Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অখ্যাত এক মোহনবাগানির বিলাপ

আর ’৭৫-এর প্রসঙ্গ টানার দরকার হবে না ইস্টবেঙ্গলের। সঞ্জয় সেনকে খোলা চিঠি দিলেন সুরবেক বিশ্বাস। পিসতুতো দিদির উপহার সেই সবুজ-মেরুন জার্সি আর সাদা শর্টসটা এখনও সযত্নে তোলা আছে। ক্লাস ওয়ানে পাওয়া। তখন ১৯৮২। আর রবিবার বিকেলে, জানেন সঞ্জয়বাবু, জার্সিটায় হাত বোলাতে বোলাতে খুব কেঁদেছি।

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১৬:৩৭
Share: Save:

সঞ্জয় সেন সমীপেষু

পিসতুতো দিদির উপহার সেই সবুজ-মেরুন জার্সি আর সাদা শর্টসটা এখনও সযত্নে তোলা আছে। ক্লাস ওয়ানে পাওয়া। তখন ১৯৮২। আর রবিবার বিকেলে, জানেন সঞ্জয়বাবু, জার্সিটায় হাত বোলাতে বোলাতে খুব কেঁদেছি। চুলে পাক ধরেছে, চোখে উঠেছে প্রোগ্রেসিভ লেন্স, কিন্তু বিশ্বাস করুন দাদা, এই বয়সেও চোখের জল সামলাতে পারলাম না।

আমার মতো সদ্য চল্লিশ পূর্ণ করা বা তার চেয়ে কমবয়সী মোহনবাগান সমর্থকদের কাছে সেই পাঁচ গোলের কলঙ্কের স্মৃতি নেই। কারণ, চল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৫-এর আইএফএ শিল্ড ফাইনালের সময়ে আমাদের কেউ কেউ সদ্যোজাত, আর কারও তো জন্মই হয়নি। আমরা সেই কলঙ্কের সাক্ষী ছিলাম, এমনটা বলা যাবে না। শুধু সেই পুরনো রেকর্ডের প্রসঙ্গ টেনেই আমাদের বার বার ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা হত। তবে এত দিন। রবিবারের ডার্বি ম্যাচের পর অবশ্য আর ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের চল্লিশ বছরের পুরনো কথা বলার দরকার হবে না। এই ০-৪ গোলে হারার লজ্জা সেই ০-৫-এর চেয়ে কম নয়। আর জানি তো, ডংদের কাছে আধ ডজন গোলে হারতে হারতে কোনও রকমে বেঁচে গিয়েছি।

কত বার হারিয়েছি আমরা লাল-হলুদকে, কিন্তু বন্ধু ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা দাবড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে এই বলে— ‘আগে পাঁচ গোলে আমাদের হারা তো, তার পর আনন্দ করিস।’ বুকে চিনচিনে ব্যথা নিয়েও ফুঁসে উঠেছি, ও সব অতীত, অনেক আগের ব্যাপার, ফাঁকতালে করে ফেলেছিলি, আর কখনও পারবি না। কিন্তু রবিবারের পর সঞ্জয়বাবু, জানেন তো, আর ও কথা বলার মুখ রইল না।

আপনি দাদা, ১৯৯৭-এর সেই ডায়মন্ড ম্যাচের ১-৪ গোলে হারার কথা তুলতেই পারেন। কিন্তু ওটা নিয়ে লাল-হলুদ সমর্থকেরাও বেশি মাথা ঘামায় না। কেন জানেন? ওটা ছিল ডায়মন্ড ফর্মেশন নিয়ে আমাদের কোচ অমল দত্তের পরীক্ষানিরীক্ষা করার ম্যাচ। পরীক্ষাটা কাজে লাগেনি, আমরা হেরে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেই যে নতুন একটা কিছুর উদ্ভাবনার চেষ্টা— সেটা ব্যর্থ হলেও আলোচিত হয়েছিল। আর আমাদের চিমা সে বার এক বার অন্তত ইস্টবেঙ্গলের জালে বল ঢুকিয়েছিল। সে বার ম্যাচের আগে অমল দত্ত ভাইচুংকে চুংচুং, ওমোলোকে অমলেট, সোসোকে শশা বলে বিদ্রূপ করেছিলেন এবং আখেরে তেতে গিয়েছিল ওদের গোটা দল।

আর সঞ্জয়বাবু, আপনি পূর্বসুরির সেই ভুল থেকে কোনও শিক্ষা নিলেন না। উল্টে বড় বড় ভাষণ দিয়ে নিজে ও গোটা টিমটাকে অনর্থক চাপে ফেলে দিলেন। এটা ভোকাল টনিক না দাদা, ভোকাল টনিক না। এটাকে বলে বারফাট্টাই। ফাঁপা আওয়াজ। দয়া করে সনি নর্ডির মতো বারো জনকে আইএসএলের ক্লাবগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার ফলে আপনার দল দুর্বল হয়ে গিয়েছে— অমন যুক্তি-টুক্তি দিতে যাবেন না। কমজোরি টিম নিয়ে যদি আপনি ডং-অবিনাশ-রফিকদের রুখে দিতে না পারেন, তা হলে আপনি কীসের বড় কোচ?

দু’টো উদাহরণ দিই আপনাকে। ১৯৮৮। অপ্রতিরোধ্য, টুর্নামেন্টের পর টুর্নামেন্ট জিতে চলা মোহনবাগানের জয়রথ কলকাতা লিগের প্রথম ডার্বি ম্যাচে থামিয়ে দিয়েছিলেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক কমজোরি দল নিয়ে, স্রেফ স্ট্র্যাটেজি কষে। ১৯৮৯। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের তহবিল গড়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত টুর্নামেন্ট। দুর্ধর্ষ ফর্মে কৃশানু দে। মহামেডান ম্যাচে নিজে হ্যাটট্রিক করেছেন, আরও দু’-তিনটে গোল করিয়েছেন। কিন্তু সেই কৃশানুকে সঞ্জীব দত্ত নামে এক নবাগতকে দিয়ে পুলিশম্যান মার্কিং করিয়ে আটকে দিয়েছিলেন অমল দত্ত। ম্যাচটা জিততে পারিনি, কিন্তু হারতেও হয়নি আমাদের। আপনি কি এই সব আদৌ জানেন দাদা?

সঞ্জয়বাবু, আপনার চেতলার বাড়ি থেকে আরও অনেকটা দক্ষিণে, যাদবপুরের এক উদ্বাস্তু তল্লাট শ্রীকলোনিতে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ত্রিসীমানায় মোহনবাগানের নামগন্ধও নেই। তবু তার মধ্যেই আশৈশব আমি মোহনবাগান সমর্থক। মা-বাবা দু’জনের দিক থেকে পূর্ববঙ্গীয় হলেও লাল-হলুদ সমর্থকদের বড্ড উগ্র মনে হত, ভাল লাগত না মাইরা-কাইট্যা ফ্যালামুর ঔদ্ধত্য। একটু উপলব্ধি হওয়ার মতো অবস্থায় প্রথম বড় ম্যাচের স্মৃতি ১৯৮২-র কলকাতা লিগের ডার্বি।

বাড়িতে তখনও টিভি আসেনি। রেডিও-র রিলে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পাশের বাড়ির দাদার উল্লাসে ঘুম ভেঙে যায়, কী না, কার্তিক শেঠের গোলে ইস্টবেঙ্গল জিতে গিয়েছে। গোটা পাড়া তার পর সাত দিন ধরে আওয়াজ দিল আমাকে। এ সবের জবাবই ওই সবুজ-মেরুন জার্সি। পিসতুতো দিদির কাছে বায়না করেছিলাম। পাড়ার মাঠে যখনই খেলতে নামতাম, ওটা পরেছি। সঞ্জয়বাবু, ওটাই ছিল আমার নিঃশব্দ জবাব ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের। পাড়ার একমাত্র মোহনবাগানির নীরব লড়াই।

দাদা, আমাদের গলার জোর কিছুটা বাড়ল মোহনবাগানে বিদেশি খেলোয়াড় নেওয়া শুরুর পর। আর আমাদের প্রিয় সবুজ তোতা ব্যারেটোর সময়ে তো ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে জেতাটা এক রকম অভ্যাসে পরিণত করেছিলাম। লাল-হলুদের সমর্থকেরা তখন ম্রিয়মান। কিন্তু ওই, পাঁচ গোল খাওয়ার কলঙ্ক একটা সময়ের পর ঠিক ওরা টেনে আনত।

রবিবারের পর ওদের আর ১৯৭৫-এ ফিরতে হবে না সঞ্জয়বাবু। ২০১৫-র ৬ সেপ্টেম্বরের টাটকা প্রসঙ্গ হাতের সামনে পেয়ে গেল।

সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ হতে হয়, যতটা সম্ভব আবেগকে রাখতে হয় নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পাঁচ গোলের ওই লজ্জার পর এক ক্রীড়া সাংবাদিক কোনও দিন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে মাঠে যাননি। আনখশির মোহনবাগানি ওই সাংবাদিকের শর্ত ছিল, মোহনবাগান ওই কলঙ্ক মোচন না করা পর্যন্ত তিনি ডার্বি ম্যাচে যাবেন না। কিন্তু তাঁর নাছোড় ক্রীড়া সম্পাদক তাঁকে সেই অ্যাসাইনমেন্টই দেবেন। তখন সেই সাংবাদিক ছুটি নিতে শুরু করলেন। তবে দেখতে দেখতে ছুটি ফুরিয়ে গেল। তখন বড় কাগজে চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন ওই সাংবাদিক। আমরা, মোহনবাগানিরা সঞ্জয়বাবু, এমনই। প্রকাশ হয়তো কম, আবেগটা কিন্তু বড্ড বেশি।

রবিবারের কলঙ্কের পর একটা প্রতিজ্ঞা করার কথা ভেবেছি মাননীয় মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেন। আধ ডজন গোল ইস্টবেঙ্গলকে না দিতে পারলে টিভিতেও কোনও দিন আর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ দেখব না, কোনও দিন না!

কিন্তু তাতেও কি আপনার মতো মানুষ আদৌ চাগবেন সঞ্জয় সেন?

বিনীত

সুরবেক বিশ্বাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

East Bengal Mohun Bagan Surbek Biswas football
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE