Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ফিকরুই ত্রাতা, ফিকরুই কাঁটা

রেফারির অক্সিজেনে শেষ চারে কলকাতা

আন্তোনিও হাবাসকে দেখে মনে হচ্ছিল ‘শাপমোচনের উত্তমকুমার’! খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা দলকে সেমিফাইনালে তুলে দেওয়ার পর দেখা গেল আটলেটিকো কোচ নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে ফিরে যাচ্ছেন ড্রেসিংরুমে। গ্যালারি তখন উদ্দাম। লুই গার্সিয়ারা সেখানে যাচ্ছেন সমর্থকদের ধন্যবাদ জানাতে। তার মধ্যে হঠাত্‌ই অদৃশ্য হয়ে গেলেন সাদা-জামা পরে থাকা বিতর্কিত স্প্যানিশ কোচ।

ধন্যবাদ। ফিকরুকে যেন সেটাই বলছেন কোচ হাবাস।

ধন্যবাদ। ফিকরুকে যেন সেটাই বলছেন কোচ হাবাস।

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১৯
Share: Save:

এফসি গোয়া ১ (এডগার)

আটলেটিকো ১ (ফিকরু পেনাল্টি)

আন্তোনিও হাবাসকে দেখে মনে হচ্ছিল ‘শাপমোচনের উত্তমকুমার’!

খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা দলকে সেমিফাইনালে তুলে দেওয়ার পর দেখা গেল আটলেটিকো কোচ নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে ফিরে যাচ্ছেন ড্রেসিংরুমে। গ্যালারি তখন উদ্দাম। লুই গার্সিয়ারা সেখানে যাচ্ছেন সমর্থকদের ধন্যবাদ জানাতে। তার মধ্যে হঠাত্‌ই অদৃশ্য হয়ে গেলেন সাদা-জামা পরে থাকা বিতর্কিত স্প্যানিশ কোচ।

কিন্তু যে লোকটার কোচিং অলঙ্কারই হল—চিত্‌কার চেঁচামেচি, হাত পা ছোড়া আর স্কুলের রাগি হেডমাস্টারের মতো আচরণ, তিনি হঠাত্‌ কেন এমন বদলে গেলেন ম্যাচের পর? তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, এতটাই তীব্র চাপে ছিলেন হাবাস যে প্রায় বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন আগের দিন। কলকাতা টিমের পারফরম্যান্সের অবনতি, তাঁর টিম নামানো নিয়ে ঘরে-বাইরের সমালোচনায় রীতিমতো তিতিবিরক্ত ছিলেন তিনি। হয়তো সেই ‘শাপমুক্তি’-র প্রভাবই পড়েছে এদিন।

কিন্তু হাবাস-বিরোধী কলকাতার লোকজন প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, এটা কি সত্যিই আটলেটিকো কোচের স্ট্র্যাটেজির জয়? মগজাস্ত্রের সঠিক প্রয়োগের ফসল? না কি যুক্তরাষ্ট্রের রেফারি বালডোমেরো টোলেডোর সৌজন্যেই সেমিফাইনালের সিঁড়িতে ওঠা লুই গার্সিয়াদের?

ঘটনা যাই হোক, টোলেডো যে ভাবে এ দিন পেনাল্টি পাইয়ে দিলেন কলকাতাকে সে জন্য হাবাস একটা ‘ক্রিসমাস কেক’ আগাম পাঠিয়ে দিতেই পারেন তাঁকে। ফিকরু তেফেরা বিপক্ষের বক্সে প্লে অ্যাকটিং করায় এমনিতেই ওস্তাদ। অভিনয়টা এত নিখুঁত করেন যে ইথিওপিয়ান স্ট্রাইকারকে টলিউডে কোনও পরিচালক ডাকতেই পারেন। সেটা কলকাতা স্ট্রাইকার করলেন এদিনও। বল নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে নিজের পায়ে পায়ে জড়িয়ে পড়ে এমন হইচই করলেন যে বিদেশি রেফারি তাঁর চালাকিটা ধরতেই পারলেন না। করে ফেললেন বড় ভুলও। রেফারি দৌড়ে এসে পেনাল্টি দিলেন। যার জেরে লালকার্ড-ও দেখলেন গোয়ার স্টপার পিনহেইরো। এক ঢিলে দু’টো কাজই করে ফেললেন ফিকরু— গোল এবং প্রতিপক্ষকে খেলা শেষ হওয়ার তেইশ মিনিট আগে দশ জন করে দেওয়া। কলকাতার এক কর্তা হাসতে হাসতে বলছিলেন, “পোয়েটিক জাস্টিস হল এতদিনে। কেরলে তো রেফারি আমাদের ন্যায্য গোল বাতিল করেছিলেন। জিততে দেননি। সেই দুঃখটা আজ ভুললাম।”

কিন্তু বিপক্ষের দশ জন হয়ে যাওয়ার সুযোগটাতো নিতেই পারলেন না গার্সিয়া, বলজিত্‌রা। উল্টে রাকেশ মাসিকে নামিয়ে কলকাতা ফিরে গেল ছয় ডিফেন্ডারের স্ট্র্যাটেজিতে। আর সেখানেই প্রশ্ন উঠে গেল, এর পর জিকোর টিমের সঙ্গে তো দু’ম্যাচের সিরিজ খেলতে হবে হাবাসের টিমকে। ঘরে এবং বাইরের মাঠে। সেই পর্বে কি করবে কলকাতা? কে জেতাবে টিমকে? টিমটার তো গোল করারই লোক-ই নেই।

রেফারির পাশাপাশি এ দিন গোয়া কোচ জিকোও সুবিধা করে দিয়েছিলেন কলকাতাকে। প্রথম একাদশের অর্ধেক ফুটবলারকে বাইরে রেখে মাঠে নেমেছিল গোয়া। সামনে সেমিফাইনাল, তাঁর উপর কৃত্রিম ঘাসে খেলা—ঝুঁকি নেবেনই বা কেন জিকোর মতো ধুরন্ধর কোচ। গোয়ার এই টিমটার উল্কার মতো লিগ টেবলে উঠে আসার পিছনে যাঁদের অবদান প্রচুর সেই আন্দ্রে সান্তোস, স্লেপচিকা, গ্রেগরি, মান্দার, রোমিও, জান সেদা—কেউই তো ছিলেন না টিমে। তাতেও কলকাতা গোল হজম করল। এডগারের আন্তর্জাতিক মানের ভলিটা ফের বোঝাল, আইএসএলে দর্শক টানার জন্য ভবিষ্যতে এগুলোই সেরা বিজ্ঞাপন হতে পারে।

গ্যালারিতে এ দিন ‘লড়াই’ নামে একটি সিনেমার প্রচারে এসেছিলেন প্রসেনজিত্‌, পরমব্রত, গার্গী রায়চৌধুরীর মতো টলিউড তারকারা। তাদের কেউ কেউ লাল-সাদা জার্সিও পড়ে এসেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টিমকে সমর্থনের জন্য। মাঠে কিন্তু হাবাসের টিম সেভাবে লড়াই-ই করতে পারল না। বরং

অস্তিত্বহীন মাঝমাঠ নিয়ে ফিকরু-বোরহারা একটা সময় আট জন মিলে নিজেদের গোল মুখ বন্ধও করে দিলেন। অর্ধেক শক্তি নিয়ে নামা গোয়াকে কিন্তু ওই সময় ঝলমলেই দেখাল। ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ দেওয়া ‘বৃদ্ধ-ন্যুব্জ’ রবার্ট পিরেজ বহু দিন পর মাঠে নেমে দেখালেন, তিনি পারেন, এখনও পারেন। ক্লিফোর্ড, জুয়েল রাজা, পিটার কার্ভালোদের দেখে মনে হল জিকোর হাতে পড়ে আরও ঝকঝকে হয়েছেন। আর পর্তুগালের এডগার কার্ভালহো—যেন নেমেছিলেন দু’টো অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে। গতি, ড্রিবল, অনুমানক্ষমতা, গোল-দক্ষতা—চোখ টানল। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল, রিজার্ভ বেঞ্চেই এই! জিকোর পুরো দল নামলে......। স্টেডিয়াম জুড়ে এই আশঙ্কা ঘুরপাক খেল কলকাতার সুখের দিনেও।

কলকাতার দুই মালিক—সঞ্জীব গোয়েন্‌কা আর উত্‌সব পারেখ ম্যাচের পর ড্রেসিংরুমে গিয়ে উত্‌সাহভাতা দিয়ে এলেন অর্ণব-বলজিতদের। কিন্তু তাতে কি ফিকরুর মাঠে এবং মাঠের বাইরের বোহেমিয়ান কার্যকলাপ কমবে? যে ভাবে প্রকাশ্যে মাঠের মধ্যে ফিকরু দু’বার নিজের টিমেরই পদানিকে দৃষ্টিকটু ভাবে ধাক্কা দিলেন তাতে এই টিমটার শৃঙ্খলা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন উঠবেই। গার্সিয়ার সঙ্গে কোচের গণ্ডগোল, বেটেকে গোলে না খেলালে স্প্যানিশ ফুটবলাররা ঝামেলা পাকাচ্ছেন, সুযোগ না পাওয়া ভারতীয় ফুটবলাররা ক্ষোভে ফুঁসছেন— এ রকম নানা খবর আটলেটিকো শিবির থেকে নিয়মিত চঁুইয়ে বেরোচ্ছে। এগুলো যদি সত্যি হয় তা হলে কিন্তু গোয়ার মতো সংঘবদ্ধ টিমের বিরুদ্ধে ফিকরুদের জেতা কঠিন।

হাবাসের টিম রেফারির অক্সিজেনের সৌজন্যে শেষ চারে পৌঁছলেও কলকাতার ফাইনালে যাওয়া নিয়ে সংশয় কিন্তু কাটছে না।

জিকোর টিমের বিরুদ্ধে নামার আগে কলকাতা টিমটার তাই কিছু সংস্কার দরকার—মানসিকতার সংস্কার।

আটলেটিকো: বেটে, কিংশুক, অর্ণব (রাকেশ), হোসেমি, বিশ্বজিত্‌ (মোহনরাজ) রফি, নাতো (গার্সিয়া), বোরহা, পদানি , বলজিত্‌, ফিকরু।

ছবি: উত্‌পল সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

isl atletico de kolkata fikru ratan chakraborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE