডর! ছোটবেলায় অ্যাম্বির রেক্সিন মোড়া পিছনের সিটে পা ছড়িয়ে বসার রোমাঞ্চটাই অন্য রকম ছিল। দিল্লির রাস্তায় চলত সেই গাড়ির দাদাগিরি। আর পিছনে বসে নিজেকে কেমন রাজারাজড়া মনে হত!
এরই পাশে অ্যাম্বির আবার একটা শান্ত, মার্জিত, সুভদ্র অবতারও ছিল। সাদা, ধূসর বা সবুজ রঙের সেই অ্যাম্বাসাডরগুলো দেখা যেত ঋষীকেশ মুখার্জির সিনেমায়। যেখানে তারা বেশির ভাগই ভারতীয় মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাহক হয়ে হাজির! ভারতীয় আবেগের সঙ্গে এমন অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা একটা গাড়িকে পাকাপাকি ছেঁটে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিশ্চয়ই সহজ হয়নি। আমি নিশ্চিত, অ্যাম্বির নির্মাতারা বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে ভবিষ্যৎ বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এই রাস্তা বেছে নিলেন।
আসলে অনেক সময় প্রতিযোগিতার বাজারে আবেগ আঁকড়ে থাকলে হয়তো বন্ধু পাওয়া যায়, কিন্তু ফল পাওয়া যায় না।
নাইট রাইডার্স পরিবারে আমরাও ঠিক এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
টিমমেট হিসাবে কিংবদন্তি জাক কালিসকে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। ঝুলিতে পঁচিশ হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক রান, প্রায় ছ’শো উইকেট। এত বড় মাপের ক্রিকেটার যে ওর সম্মানে ডাক টিকিট বের হল বলে! কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও এই মুহূর্তে আমাদের প্রথম একাদশে কালিসকে রাখা যাচ্ছে না। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকান মহাতারকা নিজে আমাদের টিম ম্যানেজমেন্টের অন্যতম সদস্য। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে ম্যাচের আগে চূড়ান্ত একাদশ ঠিক করাসবেতেই জাক জড়িত। কিন্তু নিজেকে দলের বাইরে রেখে প্রথম একাদশ ঘোষণার দায়িত্ব পালন করার সময় আজ পর্যন্ত ওকে এক বারের জন্যও মুখ গোমড়া করতে বা অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখিনি! একেই বলে আদর্শ টিম ম্যান!
আমি সত্যিই খুশি যে, নিজের আগে দলকে রাখার এই সংস্কৃতি আমাদের স্কোয়াডের প্রত্যেক ক্রিকেটার একেবারে মজ্জায় ঢুকিয়ে নিয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে, আগের কয়েকটা মরসুমের এমন কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজির কথা জানি যাদের টিমে ক্যাপ্টেনদের দশা ছিল একেবারে জোট সরকারের নেতার মতো। দুর্বল থেকে দুর্বলতম জোটসঙ্গীও সরকার ফেলে দিয়ে বিপর্যয় ঘটানোর ক্ষমতা রাখত। স্বাভাবিক ভাবেই এমন পরিস্থিতিতে নেতার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়। যার প্রভাব সরাসরি পড়ে দলের পারফরম্যান্সে।
বিশ্বাস করুন, একটা দলের সাফল্য একশো মিটারের ছক্কা বা একটা ম্যাজিক বলের থেকেও বেশি অন্য অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। আমার ধারণা, করে বলেই গত তিন বছরে এই নিয়ে আমরা দ্বিতীয় বার ফাইনাল খেলছি। যদিও টিম হিসাবে আমরা বেঙ্গালুরু বা চেন্নাইয়ের মতো বলে বলে বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি হাঁকাতে পারি না। বীরু ভাইয়ের মতো ওই রকম বিধ্বংসী ইনিংসও আমাদের ঝুলিতে বিশেষ নেই।
শুক্রবার পঞ্জাবের হয়ে কী ব্যাটিংটাই না করল বীরু ভাই! অবিশ্বাস্য ইনিংস! বোঝাই যাচ্ছিল, নিজের ব্যাটিংয়ে দারুণ খুশি! এতগুলো বছর ধরে ওকে খুব কাছ থেকে দেখে যে ভাবে চিনেছি, আজও ও ঠিক সেই একই রকম আছে। একদম সোজাসাপটা, সহজ সরল একজন মানুষ। বোলারকে পিটিয়ে ছাতু করার সময় মাঠে ওর পছন্দের এলাকাগুলোও একই রয়ে গিয়েছেথার্ডম্যান থেকে পয়েন্ট আর কভার, আবার স্কোয়ার লেগ থেকে মিড উইকেট। এমনকী ওর সাক্ষাৎকারগুলোও আগের মতো মজাদার। বাবার খারাপ ফর্ম নিয়ে ছেলেকে স্কুুলে ঠাট্টা সহ্য করতে হচ্ছিল বলেই সেটা থামাতে একটা কিছু করে দেখাতে হলএমন কথা একমাত্র বীরু ভাই-ই বলতে পারে!
যে সমালোচকেরা ধরে নিয়েছিল সহবাগ ফুরিয়ে গিয়েছে, শুক্রবার রাতে বীরু ভাইয়ের ব্যাটের গতি, স্ফুর্তি ধ্বংসক্ষমতা এবং আরও অনেক কিছু দেখতে দেখতে তাঁরা ডিনারের সঙ্গে নিজেদের পণ্ডিতমার্কা মন্তব্যগুলোও গিলতে বাধ্য হয়েছেন। বীরু ভাই আর প্রীতি জিন্টার জন্য আমি সত্যিই খুশি।
একটা গল্প আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতেই হবে। ইডেনে পঞ্জাবের সঙ্গে আমাদের প্লে অফ ম্যাচের আগের দিন আমি, আমাদের সহকারী কোচ বিজয় দাহিয়া আর প্রীতি একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। বৃষ্টি নামায় ম্যাচটা মঙ্গলবারের নির্ধারিত দিনে খেলা গেল না বলে প্রীতি খুব হতাশ ছিল। আকাশ তখনও মেঘে ঢাকা। পরিস্থিতি এই রকম যে, বুধবারের রিজার্ভ ডে-তে খেলা না হলে গ্রুপ লিগে বেশি ম্যাচ জেতার সুবাদে পঞ্জাব সরাসরি ফাইনালে চলে যাবে। প্রীতি কিন্তু বারবার বলছিল, মাঠে নেমে লড়াই না করে ও ফাইনালে যেতে চায় না! জোর প্রার্থনা করছিল, বুধবার যাতে খেলাটা হয়।
আপনারা বলতেই পারেন যে, মুখে যা-ই বলুক প্রীতি মনে মনে বৃষ্টিই চাইছিল। আমি কিন্তু বিশ্বাস করি, কথাগুলো ও মন থেকে বলেছিল। তবে স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি ওর জায়গায় থাকলে নির্লজ্জের মতো রিজার্ভ ডে-তেও বৃষ্টির জন্য তেড়ে প্রার্থনা করতাম।
আপনারা বলতেই পারেন আমি অবসেস্ড। কিছু মনে করব না!
বুধবারের পর থেকে অবশ্য অভিনন্দন জানিয়ে এসএমএস-এর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ফাইনালে ওঠার জন্য যত অভিনন্দন পাচ্ছি, ততগুলোই আসছে টেস্ট দলে ফিরেছি বলেও। এ বার আইপিএল খেলার সময় কিন্তু ইংল্যান্ড সফরের দল নির্বাচনের ব্যাপারটা যত দূর সম্ভব মাথার বাইরে রেখেছিলাম। কারণ আমার কাছে ব্যাট হাতে নিজের সাফল্যের থেকে আমাদের দলের আইপিএল জেতাটা অনেক বড়। কিন্তু এখন যখন দলে আমাকে ফেরানো হয়েছে, দু’হাত বাড়িয়ে সুযোগটা গ্রহণ করছি।
যাঁরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে মস্ত বড় ধন্যবাদ। আমি এর মধ্যেও সময় বের করে ব্যক্তিগত ভাবে আপনাদের প্রত্যেককে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। এমনকী সেই ভদ্রলোককেও, যিনি লিখেছেন: ‘শপথ বাক্য’ পাঠ অনুষ্ঠানে ডাক না পেয়ে গম্ভীর আর বিরাট কোহলি দু’জনেই মুখ ভার করে বসে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy